সৌদিপ,জবি :
যানজট যখন অবশ্যম্ভাবী তখন সময়টুকু কাজে লাগানোই শ্রেয়। এমন একটি ধারণা এবং যানজটের বিরক্তি থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বেশ কয়েকটি গণপরিবহনে চালু হয়েছিল বই সেবা। অর্থাৎ বাসের মধ্যে বই থাকবে, যাত্রীরা চাইলে বইগুলো পড়তে পারবেন। এই কার্যক্রম যখন শুরু হয় তখন অনেকেই প্রশংসা করেছেন। অনেকে বলেছেন, রাজধানী ঢাকায় পাবলিক বাসের কোন আদর্শ মডেল নেই। এবার সম্ভবত অন্যদের জন্য অনুকরণীয় একটি বিষয় গণপরিবহনে যুক্ত হলো। অথচ এমন একটি উদ্যোগেও যথেষ্ট সাড়া মেলেনি রাজধানীর বাস যাত্রীদের কাছ থেকে।
মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে নিয়মিত চলাচল করে ট্রান্স সিলভা পরিবহন। রাজধানীর পাবলিক বাসগুলোর সাধারণ কিছু চিত্র হলো- অফিস টাইমে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়, আসনের চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী তোলা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা, যাত্রীর সঙ্গে হেল্পারের ভাড়া নিয়ে বিতণ্ডা, বিরক্ত হয়ে চালককে গালমন্দ ইত্যাদি। ট্রান্স সিলভা পরিবহন এগুলো থেকে অনেকটাই মুক্ত। এই পরিবহনের নিয়মিত যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গণপরিবহনের এ ধরনের নৈরাজ্য এড়িয়ে কিছুটা ভিন্ন ইমেজ গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ট্রান্স সিলভা কর্তৃপক্ষ। তারা অন্তত মন্দের ভালো।
এই পরিবহনের বাসে যাত্রীদের জন্য রয়েছে বুক সেলফ। চালকের মাথার ওপরে সাজানো সেলফ থেকে বই নিয়ে যে কোনো যাত্রী পড়তে পারেন। সরেজমিনে দেখা যায়, ছোট্ট একটা বুক সেলফ-এর মধ্যে ২০ থেকে ৩০টি বই সাজিয়ে রাখা। সেগুলোর মধ্যে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ- সবই রয়েছে। এছাড়া পরিবহনটির অন্যতম বিশেষত্ব দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয় না। ভেতরের আসন এবং ফ্যান বেশ পরিপাটি ও সচল। টিভি মনিটরে পরিবেশিত হয় নান্দনিক ও শিক্ষামূলক ভিডিও। যাত্রীদের সেই ভিডিও দেখায় যতটা আগ্রহ বই পড়ায় ততটা নয়। যে কারণে সেলফের বই-এ জমে ধুলোর আস্তরণ। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে।
ট্রান্স সিলভার নিয়মিত যাত্রী শাফিন ভূঁইয়া জানান, কয়েক বছর ধরে আমি এই মেগা সিটির বাসিন্দা। বেশ ভালো লাগে এই বাসে যাতায়াত করতে। বিনা মূল্যে বই পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে বইগুলো রাখা আছে সেগুলোর মানও ভালো। কিন্তু বইগুলো কখনও চেয়ে নিয়ে পড়া হয়নি। পাশের যাত্রী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘ভেবে দেখেছেন, এই যান্ত্রিক নগরীতে কত সময় আপনি-আমি জ্যামে বসে কাটিয়ে দিচ্ছি! সেক্ষেত্রে বই পড়া হতে পারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সময়ের সঠিক ব্যবহার। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বলেন, স্মার্ট ফোনে মুখ গুজে না থেকে একটু বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলি।’ ভিন্নধর্মী এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে যাত্রী আতিকুর রহমান বলেন, ‘চাইলে এখানে বই পড়া যায়। জ্যামে বসে সময় কাটানোর এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা কী হতে পারে? তবে দুঃখজনক হলো, অনেক যাত্রী বিষয়টি জানেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া অনেকের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহও দেখি না।’
বিশ্বব্যাংকের এক হিসেব অনুযায়ী, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লক্ষাধিক কর্মঘণ্টা, সেইসঙ্গে ক্ষতি হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল কর্মঘণ্টা ও অর্থের অপচয় লাঘব করতে গেলে যানজট হ্রাসের কোনো বিকল্প নেই। সেই ক্ষতির কথা চিন্তা করেই সময়টুকু কাজে লাগাতে এগিয়ে এসেছে কিছু উদ্যমী তরুণ। তাদের ‘বইবন্ধু গণপরিবহন পাঠাগার’ এই উদ্যোগের ফসল। তারা ঢাকার আজিমপুর টু গাজীপুর রুটের ভিআইপি-২৭ পরিবহনের ১০টি বাসে যাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে বই পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে সাড়া মিলছে কতটা এই প্রশ্নের উত্তরে পাঠাগারের সহকারী সমন্বয়ক রাসিব আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা শহরে যানজটে পুরো সময় আমরা অলস কাটাতে বাধ্য হই। এই সময় যেন আমরা অলস পার না করি, সেই চিন্তা থেকেই বই বন্ধু প্রজেক্ট চালু করেছিলাম। যাতে মানুষকে বইয়ের সংস্পর্শে নিয়ে আসা যায়। যদিও শুরুতে যতটা সাড়া পাবো ভেবেছিলাম ততটা পাইনি। কারণ পাঠাভ্যাস আমাদের এমনিতেই কম। কিন্তু আমরা হতাশ নই। আরো বেশি গণপরিবহনে এটি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। আসলে ধীরে ধীরেই হয়তো মানুষের মধ্যে চেঞ্জ আসবে।’
এই উদ্যোগ যে যাত্রীদের জন্যই সুফল বয়ে আনছে তা নয়, বরং এর ফলে কিছু বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন বাস চালকরাও। এ প্রসঙ্গে ট্রান্স সিলভা বাসের ম্যানেজার হারুণ অর রশিদ বলেন, ‘আগে জ্যামে আটকে যাত্রীরা অতিষ্ঠ হতো, চিৎকার চেঁচামেচি করত। আমাদের গালমন্দ করত। এখন অনেকটা এগুলো কমে এসেছে। আমরা যাত্রীদের হাতে বই ধরিয়ে দিই। তারা চুপ হয়ে যায়। অনেকে অবাকও হয়। তবে নিজে থেকে খুব কম যাত্রী বই চেয়ে নিয়ে পড়ে।’