মোঃ কাওসার: স্টাফ রিপোর্টার।
মাত্র দেড় বছর বয়সেই বাবা হারিয়ে এতিম হয়ে যায় সিহাব। ছোটবেলা বাবাকে দেখেও যেন না দেখার মতোই। বিভিন্ন সময়ে অনাহারে-অর্ধাহারে কাটে দিন। শুধু ভাতের বিনিময়ে মানুষের বাড়িতে জন খেটে, দিনমজুরের কাজ করে কিংবা দর্জির দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ” নুন আনতে পান্তা ফুরায়”, কখনো কখনো জোটে না দু-মুঠো ভাত ; অথচ পড়াশোনার পিছু ছাড়েনি। স্কুলে ভর্তি হয়ে থাকলেও ঠিকমতো ক্লাশ করতে পারেনি, বাসায় বসেই নিজের চেষ্টায় করেছে পড়াশোনা। তবুও প্রতিটা রেজাল্টই তাক লাগানোর মতো। ক্লাশ ফাইভে জিপিএ ফাইভ, জেএসসিতেও জিপিএ ফাইভ ছুঁইছুঁই, আবার এখন এসএসসিতেও জিপিএ ফাইভ!
সিহাবের বাড়ি ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার গাজনা ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামে। বাবা ছিলেন দরিদ্র কৃষক, অন্যের জমি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নিয়তির করুণ পরিণতি, সিহাবের জন্মের দেড় বছর পরেই মারা যায় সিহাবের বাবা। বড় বোনদের বিয়ে হয়ে যায়, ছিল না কোনো ভাই। পরিবারে শুধু ছোট্ট শিশু সিহাব আর তার বৃদ্ধ মা। সিহাবের এই দুরাবস্থায় ছোট্ট অসহায় সিহাবকে স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যায় তার এক বড় বোন। সিহাবকে লালনপালন করে তার বড় বোন, এক পর্যায়ে ভর্তি করে স্কুলে। প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই চলে তার পড়াশোনা। কিন্তু এবার তার জীবনে নেমে আসে আরেক ট্রাজেডি। তার বোনের সংসারেও দরিদ্রতা চেপে বসে। ভ্যান চালক স্বামীর উপার্জন দিয়ে নিজের সংসারই চলছে কোনোমতে। তার উপর আবার ছোট ভাই আছে বোঝা হয়ে,যেন “মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা” । অভাবের তাড়নায় আর স্বামীর বাড়ির লোকদের চাপে অসহায় ভাইকে ঘর থেকে বের করতে বাধ্য হয় বোন।
সিহাবকে ভর্তি করিয়ে দেয় ফরিদপুরের একটি এতিমখানায়। সেখানে পড়াশোনা করে একবছর। সেই এতিমখানা থেকেও ফিরে আসতে হয় তাকে, শেষে বাবার রেখে যাওয়া ক্ষুদ্র কুটিরেই আশ্রয় নেয় সিহাব। ক্ষুধার তাড়নায় বের হয় কাজের সন্ধানে। শুধু ভাতের বিনিময়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করে। পাশাপাশি ভর্তি হয়ে থাকে তার গ্রামের একটি প্রাইমারি স্কুলে। দিনে মানুষের বাড়িতে কাজ করা আর রাতে টুকিটাকি পড়াশোনা, এভাবেই চলতে থাকে জীবন। ক্লাস ফাইভের সমাপনী পরীক্ষা দেয় সিহাব, কিন্তু এতে ঘটে আশ্চর্যজনক ঘটনা। সে GPA 5.00 পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। চোখ ধাঁধিয়ে দেয় সবাইকে।
তার এই দুরাবস্থায়ও এমন অভাবনীয় রেজাল্ট দেখে তার এক চাচার মনে মায়া জাগে। তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেয় তার চাচা। সিহাব ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় তার গ্রামের মথুরাপুর হাইস্কুলে। কিন্তু এক বছর পর আবার নেমে আসলো ট্রাজেডি। অভাবের সংসারে এভাবে “অন্যের ছেলেকে” খাওয়াতে রাজি না তার চাচী । সিহাবকে কেন্দ্র করে তার চাচার সংসারে দিনদিন ঝগড়া কলহ বাড়তেই থাকে। বাধ্য হয়ে তার চাচাও সরে দাঁড়ায় তার থেকে। আবার সে শুরু করে দিনমজুরের কাজ। এবার সে একটু “বড়” হয়েছে, তাই দিনমজুরের কাজ করে ভাতের পাশাপাশি কিছু টাকাও পায়। এভাবে চলতে থাকে তার দিন। আবারও জেএসসিতে রেজাল্টে বাজিমাত, জেএসসি পরীক্ষায় GPA 4.86 পেয়ে উত্তীর্ণ হয়।
