বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে গাছের পাতা স্পর্শ করতে করতে বাশার বললেন, ‘গত সোমবার (১০ জুলাই) ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর এই কাজটিই সবচেয়ে বেশি করেছি। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে স্পর্শ তো দূরে থাক, এই দুই চোখে কোনো গাছই দেখিনি।’
গল্পটি ৩৩ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি যুবক বাশার ওবাইদির। জীবন সম্পর্কে খুব সামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১৪ সালে কারাগারে যেতে হয়েছিল তাঁকে। তখন বয়স মাত্র ২৪। গত সপ্তাহে যখন ইসরায়েলি কারাগার থেকে বেরোচ্ছিলেন, তখন রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি হচ্ছিল মনের ভেতর। কারণ, জেলে থাকতেই তাঁর সঙ্গে ইসলাম আলিয়ান নামের এক ফিলিস্তিনি তরুণীর প্রেম হয়েছিল। কারাগারে থাকতেই বাগদানও সেরে রেখেছিলেন।
একটু পর বাশার ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরের প্রতিটি কোনায় চোখ বোলালেন। সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। যেন প্রথমবার দেখছেন! বাশারের মা তাঁকে অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা বাগদত্তা আলিয়ানও তাঁকে এটা-সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। দুই নারীর উষ্ণ আন্তরিকতা বলে দিচ্ছিল, গরাদ তাঁদের ভালোবাসা বিনিময়ে সাময়িক অন্তরায় সৃষ্টি করলেও, তাতে মোটেও চিড় ধরাতে পারেনি।
ফিলিস্তিনের লাফতা গ্রামের আরদ আল-সামার মহল্লা, যেখান থেকে বাশার ওবাইদির দাদাকে ১৯৪৮ সালে উচ্ছেদ করা হয়, সেখানেই তাঁর, তাঁর পরিবার ও বাগদত্তা আলিয়ানের সঙ্গে দেখা হয় আল-জাজিরার প্রতিবেদকের।
কাচের দেয়ালের ওপারে প্রেম বিনিময়
বাশার তাঁর বন্দিজীবনের অনেক দুঃখের কথাই তুলে ধরলেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ টেনে জানালেন, ২০১৪ সালে দখলদার ইহুদিরা ফিলিস্তিনি তরুণ আবু খুদাইরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। সেই ঘটনার সূত্রে জেরুজালেমে ‘আবু খুদাইর বিদ্রোহ’ শুরু হয়েছিল। তখনই বাড়ি থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। এরপর শুরু হয় কারাগারের নিষ্ঠুর জীবন।
বাশারকে ৯ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। সাজা শুরুর দ্বিতীয় বছরে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ইসলাম আলিয়ানের। আলিয়ান মূলত তাঁর সহোদর ভাইকে দেখতে প্রায়ই কারাগারে যেতেন।
কারাগারের সাক্ষাৎকক্ষের কাচের ওপারে আলিয়ানকে প্রথমবার দেখেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন বাশার। তখনই পছন্দের কথা আলিয়ানের ভাইকে জানিয়েছিলেন। এরপর আরও কয়েকবার আলিয়ান কারাগারে এসেছিলেন। বাশারের সঙ্গেও তাঁর দেখা হয়, কথা হয়—যেভাবে কারাবন্দীদের সঙ্গে কথা হয়। এরপর ভালোবাসা বিনিময়। পরে তাঁদের ভালোবাসাকে স্থায়ী রূপ দিতে দুই পরিবারের সদস্যরাও মিলিত হন।
বাশার পরিচয় ও প্রণয়ের এসব গল্প বলছিলেন আর আলিয়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিলেন। বাশার জানালেন, আলিয়ান তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমার পবিত্র অনুভূতির কথাগুলো আমার কানে পৌঁছাতেই আমার হৃদয়ে দীপ জ্বলে উঠেছিল।’
বন্দীর সঙ্গে বাগদান
বাশারের প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ বলার আগে আলিয়ানের কপালে ক্ষণিকের জন্য চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। মনের ভেতর বিভ্রান্তি ও সিদ্ধান্তহীনতা তৈরি হয়েছিল। কারণ, তিনি ভালো করেই জানতেন, এই সম্পর্কে ‘হ্যাঁ’ বললে তাঁকে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে তিনি নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেন এবং সব বিপদ-আপদকে আলিঙ্গন করার সিদ্ধান্ত নেন। কারাগারে মানবেতর জীবনযাপনকারী একজন বন্দীর সঙ্গে সারা জীবনের জন্য বাঁধা পড়ার মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একজন তরুণীর মধ্যে কোন গুণটি থাকা চাই—এমন প্রশ্নের জবাবে আলিয়ান বললেন, ‘অল্প সাহস আর অনেক সংকল্প!’
