আব্দুল্লাহ আল নাঈম, চবি
নির্জন পাহাড়ি পথ, নীরব রাতের বাতাস, এরই মাঝে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় কিছু অচেনা মুখ। তাদের হাতে সিগারেট, পকেটে ইয়াবা, চোখে অস্থিরতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাস থেকে বিজ্ঞান অনুষদ, সব জায়গাতেই এখন মাদকের ছড়াছড়ি। সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে একের পর এক বহিরাগত মাদকসেবী, কিন্তু তবুও থামছে না এই প্রবাহ। বর্ণনা দিচ্ছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাতের পরিবেশের বর্তমান অবস্থা।
গেল কয়েকদিন ধরে গভীর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাস, জীববিজ্ঞান অনুষদ, ক্যামপাসের বিভিন্ন হল কিংবা অন্যকোনো এরিয়া— দিনদিন অব্যাহতভাবে অনিরাপদ হয়ে উঠছে, বাড়ছে ইয়াবা, গাঁজা ও মাদকের বিস্তার।
গত কয়েকদিনের হালহাকিকত ঘেঁটে দেখা যায়, ১০ নভেম্বর রাত ১টার দিকে ইয়াবাসহ নবাব ফয়জুন্নেসা হলসংলগ্ন এরিয়া থেকে এক বহিরাগত মাদকসেবীকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এর দুইদিন আগে ৮ নভেম্বর জীববিজ্ঞান অনুষদ প্রাঙ্গণ থেকে ৩ মাদকসেবিকে আটক করে, দেহ তল্লাশিতে তাদের কাছ থেকে দুই পিস ইয়াবা, ফয়েল পেপার, সিরিঞ্জসহ মাদক সেবনের সরঞ্জাম পাওয়া যায়।
তবে এখানে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো ওই তিনজনের মধ্যে দুইজন ক্যাম্পাস সংলগ্ন দোকানের কর্মচারী আর বাকি একজন বহিরাগত রাজমিস্ত্রি। এরআগে গত ২৩ অক্টোবর শহিদ ফরহাদ হোসেন হল থেকে বিপুল পরিমাণে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ, গাঁজা, মদ, হুইস্কিসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের উপকরণ সি-ব্লকের ১০৮, ১০৪ নম্বর কক্ষ এবং এ-ব্লকের ১০২ নম্বর কক্ষ থেকে পাওয়া যায়। এখন শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, এত মাদক আসে কোথা থেকে, কোনদিক দিয়েই-বা ঢোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে? আর এগুলো কেন-ই বা রোধ করা যাচ্ছে না?
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ক্যাম্পাস সংলগ্ন দুইটি মাদকের হটস্পট রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ইয়াহইয়া আখতার বলেছেন, মাদকের দুটি নয় আরো একাধিক স্পট রয়েছে। স্থান দুটি— লাল পাহাড় এলাকায় অবস্থানরত চল্লিশোর্ধ্ব এক নারী এসবের কারবার করেন। দ্বিতীয়টি, ক্যামপাসের রেলস্টেশনের দক্ষিণ দিকে রেলওয়ে কলোনি বা বউ বাজার নামক স্পটে প্রচুর মাদকের আনাগোনা। সূত্রটি আরো জানায়, মাদককান্ডে যারাই ধরা পড়ছেন, তারা সকলেই বহিরাগত। এই এড়িয়াগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আওতাধীন না হওয়ায় তারা অভিযান পরিচালনা এবং মাদক নির্মূলে সম্পূর্ণভাবে কাজ করতে পারেন না।
*অরক্ষিত দক্ষিণ ক্যাম্পাস*
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিসংখ্যক নারী বাস করেন দক্ষিণ ক্যাম্পাসে। নারীদের হল এবং অনাবাসিক নারী শিক্ষার্থীদের বসবাস ওইদিকেই। মাদকের ছড়াছড়ি ও রোধ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন নারী ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছে আমার সংবাদ। গতকাল দুপুরে বিজয় ২৪ হল সংসদের ভিপি সানু আক্তার নদী বলেন, আমাদের হলপাড়ায় তেমন ভবঘুরে আসার সুযোগ নেই। এটা একটু ভেতরে। তবে প্রীতিলতা আর ফয়জুন্নেসা হলের ওইদিকটায় মাদকের ছড়াছড়ি প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা।
বেগম খালেদা জিয়া হল সংসদের বিজ্ঞান সম্পাদক নিশাত সালসাবিল শিকদার বলেন, ক্যাম্পাসে অনাবাসিক নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সিংহভাগই থাকেন দক্ষিণ ক্যাম্পাসে। কিন্তু রেলস্টেশনমুখী বাজার সংলগ্ন সড়কের কিছু অংশে এখনো পর্যাপ্ত সড়কবাতি সরবরাহ করা হয়নি, যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বহিরাগতদের ধূমপানসহ আড্ডাবাজি করতে দেখা যায়। যা আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের অস্বস্তি ও নিরাপত্তাহীনতার উদ্রেক ঘটায়।
