দীনু্ল ইমাম
ছাত্র: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২৬ মার্চ উপলক্ষে উদ্ভাবন কোচিং সেন্টার একটা ক্রিকেট খেলার আয়োজন করে। সেখানে আমি টিচার হিসেবে খেলার আমন্ত্রণ পেলাম। ফাইনালে এসে আমরা বেটিং করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তাই আমি আউটে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং হেঁটে একটা ফুচকা দোকানের সামনে গেলাম। তারপর দোকানের চেয়ারে বসলাম এবং দোকানদারের দিকে তাকালাম। তারপর কেনো যেন মনে হলো ছেলেটাকে কিছু প্রশ্ন করি। কারণ, ছেলেটা দেখতে মোটামুটি সুন্দর, বয়সও বেশি না। ছেলেটির ফুসকার দোকান করার কারণ জানতে চাইলাম। ছেলেটি আমার প্রশ্নের ধরণ দেখে সে ধরে নিলো আমি একজন সাংবাদিক। আমি তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই প্রশ্ন করলাম।
তারপর তার জীবন সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো করতে থাকলাম। প্রায় ১০০ এর বেশি প্রশ্ন করলাম। আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম ছেলেটি কোনো কষ্ট বুকের ভেতর চেপে রেখেছে। ছেলেটির নাম মোহাম্মদ রোকো (২৩)। মনে করছিলাম বয়স ৩০ এর ওপরে হবে কিন্তু বয়স জিজ্ঞেস করার পর বললো ২৩/২৪। ছেলেটির বাবার বাড়ি ঢাকা জেলায়। ছেলের নানার বাড়ি রংপুর। ঢাকাতে তাদের অনেক অর্থ সম্পদ ছিলো। কিন্তু তার বাবা-চাচা সব বিক্রি করে ধ্বংস করে দিলো। এখন নিতান্ত দরিদ্র সীমায় বাস করে। থাকে ‘বাসাবো’ বালুর মাঠের সংলগ্নে বাবা- মার সাথে।
সে এবং তার ছোট বোন সাথে বাবা-মা মিলে চার সদস্যের পরিবার। বাবা আগে কাভার ভ্যান চালাতো,পরে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর ছেলে পরিবারের দায় দায়িত্ব গ্রহণ করে। মাত্র ক্লাস ফাইভ শেষ করার পর আর পড়তে পারেনি। পরিবারের হাল ধরতে পড়াশুনা বন্ধ করে দিলো।
বিয়ে করছে কিনা এই কথা জিজ্ঞেস করতে না করতে চোখগুলো লাল করে টপটপ করে চোখের পানি ছাড়তে শুরু করলো। তারপর বিষয়টা কি, আমার জানার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো। সে বলতে শুরু করলো, ভাই আমি আমার ছোট বোনকে বিয়ে দেওয়ার পর, দুই বছর আগে বিয়ে করছিলাম পরিবারের সিদ্ধান্তে। আমার বউয়ের নাম সুমাইয়া (২১)। আমার দুই তিন বছরের ছোট। কিন্তু আমার বউ ভালো পড়েনি। আমার মায়ের সাথে মিলতো না। আমার মা তাকে খুব আদর করতো কিন্তু তার হিংসে হতো আমার মায়ের প্রতি। তাই আমার মা- বাবা ছেড়ে অামাকে নিয়ে থাকতে চাইলো, কিন্তু অামি রাজি হইনি। তাই সে অামাকে ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে গেলো। তারপর বললো, ভাই যদি স্ত্রী খারাপ হয় দেশের বড় বড় অফিসার হয়েও লাভ নাই, সুখ পাওয়া যাবে না। আবার বললো, আচ্ছা ভাই বলেনতো, আমরা ছেলেরা স্ত্রীর বাবা-মাকে নিজের বাবা-মার মত দেখি,কিন্তু স্ত্রীরা অামাদের (ছেলেদের) বাবা-মাকে নিজের বাবা-মার মত নিতে পারে না কেনো?
