ঢাকামঙ্গলবার , ২৩ এপ্রিল ২০২৪
  1. সর্বশেষ

করোনায় প্রাণের বর্ষবরণ-১৪২৮

প্রতিবেদক
নিউজ এডিটর
১৬ এপ্রিল ২০২১, ২:২৬ অপরাহ্ণ

Link Copied!

তামান্না আক্তার।

এসো হে বৈশাখ এসো এসো,
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে,মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক,যাক পুরাতন স্মৃতি,
যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।

‘অর্থাৎ ১৪২৮ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি দূরে চলে যাক,দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি,অশ্রুঝরার দিনও সুদরে মিলাক।আমাদের জীবন থেকে ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক,ঘুচে যাক,নববর্ষে পুরাতন বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।নতুন উদ্দীপনা নিয়ে শুরু হোক ‘পহেলা বৈশাখ’।

বাংলা ও বাঙালি শব্দদ্বয়ের মধ্যেই এক মাধুর্যের আভাস মেলে যা বাঙালি সংস্কৃতির উৎকর্ষতায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।প্রতিটি জাতি সভ্যতা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে খুঁজে পায় তার নিজস্ব অস্তিত্ব, চেতনা ও অনুভূতি যা তাকে অন্যান্য জাতির থেকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের মর্যাদা দান করে।একইভাবে বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও বর্ষপঞ্জি।আবেগ প্রবণ জাতি হিসেবে আমরা বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণে এক প্রকার আনন্দের জোয়ারে ভাসি।পবিত্র ঈদুল ফিতর,পবিত্র ঈদুল আজ্হা,শারদীয় দুর্গোৎসব,নবান্ন উৎসব,১লা ফাল্গুন,বসন্ত উৎসব, ১লা বৈশাখ নববর্ষ বরণ ইত্যাদি বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য লালন এবং রক্ষা করার ধারাবাহিকতায় বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ‘পহেলা বৈশাখ’ নামে একটি বিশেষ উৎসবমুখর দিন পালন করা হয়।প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল বাংলা নববর্ষের সূচনা হিসেবে ১লা বৈশাখকেন্দ্রিক নানামুখী উৎসবে মেতে উঠে বাঙালি জাতি। তবে বর্ষবরণ উৎসবের বিশেষ অনুসঙ্গ হলো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা ‘।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বহু সংস্কৃতিক সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে।১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হওয়া এই শোভাযাত্রা সকল অপসংস্কৃতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঘোষনার মাধ্যমে মঙ্গলের চেতনায় সকলকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়

।জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, ফলে এটি এখন কেবল আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য নয় বরং আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করে বিশ্ববাসীর উৎসবে পরিণত হয়েছে।এছাড়া রমনার বটমূলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংগীত,নৃত্য কিংবা আবৃত্তি অনুষ্ঠিত হয় যা আমাদের শিকড়কে স্মরণ করিয়ে দেয়।

ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর ১৫৫৬ সালে বাংলা নববর্ষের গোড়াপত্তন করেন।তিনি সারা বিশ্বে একজন মুসলিম উদারপন্থী শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

মূলত ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটগণ হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন।কিন্তু হিজরি পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল।এদিকে চান্দ্র বছর সৌর বছরের থেকে ১১/১২ দিন কম হয়।কারন সৌর বছরে ৩৬৫ দিন আর চান্দ্র বছরে ৩৫৪ দিন।যার ফলে চান্দ্রবছরের ঋতুর সাথে চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজের সময়ে মিল থাকে না।ফলে অসময়ে কৃষকদের উপর খাজনা পরিশোধ করতে হতো।সময়মত খাজনা পরিশোধ না করতে পারলে শুরু হতো কৃষকদের উপর নিপীড়ন ও অত্যাচার।অনেক সময় কৃষকদের শেষ সম্বল তাদের আবাদি জমি দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে হতো। কৃষকদের এরূপ দুর্দশা প্রত্যক্ষ করে পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট আকবর কৃষকদের সুবিধার্থে চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় দরবারের বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে চান্দ্র থেকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।৯৯২ হিজরি অর্থাৎ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর সৌর বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন।তবে ২৯ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের সময় থেকে তিনি এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন।৯৬৩ হিজরির মুহাররম মাস ছিলো বাংলা বৈশাখ মাস যা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং প্রথম দিন ১লা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে গণনা করা হয়।এ থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়।

পরবর্তীতে ১লা বৈশাখ একটি সামাজিক অনুষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে এবং যা সময়ের ধারায় রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমান পর্যায়ে চলমান রয়েছে।বর্ষবরণের আরেকটি আঙ্গিক হলো হালখাতা তেরি করা।এটি মূলত বাংলা সনের প্রথমদিনে দোকানপাট ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অার্থিক লেনদেনে হালনাগাদকরন প্রক্রিয়া। তবে বর্তমানে হালখাতা নামক উৎসব টি মুদি ও স্বর্ণ দোকানকেন্দ্রিক দেখা যায় যেখানে দোকানী তার ক্রেতাকে বছরের প্রথমদিন মিষ্টি দিয়ে বরণ করে নেন।নববর্ষে খাবার হিসেবে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ ভাজা,বিভিন্ন রকম ভর্তা ও কাঁচামরিচের দেখা মেলে।পোশাক হিসেবে মেয়েরা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি ও ছেলেরা পাঞ্জাবি পরিধান করে।বৈশাখকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন করা হয় যেখানে বাহারি রঙ এর পিঠা ছাড়া শাড়ি,চুরিসহ শিশুদের নাগরদোলায় চড়তে দেখা যায়।মেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নর-নারীরা বাংলার ঐতিহ্যবাহী গান পরিবেশন করেন যা বাঙালির অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাকে জাগ্রত করে।

তবে উপরোক্ত বাংলা বর্ষবরণের আমেজ করোনা ভাইরাসের কারনে অনেকাংশে ম্লান/বিবর্ণ হয়ে পড়েছে।গতএকবছর যাবত করোনা ভাইরাসের যে দাপট ছিলো তা গত মার্চ মাসে আরো বেড়ে গিয়েছে।তাই জনগনকে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সরকার ও প্রশাসনমহল সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছেন।যার কারনে বাসার বাইরে জনসমাগমকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।এখন আমাদের উচিত গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রেখে নিজেদের নিরাপত্তা ও অপরকে নিরাপদে রাখার কথা মাথা মাথায় রেখে জনসমাগম এড়িয়ে চলা।পাশাপাশি নিজের পরিবারের সাথে নববর্ষের আনন্দ ভাগ করে নেয়া এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে এই মহামারী থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার প্রার্থনাই যেন এবারের পহেলা বৈশাখ।

নতুন বছর আমাদের সবার জন্য শুভ বার্তা বয়ে আনুক।

শিক্ষার্থী,
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

120 Views

আরও পড়ুন