প্রতিবেশি দেশের সীমান্ত দিয়ে বানের মত মাদক ঢুকছে:
# ভারত থেকে ঢুকছে ৫ প্রকার মাদক: প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে পাঁচ ধরনের মাদক। কোন মাদক কোন পথে আসছে, তা চিহ্নিত করার পর কারবারিরা পথ পরিবর্তন করছে। একেক ধরনের কারবারি একেক সীমান্ত ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ভারতের নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরোর মহাপরিচালক পর্যায়ে সপ্তম দ্বিপক্ষীয় সভায় বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
তারা জানান, সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারত থেকে আসছে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, ইনজেকশন ও হেরোইন।
দেশে সবচেয়ে বেশি আসছে ফেনসিডিল। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তিন দিকের সীমান্ত দিয়েই বাংলাদেশে ফেনসিডিল ঢুকছে।
তিনি জানান, ভারতের সীমান্ত এলাকায় কারখানা স্থাপন করে এ সিরাপ তৈরি করা হচ্ছে। ফেনসিডিল নামটি বেশি পরিচিত হওয়ায় নতুন নতুন নামে এটি তৈরি করে বাংলাদেশে ঢোকানো হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, অন্তত পাঁচটি নামে ফেনসিডিল দেশে আসছে। বোতলজাত অবস্থায় আসার পাশাপাশি বড় ড্রাম ও পলিথিনে করেও সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল আসে।
কোরেক্স, এসকাফ, এমকে ডিল (কোডিন ফসফেট), কোডোকফ নামের ফেনসিডিলজাতীয় এ মাদক আসে ভারত থেকে বাংলাদেশে।
# মায়ানমার সীমান্তে ইয়াবা কারখানা: শুধু বাংলাদেশের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মিয়ানমারে স্থাপিত হয়েছে সাতটি ইয়াবা কারখানা। প্রতিদিন গড়ে দুই লাখেরও বেশি ইয়াবা তৈরি হচ্ছে এসব কারখানায়।
টেকনাফের ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে সংঘবদ্ধ ২০টি সিন্ডিকেট বাংলাদেশে ইয়াবা আনছে। আর সিন্ডিকেট প্রধানরা নানা কৌশল অবলম্বন করে দেশব্যাপী এসব ইয়াবা পাচার করছে।
২০১২ সাল পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইয়াবা ব্যবসায়ী প্রায় সাড়ে তিনশ’ জনের নাম তালিকাভূক্ত করেছিল। কিন্তু এক বছরে তা বেড়ে এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। চিহ্নিত করা যায়নি এমন আরো অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন। এমনকি টেকনাফের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে গেছে বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিবেদেন উল্লেখ রয়েছে। ইয়াবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্যান্য মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণ।
# ‘ইয়াবা যুগে’ বাংলাদেশ: দক্ষিণ এশিয়ায় মাদকের বিস্তার নিয়ে গবেষণা করেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমদাদুল ইসলাম। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী বাংলাদেশে মাদকের ক্ষেত্রে এখন ‘ইয়াবা যুগ’ চলছে, কারণ বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের অধিকাংশই ইয়াবাসেবী।
অধ্যাপক ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে একটা সময় মাদক হিসেবে ফেনসিডিল বহুল প্রচলিত থাকলেও ১৯৯৯ সাল থেকে ইয়াবা ধীরে ধীরে ওই জায়গা দখল করে নেয়।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে বাংলাদেশে যেখানে ১,২৯,০০০ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছিল, সেখানে ২০১৭ সালে চার কোটি ইয়াবা আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
“সাধারণত ড্রাগস যা ধরা পড়ে, প্রকৃত চালানটা হয়তো তার চেয়ে দশগুণ বেশি। নাইনটি পার্সেন্ট দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। সে হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৪০ কোটি পিস ইয়াবা বাজারে ঢুকছে,” বলছিলেন অধ্যাপক ইসলাম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন ইয়াবাসেবীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি । প্রতিদিন একজন ইয়াবাসেবীর ১০-১২টি ট্যাবলেট প্রয়োজন হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ইয়াবা ব্যবহার করছে।
