———
মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
“দিনাজপুরের হিলিতে গত কয়েকদিন ধরে ভবঘুরের মতো ঘুরছিলেন পচাত্তরের কাছাকাছি এক বৃদ্ধা। মানুষের বারান্দায়, ফুটপাতে তাঁর দিন-রাত। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, সন্তানদের খুঁজছেন” {সূত্র দৈ/আজাদী, ২৪ জুলাই’২৩}, নিউজ ভিশন বিডি।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, বৃদ্ধা শাকিলা বেগমের ছেলে জামিল হোসেন ঢাকা থেকে একটি বাসে তুলে দিয়ে তাঁকে বলেছেন–
“তুমি আর কখনো বাড়িতে আসার চেষ্টা করবে না, যেখানে ইচ্ছা চলে যাও। তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে দিনাজপুরের দূরপাল্লার এক বাসে তুলে দিয়েছেন তাঁর গর্ভেরই সন্তান অজানা অচেনা গন্তব্যে। “
বৃদ্ধ বয়সে আশ্রয়হীন হয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়া সত্ত্বেও মা তাঁর সন্তানের কাছে ফিরে যেতে চায়। হায়রে মায়ের মন! ছেলের বাসার ঠিকানা বা মোবাইল নম্বর বৃদ্ধা মায়ের কাছে নেই। শেষ পর্যন্ত তাঁর আশ্রয় হয়েছে হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। উপজেলা প্রশাসন ঢাকায় ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকায় এই বৃদ্ধা মায়ের ছবি এবং খবর দেখে চমকে উঠেছি। আমরা কীভাবে ভুলে যাই একজন মা দশ মাস দশ দিন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। গর্ভে ধারণ করা মাত্রই মায়ের জীবনের মৃত্যু ঝুঁকি শুরু হয়ে যায়। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মানসিক সামাজিক পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ঝুঁকিসহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
অস্বচ্ছলতা আর দারিদ্রতার কারণে অনেক মা পুষ্টিসহ বিবিধ শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হন। বিশেষ করে কর্মজীবী নারী এবং শ্রমজীবি নারীদের দুর্ভোগ দুর্দশা এবং ভোগান্তির যেন শেষ নেই।
চিকিৎসকদের মতে, ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে মাতৃজঠরেই ঘটে থাকে প্রত্যেক জীবনের সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ ও তাৎপর্যময় ক্রমবিকাশ। মা যে খাবার খাচ্ছেন তার স্বাদ ও গন্ধ পায় গর্ভের শিশু। মায়ের খাবারের মলিকিউল রক্তের মাধ্যমে নাড়ি হয়ে অ্যামনিয়োটিক তরলে মিশে যায়। আর তাই খায় শিশুরা। ১১ সপ্তাহের মাথায় শিশুর স্বাদ গ্রহণের গ্রন্থি বিকশিত হয়। অধিকাংশ নারী ৯ মাস গর্ভাবস্থায় থাকেন না। আমাদের দেশে গর্ভাবস্থার সময় নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। গর্ভাবস্থা এখন ৯ মাস ধরে নেওয়া হয়। আসলে মাত্র ৪ শতাংশ নারী ৪০ সপ্তাহের মাথায় সন্তান জন্ম দেন। বাকিদের ধরে নেওয়া সময় থেকে অন্য সময়ে ডেলিভারি হয়। একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যাথা একবারে সহ্য করতে পারে।
বিস্ময়ের বিষয় একজন মা যখন একটি শিশুকে জন্ম দেন, তখন তিনি ৫৭+ ইউনিট ব্যাথা সহ্য করেন। এই ব্যাথা একসাথে ২০ টি হাড্ডি ভেঙ্গে যাওয়ার ব্যাথা থেকেও বেশি।
শুধু সন্তান ভূমিষ্ট করেই মায়ের মুক্তি নেই। যত্ন পরিচর্যা সেবা এবং নির্ঘুম রাত কাটিয়ে একটি শিশুকে লালন পালন করতে হয়। এখানে মা ও বাবার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে শিশুর মানসিক শারীরিক বিকাশে। অসুখে বিসুখে সেবা যত্ন করার পাশাপাশি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করাটাও অনেক জরুরী। সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যে সন্তানদের মানুষ করতে হয় অস্বচ্ছল হত দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষদেরকে। সন্তানের মুখ চেয়ে কত মা ও বাবা দিনের পর দিন অর্ধহারে অনাহারে থেকেছে। রাত দিন পরিশ্রম করেছে সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় পারিবারিক সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে মা বাবার অনন্য ভুমিকা, অপরিসীম ত্যাগ অনস্বীকার্য। মা ও বাবার আত্ম ত্যাগের কারণে সন্তানেরা জীবনে প্রতিষ্ঠা যশ খ্যাতি অর্জন করে থাকে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়–