আলিয়ান আরও বললেন, ‘কখনো কল্পনাই করিনি, বেশ কয়েক বছরের সাজা বাকি এমন কোনো বন্দীর সঙ্গে আমার বাগদান হবে। তবে আমি এও বিশ্বাস করতাম, একজন বন্দীরও ভালোবাসার এবং স্বপ্নের নারীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির অধিকার আছে। আমার মনে হয়েছিল, বাশারই সেই ব্যক্তি, জীবনসঙ্গী হিসেবে যার সঙ্গে আমি পুরো জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে এসেছি।’
বেশ কিছুদিনের প্রচেষ্টার পরই বাশারের জন্য বাগদানের আংটি জেলের ভেতরের পাঠাতে পেরেছিলেন আলিয়ান। বাশারও তাঁর জন্য জেলের প্রকোষ্ঠ থেকে একটি ছোট উপহার পাঠিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের শুরুতে তাঁদের বাগদান সম্পন্ন হয়। অনুষ্ঠান হয়েছিল আলিয়ানের বাপের বাড়িতে, জেরুজালেমের ইসাভিয়া গ্রামে।
বাশারের সঙ্গে আলিয়ানের যখন প্রথম দেখা হয়, তখন আলিয়ান মাত্র ১৬ বছরের এক কিশোরী। গত সপ্তাহে যখন বাশার কারাগার থেকে ছাড়া পান, তখন আলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। কৈশোর থেকে এতটা বছর ইসরায়েলের জেলে বন্দীদের খুব কাছ থেকে তিনি দেখে আসছেন।
বাশারদের দুঃখ কি ফুরোবে
একটু পরপর বাশারের মা হুদাইল ওবাইদি আমাদের (প্রতিবেদক) কাছে আসছিলেন। আবার অন্য মেহমানদের স্বাগত জানাতে ঘরদোরও গোছাচ্ছিলেন। ঘনঘন আমাদের কাছে এসে মূলত তিনি বাশারকেই দেখছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, ছেলে এখন তাঁর কাছে চলে এসেছেন।
বাশারের মায়ের চাওয়া, নয় বছর যে দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে তিনি ও তাঁর পরিবার গেছেন, এই মুক্তি যেন সেটির শেষ অধ্যায় হয়। বাশারকে রমজান মাসে গ্রেপ্তার করেছিল ইসরায়েলি বাহিনী। ইফতারের দস্তরখানে তাঁর আকস্মিক অনুপস্থিতি মেনে নেওয়া খুব কঠিন ছিল মায়ের। তিনি বলেন, ‘বাশার আমার বড় সন্তান; আমার প্রথম আনন্দ। কারাগারের প্রকোষ্ঠে সে মানবেতর জীবনযাপন করবে—এটা আমি মেনে নিতে পারিনি।’
বাশারকে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে স্থানান্তরের সময়টাও মায়ের স্পষ্ট স্মরণে আছে। তিনি বললেন, ‘তাকে প্রথমে আসকালান জেলে নেওয়া হয়েছিল। এরপর রিমন জেলে। এপর নাফখাহ জেলে। সর্বশেষ মরুভূমির আন-নাকব জেল থেকে মুক্ত হয় সে।’
বন্দী ছেলেকে দেখতে যাওয়া এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার মুহূর্তগুলো মায়ের স্মৃতিতে গভীর খাদের সৃষ্টি করেছে। সেই সময়ের এটুকু সুখস্মৃতি তাঁর অবশ্য আছে, দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যখন তিনি কারাগারের পৌঁছাতেন, বাশারের সাক্ষাৎকক্ষে প্রবেশ করতেন, কাচের ওপার থেকে ছেলেকে দেখতেন এবং টেলিফোনে তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতেন—তখন সব কষ্ট নিমেষে উবে যেত।
বাশারের মা আরও বললেন, ‘দীর্ঘ বন্দিজীবনের কারণে সে তাঁর দুই বোন—নুর ও লানার বিয়ে, তাঁদের সমাবর্তন এবং অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানে আমাদের সঙ্গে উপস্থিত থাকতে পারেনি। এমনকি নিজের বাগদান অনুষ্ঠানেও সে অনুপস্থিত ছিল। কারাগারের জীবন সীমাহীন কষ্টের!’
‘আমরা (প্রতিবেদক) বাড়ি থেকে বের হতেই দেখি, বাশার একটি তরমুজ হাতে দৌড়ে আসছেন এবং বলছেন, ‘গত ৯ বছর এই ফল খাব দূরের কথা, ছুঁয়েও দেখিনি।’
বাশারের মতো ৪ হাজার ৯০০ ফিলিস্তিনি বন্দী আছেন ইসরায়েলি কারাগারে। তাঁদের মধ্যে ৭০০ জন অসুস্থ এবং ২০০ জন নারী ও শিশু। এভাবেই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ডুকরে মরছে তাঁদের ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো।
আল-জাজিরা আরবি সংস্করণে প্রকাশিত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আসিল আল জুন্দির