ছবি: সংগ্রহীত
আদিবাসী উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ব্যাতি রেখে একটি দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীকে কল্পনা করা যায় না বা পূর্ণতা পায় না। এর অর্থ এই যে- বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন গোষ্ঠীতে আদিবাসী, উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে।
যদি বইয়ের ভাষায় উপজাতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয় তাহলে এভাবে বলা হয়ে থাকে- একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত।
বাংলাদেশে যতগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী উপজাতি রয়েছে তার মধ্যে মণিপুরি মুসলিম (পাঙাল)কে একমাত্র মুসলিম উপজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ভারতের মণিপুর রাজ্যে তাদের আদি নিবাস কিন্তু
মণিপুরি মুসলিম পাঙালরা মণিপুরের অভ্যন্তর ছাড়াও বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট এবং ভারতের কাছাড় ত্রিপুরা ও আসামে ব্যাপকভাবে বসবাস করে। এছাড়াও মায়ানমার, সৌদি আরব সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছেন৷
বাংলাদেশের একমাত্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মুসলমান এ সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ধারার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লালন করে প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছে। এ সম্প্রদায় ইসলাম ধর্মাবলম্বী ও সুন্নী সম্প্রদায়ভূক্ত। এরা ইসলামী আইন-কানুন শ্রদ্ধাভরে কঠোরভাবে মেনে চলেন ও বিশ্বাস করেন এবং পালন করেন। এই সম্প্রদায়ের আদি পিতা ছিলেন মুসলিম এবং আদি মাতা হলেন মনিপুরি । ফলে এ সম্প্রদায়ে ইসলামী ও মণিপুরী সংস্কৃতির সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়।
উৎপত্তি ও ইতিহাস: পাঙলদের উৎসভূমি হলো ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে৷ সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সেখানকার রাজপরিবারে সংঘটিত কিছু ঘটনার ফলশ্রুতিতে রাজভ্রাতা সানংবা বিদ্রোহ করে পার্শবর্তী রাজ্য কাছাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি কাছাড়ের রাজার সহযোগিতা নিয়ে বেশ কয়েকবার মণিপুর আক্রমণ করেন। কিন্তু তিনি জয়ের মুখ দেখতে ব্যর্থ হন। অবশেষে ১৬০৬ সালে হবিগঞ্জের তরফ অঞ্চলের পাঠান শাসক খাজা উসমানের সেনাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সানীর নেতৃত্বে মণিপুর আক্রমণের অভিযান চালায় তখনকার মনিপুরের রাজা খাগেম্বার সাথে এক সন্ধির ফলে মণিপুরি মুসলিম পাঙাল জনগোষ্ঠীর মনিপুরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন।
বাংলাদেশে মণিপুরি মুসলিদের আগমন: মণিপুরীরা বাংলাদেশে প্রথম আসেন ঢাকা শহরে। মোঘল শাসক মীর জুমলা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে (১৬৫০-১৬৯৯) আসাম (তৎকালীন কে আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল মণিপুর রাজ্য) আক্রমণ করে আসাম জয় করেন এবং পরাজিত সৈন্যদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এই সৈন্যদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মণিপুরি ছিলেন। বন্দি সৈন্যদের যখন মুক্তি দেওয়া হলো তখন মণিপুরি সৈন্যরা মণিপুরে ফিরে না গিয়ে ঢাকার তেজগাঁও অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। তেজগাঁও-এ তারা যে পাড়ায় থাকতেন কালক্রমে সেই পাড়া মণিপুরিপাড়া নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে সেখানে কোন মণিপুরি বাস করে না।
পরবর্তীতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মণিপুর রাজ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, রাজ-ভ্রাতৃকলহ ও বহিঃশক্তির আক্রমণ ইত্যাদির কারণে রাজ্যকাঠামো কালক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে উনবিংশ শতাব্দীর (১৮১৯-১৮২৫) প্রথম দিকে বার্মার সৈন্যরা মণিপুর রাজ্য আক্রমণ করলে সেখানকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মণিপুরি জাতিসত্তার মানুষ প্রাণভয়ে মণিপুর রাজ্য ত্যাগ করে বিক্ষিপ্তভাবে পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, বার্মা এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের সিলেট সদর, মৌলভীবাজারে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
মা মণিপুরি আর বাবা বাঙলার পাঠান মুসলিম এর সমন্বয়ে সৃষ্টি হাওয়া এই জাতিসত্বা। মৈতৈ মা এর মৈতৈ আর বাঙলা থেকে আগত খাঁ-ই-বাঙাল বাবার বাঙাল শব্দের সমন্বয় করে তাদের নামকরণ করা হয় মৈতৈবাঙাল, যা মৈতৈদের উচ্চারণ বিভ্রাট জনিত কারণে মৈতৈপাঙাল এ রূপান্তরিত হয়ে যায়। যা মণিপুরি বানান রীতিতে মৈতৈপাঙাল হিসেবে লেখা হয়। এ নব সৃষ্ট জাতিসত্বা তাদের পিতৃধর্ম ইসলামকে ধারণ করার পাশাপাশি মণিপুরি বা মৈতৈ ভাষা ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে যা মণিপুরের অন্য কোন জাতিসত্বা গ্রহণ করেনি।
মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের নিজেদের ভাষা শিক্ষার কোন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি না থাকলেও সামাজিক ভাবে তারা ভাষাচর্চা করে এবং নিজেদের মধ্যে তাদের মাতৃভাষায় কথা বলে। নানা প্রতিকূলতায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হাওয়া সত্ত্বেও পুরোপুরি ধর্মীয় ও সংস্কৃতি আবহে অনেকটা নির্বিঘে বসবাস করছে এ সম্প্রদায়ের লোকজন৷ দেশের একমাত্র মুসলমান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এ মুসলমানরা নিজেদের পাঙাল বা মণিপুরি মুসলিম বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন।
যেসব অঞ্চলে মণিপুরি মুসলিমদের বসবাস :
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজারের এক প্রত্যন্ত উপজেলার নাম কমলগঞ্জ। এ উপজেলাটিতে দেশের একমাত্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মুসলমান সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে৷ উপজেলার ১টি পৌরসভা ৫টি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামে বসবাস করছেন। ইউনিয়ন গুলো হলো, কমলগঞ্জ পৌরসভা, কমলগঞ্জ সদর, আলীনগর, আদমপুর, মাধবপুর ও ইসলামপুরে ধলাই নদীর তীরে গ্রাম গুলো গড়ে উঠেছে। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের বাংলাদেশ মণিপুরি মুসলিম ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (বামডো)এর শুমারি অনুসারে বাংলাদেশের বসবাসরত মনিপুরি মুসলিমদের মোট জনসংখ্যা ১০৯৪৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫৬৩৮ এবং মহিলা ৫৩০৯৷ মোট পরিবার ১৯২১টি।
মণিপুরি মুসলমানরা প্রধানত সুন্নি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। এই সম্প্রদায়টিতে প্রায় ৪০ টির মতো মসজিদ রয়েছে৷ এছাড়া একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও ৪ট কওমি মাদরাসা গড়ে উঠেছে । মসজিদের ও মাদরাসার খরচও বিভিন্ন ব্যক্তিদের মাধ্যমে জোগাড় হয়। বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ১৫টি কেন্দ্রে মক্তব শিক্ষা চালু রয়েছে। মণিপুরি মুসলিম অধ্যুষিত প্রতিটি গ্রামে-মক্তবে কিংবা মসজিদে ছেলে-মেয়েরাদেরকে কোরআন হাদীস শিক্ষা দেন পাঙল মৌলানা ও হাফেজগন। মণিপুরি মুসলিমদের সমাজব্যবস্থা ও রীতিনীতির সাথে আলেম উলামায়ে কেরামের যথেষ্ঠ অবদান রয়েছে।
সাংবিধানিক অধিকার
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩ (ক) রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা করবে। সংবিধানের কোথাও আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়াও সংবিধানের ২৮ ধারায় উল্লেখ আছে- জনগণের যেকোনো অনগ্রসর অংশকে অগ্রসর করার নিমিত্তে, সুবিধা দেওয়ার নিমিত্তে রাষ্ট্র যেকোনো প্রকার বন্দোবস্ত নিতে পারবে এবং সংবিধানের অন্য কোনো ধারা সেটাকে বাধা দিতে পারবে না। যেমন- শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা, বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ, বিসিএস নিয়োগে কোটা ইত্যাদি সুযোগে এই সম্প্রদায় অনেকটা এগিয়ে আসছে৷
বর্তমানে মণিপুরি মুসলিমের অবস্থাঃ একসময় মণিপুরি মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নিম্ন পর্যায়ের ছিল সেই সময় পুরুষদের অধিকাংশ ছিল কৃষক। এখন কেবল কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে না বরং তারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সম্মানজনক পদে চাকুরী করছেন৷ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরে উচ্চপদস্থ মণিপুরি মুসলমান কর্মকর্তা রয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বহু মণিপুরি মুসলমান রয়েছেন। মণিপুরি মুসলমানরা ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে। পাঙালদের পেশাগত জরিপ ২০১৯ সাল বামডো’র তথ্যমতে চাকরি ৭৭২, প্রবাসী ৩৭৭, কৃষি ৮৫০, অন্যান্য ৭০৪ সর্বমোট ২৭০৩ জন রয়েছে৷
পাঙানদের সমাজে কোন বর্ণভিত্তিক সামাজিক প্রথা বা কোন বর্ণপ্রথার পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গোত্র ব্যবস্থা পরিলক্ষিত পাওয়া যায়৷ বিভিন্ন সামাজিক রীতি ও সংস্কৃতির উপকরণের সাথে সাথে অর্থনীতির বিষয়াদি যেমন কৃষি ব্যবস্থা, তাঁতকর্মসহ জীবনের বিভিন্ন পদক্ষেপে তারা ইসালামের রীতি-নীতি অনুসরণ করেন৷ তবে তারা ঐতিহ্যবাহী রীতির সাথে সাথে ইসলামের অনুশাসনযুক্ত উন্নত সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, মুসলিম মণিপুরি তথা পাঙানরা নিজেদের মধ্যেকার পারস্পরিক সমঝোতা, সহযোগিতা ও আন্তরিকতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন।
লেখক: রফিকুল ইসলাম জসিম
মণিপুরি মুসলিম ও সহ সম্পাদক নিউজ ভিশন