“আমাদের দেশে পারিবারিক সামাজিক রাজনৈতিক ধর্মীয় নৈতিক এবং মানবিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি আগ্রাসী অপ ও বিজাতীয় সংস্কৃতির কারণে বৃদ্ধ পিতা মাতারা নানান ধরণের অনাদর অযত্ন অবহেলা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অহরহ।”
এটা যে শুধু দারিদ্রতার জন্যে তা নয় মোটেও। অনেক সম্পদশালী, সম্ভ্রান্ত, উচ্চ শিক্ষিত পরিবারেও মা বাবা নানান রকম মানসিক শারীরিক যন্ত্রণার শিকার হচ্ছেন। অনেক কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন কিন্তু তাঁরা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে আর মা ও বাবা প্রাসদসম অট্টালিকার বৃদ্ধাশ্রমে অযত্ন অবহেলা অনাদরে দিনানিপাত করছে। কেমন আছে, কি খাচ্ছে সে খবর নেয়ার ফুরসৎ কারো নেই। পাশাপাশি বিত্ত সম্পদ, নগদ টাকা স্বর্ণালংকারের ভাগ বাটোয়ারার জন্যে মা বাবারা আজ নানান ধরণের হয়রানীর শিকার হয়ে অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছে। পাষান্ড ছেলে স্ত্রীর কথা শুনে অনেক সময় মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পর্যন্ত পাঠিয়ে দিচ্ছে। শুধু যে ছেলেরাই নির্যাতন করছে তা নয়। মেয়েরাও মায়ের গায়ে হাত তুলছে প্রহার করছে শারীরিক মানসিক নির্যাতন করছে। টাকা গয়না সম্পদের ভাগ বাটোয়ারার জন্যে লাশ দাফন না করে বিচার সালিশ করার নির্দয় নিষ্ঠুর মর্মন্তুদ হীন মন-মানসিকতা আজকের সমাজে যেন সহজ স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আদর স্নেহ মায়া মমতা প্রেম ভালবাসা সেবা দিয়ে জামিলদের বুকে আগলে রাখা শাকিলা বেগমদের যে সময় সেবা যত্ন শ্রদ্ধা ভালবাসা পাওয়ার কথা তখন নির্দয় নিষ্ঠুর পাষান্ড জামিল হোসেনরা মা’কে ঠেলে দিয়েছে অজানা অচেনা পথে। খোলা আকাশের নীচে অনিশ্চিয়তায় ভরা অপরিচিত একটা স্থানে। অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মায়ের আর্তনাদে আল্লাহ্র আরশ কি কেঁপে উঠছে না? পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজের অধিকারের পরই পিতা-মাতার অধিকারের কথা বলেছেন, “আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারু উপাসনা করো না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তুমি তাদের প্রতি উহ্ শব্দটিও উচ্চারণ করো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। তুমি তাদের সঙ্গে নম্রভাবে কথা বলো’। ‘আর তাদের প্রতি মমতাবশে নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি দয়া কর যেমন তারা আমাকে শৈশবে দয়াপরবশে লালন-পালন করেছিলেন’। ‘তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের অন্তরে যা আছে তা ভালভাবেই জানেন। যদি তোমরা সৎকর্ম পরায়ণ হও, তবে তিনি তওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল’ (সূরা: বনী ইসরাঈল, আয়াত: ২৩-২৫)। আসুন আমরা আমাদের পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধা স্নেহ ভালবাসা মায়া মমতা অন্তর দিয়ে অনুভব করি। সুখে দুঃখে তাঁদের পাশে থাকি যেভাবে তাঁরা আমাদের পাশে ছিলেন।