সেই হিসেবে বাংলাদেশে শুধু ইয়াবার বাজার প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বলে উল্লেখ করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ।
# এনএএসপি ২০০৭ সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে বাংলাদেশে এইচ আইভি/এইডস এর জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ইন্ট্রাভেনাস ড্রাগ ইউজার রয়েছে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার।
# এক জরিপে বলা হয়,মাসকাসক্ত নারী পুরুষরাই এইচ আইভি এইডসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত মহিলাদের সাথে সম্পর্ক করার তুলনায় ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহনে এইচ আইভি এইডস সংক্রমন বেশি হচ্ছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে,এইচ আইভি এইডস ও মাদকের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে,এইডসের মতো ঘাতক ভাইরাস মানবদেহে তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। যার করণে এই ভাইরাস বহনকারী সহজে এইডসের উপস্থিতি বুঝতে পারে না। মাদকের সাথে জড়িত থাকতে থাকতে কখন একজন ব্যক্তিকে ওই ঘাতক ব্যাধিতে পেয়ে বসে; তা প্রথমে বোঝার উপায় থাকে না।
# এন্ট্রি ড্রাগ মুভমেন্ট বাংলাদেশের (এভিএম) দেয়া তথ্য অনুযায়ী যেখানে বিশ্বে মাদকাসক্ত জনসংখ্যার হার শতকরা ২ ভাগ সেখানে বাংলাদেশের এই বৃদ্ধির হার দ্বিগুন। যার প্রধান কারণ হিসাবে এদেশে মাদকের সহজলভ্যতাকেই দায়ী করা হয়েছে। মাদকসেবীদের সংখ্যা দিন দিন মাত্রাতিরিক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় শংকিত হয়ে পড়েছেন দেশের বিশেষজ্ঞরা।
এডিএম এর তথ্য অনুযায়ী,ঢাকার কিছু কিছু এলাকায় একটি সুচ বা সিরিঞ্জ দিয়ে ২৭ জন মাদকাসক্ত মাদক গ্রহন করেছে। এছাড়া জরিপে কয়েকজন মহিলা মাদকসেবীদের পাওয়া গেছে,যাদের মধ্যে ১ হাজারের ও বেশি ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহন করে থাকে। এই মাদকাসক্তরা অন্ধকার জগতে পতিতা হিসাবে বেশি পরিচিত। এদের মধ্যে একজন যদি এইচ আইভি এইডস ভাইরাসে আক্রান্ত থাকে তবে অনেকের মধ্যেই এই ভাইরাস দ্রুত বিস্তার লাভ করবে। এইডস বিস্তারের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে এটাই অন্যতম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
# পঞ্চম জাতীয় এইচ আইভি এবং আচরণগত জরিপে দেখা গেছে,দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহনকারীদের মধ্যে এইচ আইভির হার খুব দ্রুত বাড়ছে।
# কেন্দ্রীয় মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র এক জরিপে জানায়,মাদক গ্রহণের ফলে বর্তমানে এইডসে আক্রান্তের হার ভয়াবহ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
# বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা গ্রহনকারীদের মধ্যে জরিপে শতকরা ৪ জন এইচ আইভিতে আক্রান্ত। সেখানে হেপাটাইটিস সি এরহ ার ৫৯.২%। সর্বোপরি মোট ১৬১৯ জন আইডিইউর মধ্যে হেপাটাইটিস সি এরহ ার ৫৪.২%। ঢাকার একটি ছোট্র এলাকায় শুধুমাত্র ইনজেকশনের মাদকসেবন কারীদের উপর বিগত তিনটি জরিপের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় এই বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৪%থেকে ৮.৯% এবং সর্বশেষ ১০.