ফয়জুন্নেসা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সানজিদা ইয়াসমিন রুশমী ১১ সেপ্টেম্বর বলেন, আমাদের হলের পেছনের দিকটায় প্রতিদিন অনেক রাত পর্যন্ত বহিরাগত ঘুরঘুর করে, বাইক নিয়ে ঢোকে আবার অনেকক্ষণ পর চলে যায়। আমার ধারণা মাদক নিতে আসে, বলেন রুশমী।
অব্যাহত ঘটনাগুলোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ফয়জুন্নেসা হল সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) পারমিতা চাকমা। তিনি বলেন, আমার হলের নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আলাদা নজর দিতে হবে। যেহেতু আমাদের হল একটু দূরে এবং শেষ অংশে, তাই হতাশার মোড়ে নিরাপত্তাকর্মীসহ সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো জরুরি। রাতের বেলা হল সংলগ্ন এরিয়ায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে, যা বিদ্যুৎ চলে গেলেও জ্বলবে। এছাড়াও অনেকে রাতের বেলায় বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে যাওয়া আসা করে তাদের হয়ত অনেকে ভার্সিটির স্টুডেন্ট নয়, কেউ ভবঘুরে, কেউ নেশাখোর।
তিনি আরও যোগ করেন, সেই সাথে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনের পুকুর পাড়ে যে অনুষ্ঠানগুলো হয় সেখানে সাউন্ডের বিষয়ে যাতে লিখিত বিধিনিষেধ জারি করা হয়। অনুষ্ঠানে উচ্চমাত্রার সাউন্ডের কারণে অনেকের পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও রুমের দরজা জানালা বন্ধ করার পরেও সাউন্ড আসে। যে কারণে হলে অবস্থানরত ছাত্রীদের পড়াশোনায় বেশ অসুবিধা হয়।
বহিরাগত অনুপ্রবেশ রোধ ও প্রাচীর লাগবে:
পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ডিজিটাল নিরাপত্তা বলয়ে ঢেকে ফেলার আশা ব্যক্ত করে মুঠোফোনে চাকসুর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) তৌফিকুর রহমান বলেন, চাকসুর প্রথম কার্যনির্বাহী সভায় ভিসি, প্রো-ভিসি স্যারদের সাথে নিরাপত্তা বিষয়ে কথা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় পুরো ক্যাম্পাসে সিসি ক্যামেরাসহ যে-কোনো মাদকের হটস্পট বন্ধে এবং ক্যামপাসের প্রতিটি মোড়ে শক্তিশালী সড়কবাতি স্থাপনের আবেদন জানাব।
গতকাল দুপুরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) ইব্রাহিম রনি আমার সংবাদকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে-কোনো ধরনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে চাকসু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে-কোনো ধরনের মাদক নির্মূল, বহিরাগত রোধ এবং নিরাপত্তা প্রাচীরের বিষয়ে আমরা প্রশাসনের কাছে অবশ্যই আবেদন জানাব।
১১ নভেম্বর বিকেল ৩টায় কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় প্রক্টর ড. হোসেন শহিদ সরওয়ার্দীর সঙ্গে। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ক্যামপাসের ২৪টি পয়েন্টে বহিরাগত লোকজনের যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে। আমাদের ৩টি টহল টিম রয়েছে। তারা থেকে থেকে সার্বক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করেন। জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখতে এবং বহিরাগত দমাতে অবশ্যই নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ করা জরুরি।
এরপর গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় মুঠোফোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ইয়াহইয়া আখতারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গা নিয়ে মামলা রয়েছে। মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা চাইলেই যে-কোনো ধরনের নিরাপত্তা প্রাচীর করতে পারিনা। তবে মাদকের কেনা-বেচা ও ছড়াছড়ি কমিয়ে আনতে নিরাপত্তা টিমকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। প্রতিনিয়ত তারা অভিযান চালাচ্ছে। আক্ষেপ করে তিনি আরো বলেন, ক্যাম্পাসে মাদক নির্মূল কিংবা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের সংঘর্ষসহ যে-কোনো ঘটনায় দেশের বৃহত্তর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা পাননা।