এবার নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। সিহাবের অভাব আর পড়াশোনার মেধা ও চেষ্টা দেখে এক স্থানীয় দর্জি তার দোকানে কাজের সুযোগ দেয় তাকে। দর্জির দোকানে সহযোগিতা করে আর মাঝেমাঝে দিনমজুরের কাজ করে। এমন কঠোর সংগ্রামের মধ্যেই দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে ছোট্ট সিহাব, টিকিয়ে রেখেছে নিজের পড়াশোনা। এবার ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে GPA 5.00 পেয়ে উত্তীর্ণ হয়।
নিউজ ভিশনের সাক্ষাৎকারে সিহাব জানায় তার জীবন সংগ্রামের গল্প। জিপিএ ফাইভ পাওয়ায় তার অনূভুতি জানতে চাইলে তিনি নিউজ ভিশনকে জানান, ” অনুভূতি আসলে কিছু বলে কোনো ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে পারবো না।”
তিনি আরো বলেন, ” রেজাল্টে একরকম মিশ্র অনুভূতি, ভালো খারাপ দুটোই আছে। যদি এত সীমাবদ্ধতা না থাকতো তবে হয়তো আরো অনেক দূরে যেতে পারতাম, অনেক বড় কিছু করতে পারতাম, কিন্তু এখন সবকিছুই অনিশ্চিত, না জানি কখন থেমে যেতে হয়। তাছাড়া আরো খারাপ অনুভূতি হলো,আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতো,তবে এই রেজাল্ট দেখে খুব খুশি হতো। অন্যদিকে ভালো অনুভূতি হলো-এত কষ্টের মধ্যেও আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছি আর এমন একটা রেজাল্ট করতে পারছি,এটা খুবই ভালো লাগার মতো।”
সিহাবের পরবর্তী পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি নিউজ ভিশনকে জানান, এখন তিনি ইলেকট্রনিক কাজ শিখতেছে। এইচএসসিতে তার নিকটস্থ কলেজ ‘সরকারি আইনুদ্দিন কলেজে’ ভর্তি হবে আর ইলেকট্রনিকের কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করবে। এছাড়াও এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে যদি সুযোগ হয়, কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা আছে তার। তবে ইচ্ছে থাকলেও সে ইচ্ছে পূর্ণ হবে কিনা সে ব্যাপারে অনিশ্চিত তিনি। তার মা অসুস্থ, বৃদ্ধ অসুস্থ মায়ের ঔষধ, নিজের পড়াশোনার খরচ, সংসারে সবকিছুই বহন করতে হয় এই ছোট্ট সিহাবকে। এতটুকু বয়সে এত বড় দায়িত্বের বোঝা তার কাঁধে তাই সর্বদা আশঙ্কায় থাকে না জানি কখন পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। তবুও নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে আছে এখন পর্যন্ত।
এত অভাব ও কষ্টের মধ্যেও পড়াশোনা কেন ধরে রাখলে বা পড়াশোনা করে এমন কি করতে চায়, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ” ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব আগ্রহ ছিল, মন চাইতো পড়াশোনা করতে। আর এখন মনে হচ্ছে পড়াশোনা করে বড় কিছু করতে পারবো, বাবা মায়ের সুনাম আনতে পারবো। যদি ভাগ্যে থাকে, কখনো যদি পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া না লাগে,তবে আশা আছে অনেক বড় কিছু করতে পারবো।”
পথশিশুদের মতো বেড়ে ওঠা ছোট্ট সিহাব একদিন অনেক বড় হবে, বাবা মায়ের সুনাম বয়ে আনবে আর দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবে,এমন হাজারো রঙিন স্বপ্ন বুনেই কঠোর সংগ্রামে নিয়োজিত তিনি।জীবনযুদ্ধে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে একদিন করবে অসাধ্য সাধন, এমনটাই প্রত্যাশা এই স্বপ্নবাজ-সংগ্রামী তরুণ কিশোরের।