৫%। এইচ আইভি সংক্রমনের হার ১০% এর ওপরে চলে গেলে সেটাকে নিয়ন্ত্রন করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের এইচ আইভি এইডস রোগ প্রতিরোধ প্রকল্প এইচ আইভি এবং এইডস টার্গেটেড র্ইটারভেশন (এইচএটিআই) এর মাধ্যমে এইচ আইভি এইডসের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ৪০ হাজার ৫০০ জন মাদকসেবী (সুই দ্বারা নেশা ও হেরোইন সেবীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
# শিশু কিশোররাও মাদকের জালে: পত্রিকায় প্রকাশিত এক রির্পোটে বলা হয়,শিশু কিশোররাও বর্তমানে ভয়াবহভাবে মাদকাসক্ত। কিশোর আলমগীর,সোহাগ,রহিম,জহুরুল এখন আর স্কুলে যায় না। কিশোর বয়সেই তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন ফেনসিডিল,গাঁজা,হেরোইন সেবন করতে গিয়ে তারা এখন মরতে বসেছে। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তারা প্রতিদিন চুরিসহ নানা অবৈধ কাজ করে। ফেনসিডিল বিক্রেতা এক নারী জানান,তাদের পরিবারেই অনেকেই ফেনসিডিলসেবী। বাড়ির ৭ বছরের শিশু জীবনও এ ফেনসিডিলে আক্রান্ত। বাড়িতে বিক্রি করি খেতে না দিয়ে পারা যায় না। সোহাগ নামের আরেক কিশোর (১২) জানায়, তার বাড়িতে এগুলোর বেচাকেনা সে কারণে সেও খাওয়া শিখেছে। এখন একদিনও না খেয়ে থাকতে পারি না। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে চুরি করতে হয়। চুরির অপরাধে মানুষ তার শরীরে সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে মানুষ বাঁচতে পারে না। শুধু আলমগীর সোহাগ,রহিম,জীবন নয় এরকম লক্ষ লক্ষ শিশু কিশোর এ সর্বনাশের পথের পথিক। তাই বিপন্ন হতে চলেছে আমাদের আগামী প্রজন্ম।
# পথ শিশুরাও মাদকের কবলে: বাংলাদেশের পথশিশুরাও মাদকের কবলে শীর্ষক এক পত্রিকা রির্পোটে বলা হয়েছে, বয়স তাদের ৮-১২ বছরের মধ্যে। সদরঘাট-ওয়াইজঘাট এলাকায় কয়েকটি পলিথিন ব্যাগ নিয়ে মহা ব্যস্ত তারা। আবার কয়েকজন একটি চটের বস্তা একযোগে ধোঁয়া ছাড়ছে,যে কেউ এ চিত্র দেখলে মনে করবেন পথশিশুরা খেলছে। তবে এ শিশুরা খেলছে তাদের মৃত্যু নিয়ে। মাদকের মৃত্যুনেশায় জড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর লাখো পথশিশু। রাজধানীর ব্যস্ততম প্রতিটি এলাকায় এ ধরনের চিত্র স্বাভাবিক। যারা টাকা বেশি খরচ করতে পারছে তারা সেবন করছে গাঁজা আর যারা পারছে তারা ব্যবহার করছে ডান্ডি। আর বয়স একটু বেশি হলে অথ্যাৎ ১৩-১৫ বছরের শিশুরা নিচ্ছে নেশার ইনজেকশন।
বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার মতে,রাজধানীতে প্রায় চার লাখ পথশিশু রয়েছে। আর এদের বেশির ভাগই এখন নানা নেশায় আসক্ত। পথশিশুদের নেশার জগতে সবচেয়ে পরিচিত নাম ডান্ডি। মাত্র চার-পাঁচ টাকায় এ নেশা জোগাড় করা বলে এ নেশা দিন দিন প্রসার লাভ করছে। একটি পলিথিন তার ভেতর সলিউশন (এক ধরনের রাসায়নিক আঠা যা জুতা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়) দিয়েই তাদের নেশা চলে। পলিথিনের ভেতর সলিউশন ঢুকিয়ে নাক-মুখ দিয়ে তারা গন্ধ নেয়,এতে নেশা হয়। অনুসন্ধানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে পথশিশুদের সাথে আলাপকালে জানা যায়,রাজধানীর প্রায় প্রতিটি পথশিশুই ডান্ডি নামের নেশার সাথে পরিচিত। সাধারণ মানুষ দেখলে বুঝবে না পলিথিন মুখে লাগিয়ে শিশুরা কি করছে। হয়তো তাদের মনে খেলার জন্য কিছু না পেয়ে তারা পলিথিন নিয়ে খেলছে। মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান,সাধারণত জুতায় যে সলিউশন (আঠা) ব্যবহার করা হয় তা এখন অল্প বয়সী নেশাখোরদের কাছে খুবই প্রিয়। এই আঠা পলিথিনের ভেতরে ঢোকালে তাতে বিশেষ গ্যাসের সৃষ্টি হয়। নিউ মার্কেট এলাকায় পথশিশু আব্দুল হাকিম (১০) জানান,দিনে নেশার পেছনে খরচ হয় ১৫-২০ টাকা। তবে টাকা বেশি থাকলে বা আয় বেশি হলে পার্শ্ববর্তী শাহনেওয়াজ হলের সামনে সড়কদ্বীপ থেকে গাঁজা কিনে সেবন করে। শুধু ডান্ডি নয়,এদের কাছে এক লোভনীয় মাদক হলো গাঁজা। বিশেষ করে যাদের বয়স একটু বেশি তারা নেশায় আসক্ত। হাকিম জানায়,অনেক পথশিশু ইনজেকশনের মাধ্যমেও নেশা গ্রহন করছে। (তথ্যসূত্র-নিউজ ওয়েভ বাংলাদেশ ডট কম)।
চলবে…….,
মো: ছানাউল্লাহ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট