রংপুর ব্যুরো :
ঈদ ও এর পরদিন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকরা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করায় বিনা চিকিৎসায় ১৩ রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বজনদের অভিযোগ, এই দুই দিনে কোনও চিকিৎসক ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগীদের দেখতে আসেননি এবং ব্যবস্থাপত্রও দেননি। নার্স আর ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ২/১ বার এলেও তারা রোগীদের স্যালাইন ও কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন। এক রোগীর স্বজন বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার বিষয়টি পরিচালকের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন।
রমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, ঈদের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে চিকিৎসকদের কেউই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেননি। বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দুই-একজন ছাড়া গেল দুই দিন কেউ হাসপাতালে আসেননি। জরুরি বিভাগে ভর্তির ব্যবস্থাপত্র নিয়ে রোগীরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে গেলেও কোনো চিকিৎসক রোগীদের দেখতে আসেননি। এমনকি ওষুধ সেবনের ব্যবস্থাপত্রও করে দেননি। শুধু তাই নয়, রোগীদের স্যালাইন ও কিছু ওষুধ লিখে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দায়সাড়া দায়িত্ব পালন করেছেন নার্স ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
ঈদের দিন মঙ্গলবার (৩ মে) বিকালে ও বুধবার দুপুরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন, কিডনি, গাইনি ও শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি রোগী মারা গেছেন মেডিসিন ওয়ার্ডে। ভর্তি থাকা রোগী ও স্বজনদের আর্তনাদে হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যে ২/১ জন ছাড়া আর কেউ গত তিন দিন হাসপাতালে আসেননি। তাদের চেম্বারেও তালা দেখা গেছে। মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও মেডিক্যাল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. মাহফুজার রহমান এই দুই দিন তার ওয়ার্ডে আসেননি বলে অভিযোগ করেছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। তালা দেখা গেছে চেম্বারে। ওয়ার্ডগুলোতে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা এলেও অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার পদমর্যাদার কোনও চিকিৎসক আসেননি।
হাসপাতালের সহকারী ওয়ার্ড মাস্টার সালাম ১৩ জন মারা যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও বিনা চিকিৎসায় কোনও রোগী মারা যাননি বলে দাবি করেছেন। তবে স্বজনদের অভিযোগ, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে।
রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যে হাতেগোনা দুই-একজন ছাড়া আর কেউ গত দুই দিন হাসপাতালে আসেননি। তাদের চেম্বারও বন্ধ ছিল। বেশির ভাগ ওয়ার্ডে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা এলেও অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার পদমর্যাদার কোনো চিকিৎসক আসেননি। ঈদের তৃতীয় দিন সকালে কয়েকজন চিকিৎসককে দেখা গেলেও তারা কেউই বেশিক্ষণ হাসপাতালে অবস্থান করেননি।
ঈদের দিন মঙ্গলবার রাতে রংপুর নগরীর চব্বিশ হাজারী কদমতলা এলাকায় জুয়েল মিয়া হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সঙ্গে হাসপাতালে এসেছিলেন তার ছোট ভাই শিমুল মিয়া। অনেক ছুটোছুটি করেও চিকিৎসকের দেখা মেলিনি। বিনা চিকিৎসায় পরদিন সকালে মারা যান জুয়েল মিয়া। তিনি রংপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সার্ভেয়ার ছিলেন।
শিমুল মিয়ার অভিযোগ, ঈদের দিন রাতে তার বড় ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতে কোনো চিকিৎসক তাকে দেখতে আসেননি। এমনকি কোনো চিকিৎসাপত্রও দেওয়া হয়নি। শুধু চিকিৎসকের পরামর্শের অভাব আর বিনা চিকিৎসায় বুধবার সকালে তার ভাই জুয়েল মিয়ার মৃত্যু হয়। বড় ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করে চিকিৎসকদের কর্তব্যে অবহেলার বিচার দাবি করে হাসপাতালের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলেও তিনি জানান।
একই অভিযোগ পীরগাছা উপজেলার পূর্ব দেবু গ্রামের আব্দুল মালেকের স্বজনদের। ঈদের দ্বিতীয় দিন বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী আব্দুল মালেক মারা যান। তার মা ও সন্তানদের অভিযোগ, ঈদের দিন রাতে অসুস্থ আব্দুল মালেককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় পার হলেও কোনো চিকিৎসক রোগীকে দেখতে আসেননি। হাসপাতালে সেবা নিতে এসে বিনা চিকিৎসায় মালেক মারা গেছেন।
পেট ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি থাকা নীলফামারীর নীলসাগর এলাকার জুয়েল দাবি করেন, ঈদের দিন থেকে কোনো চিকিৎসক তাকে দেখতে আসেননি। নার্স ও আয়া এসেছে দুই বার। হাসপাতাল থেকে কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি। উপায় না পেয়ে ছাগল বিক্রি করে তিন হাজার টাকায় বাহির থেকে ওষুধ কিনে এনেছেন তিনি।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. রেজাউল করিম দাবি করেন, ছুটি থাকায় ঈদের সময় একটু সমস্যা হয়। তবে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় ঠিকমতো। তবে বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা গেছে বলে অভিযোগ পাননি তিনি।
১৩ জন বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার বিষয়টি ঠিক নয় বলে দাবি করে বলেন, ‘এমনিতেই হাসপাতালে প্রতিদিন বেশ কয়েকজন রোগী মারা যায়। এসব স্বাভাবিক মৃত্যু।’
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০