তার প্রশ্নে আমি একমত পোষণ করলাম যে, আপনি অনেকটা ঠিক বলছেন। তারপর কেঁদো গলায় বলে গেলো, আমার স্ত্রী তার বাবার বাড়িতে গিয়ে এক লোকের সাথে প্রেম করে, আমি হাতেনাতে ধরে ফেললাম। বললাম তুমি কী চাও? তোমার সিদ্ধান্ত কী? আমার বউ হ্যাঁও বলেনা নাও বলে না। কিছু বলতে চায় না সে, তবে আমার কাছে যদি দেড় লাখ টাকা থাকতো আমি তালাক দিয়ে দিতাম। বিয়ের পর মেয়েরা যদি প্রেম করে, তাহলে তাকে রাখার কোনো যুক্তিকথা নেই।
তারপর আমি বললাম, দেখেশুনে বিয়ে করেন নাই কেনো? সে বললো, বলতে গেলে অনেক কথা, তাহলে শুনুন, প্রথম থেকে বলছি। আমি কান খাড়া করে শুনতে শুরু করলাম।
সে বলতে শুরু করলো, ভাই আমি এই মেয়েকে বিয়ে করার আগে অন্য একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম, মেয়ের সাথে আমার এত ভালো সম্পর্ক হলো যে, আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম। মেয়েটির পেছনে প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা খরচ করলাম ওকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে,কিন্তু তা হলো না। মেয়েটা অনেক পয়সাকড়ির মালিক ছিলো। তিন বোনের ওপর সে বড় মেয়ে। নিজে যা সিদ্ধান্ত নেয় তাই হয়।
একদিন গ্রামের এক জমিদার আসলো তার ছেলের জন্য ওই মেয়েকে দেখতে। দেখে তার পছন্দ হলো, ছেলেরও পছন্দ হলো। অামার মেয়ের প্রতি ভরসা ছিলো সে কখনো এই বিয়ে হতে দেবে না। মেয়ের বাবা আমাদের কথা জানতো। তারপরও বাবা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো, মা তোর হাতে এখন একটা অপশন আছে, দেখ ভেবেচিন্তে। আমি পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে যে বাড়িটা করলাম, এ রকম ১০ টা বাড়ি এই জমিদার করতে পারবে। মেয়েটা আমাকে ফোন দিয়ে বলে তুমি যদি আমার বাবার বাড়ির সমান একটা বাড়ি করতে পারো বা সমপরিমাণ টাকার ব্যাংক একাউন্ট দেখাতে পারো, তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বললো, দেখেন ভাই, যে মেয়েটি গতকাল আমাকে বিয়ে করবে বলছে আর আজ সে উল্টো বলতে শুরু করছে বা শর্ত জুড়ে দিছে। সপ্তাহখানিক যেতে না যেতে তার বিয়ে হয়ে যায়।
আমি ৭/৮ দিন কিছু খাইনি। তারপর এসব দেখে, বাবা-মা মেয়ে দেখতে শুরু করলো আমাকে বিয়ে করানোর জন্য। একদিন আমার নানু,মা ও চাচাতো ভাইয়ের বউ আমাকে রাত দশটাই একটা ঘরে নিয়ে গেলো। দেখলাম সেখানে একটা মেয়ে বসে আছে, আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আমি অতিতের সব ভুলে গেলাম, কারণ যে আমার সাথে প্রতারণা করেছে, তাকে মনে রাখার প্রশ্নই অাসেনা।
তারপর এই মেয়েটিকে প্রশ্ন করলাম। আপনি কোন ক্লাসে পড়েন? বললো নবম শেষ করে আর পড়ি নাই। তারপর তাকে ইংলিশে (Ambulance) এবং বাংলায় (এ্যাম্বুলেন্স)
লিখতে বললাম কিন্তু পারেনি। বুঝে নিলাম ভালো ছাত্রী ছিলো না।
তারপর বাবা-মার সিদ্ধান্তে ওই মেয়েটি বিয়ে করতে বাধ্য হলাম। যেদিন দেখলাম, তার পরেরদিন বিয়ে ।
ছেলেটা উঁচু নিঃশ্বাস ছেড়ে আমাকে উপদেশমূলক বাক্য শুনালো,ভাই কখনো হুটহাট বিয়ে করবেন না। অনেক দিন ধরে দেখাশুনার পর বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিবেন।
বিয়ের দুই বছর হলো কিন্তু তারা বাচ্চা নেয়নি। কারণ মেয়েটি চাইনি, হয়তো তার আগ থেকে কোন পুরুষের সাথে সম্পর্ক ছিলো বলেই হয়তো চাইনি। আর সেই পুরুষটা একজন কাঠ মিস্ত্রি। বিয়ে করে ৮ বছরের একটা বাচ্চা আছে তার। এখন যেহেতু আমি বুঝতে পারলাম যে আমার বউ ওই লোকটার সাথে প্রেম করে, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে আর রাখবোনা। আমি আমার বাবা-মাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী আছে? উত্তরে বললো, কোনো পরিকল্পনা নেই ভাই,শুধু বাবা-মাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করবো।