মোঃ রুবেল মিয়া
মিতা আলী ‘নীরব কোলাহল’ কাব্যগ্রন্থে সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ভাব-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে মানুষের আনন্দ-বেদনা, প্রেম-মিলন-বিরহ, পাওয়া না পাওয়াকে চিত্রিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন পাঠকচিত্তে। কবির সম্পূর্ণ নিজস্ব জগত আছে, কবির দৃষ্টি সাধারণের দৃষ্টির তুলনায় পৃথক তাই কবি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে একীভূত করেছেন তাঁর কবিতায়। কবির মন অতীতগামী, ‘প্রিয় পদরেখা’ কবিতায় তার দেখা পাওয়া যায়।
“ছেড়ে আসা স্কুল আজ মূর্ত
হয়ে উঠে
সবুজ অবুঝ কলকাকলির ভালোবাসার স্রোতে”
কবি অতীত থেকে বের হতে পারেন না। শৈশব-কৈশরের স্মৃতিবাহী ঘটনার সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সময়কে চিত্রিত করেছেন। প্রিয় মানুষের বিয়োগান্ত বেদনা এক গভীর শূন্যতা তৈরি করেছে কবিপ্রাণে –
“হঠাৎ শূন্য ধূ ধূ প্রান্তর-
তারে আমি দেখি নাই
তবু আমায় জুড়ে
আমার হয়ে” -তিন তিরিশ নব্বই
এই শূন্যতা কবিকে প্রেমময় করে তুলেছে, প্রিয় মানুষের ভালোবাসার আলিঙ্গনে আবদ্ধ থাকতে চান কবি।
“তোমার আলিঙ্গনে আবদ্ধ
একমাত্র উষ্ণতায় শীতলতম তনু
আধা জীবনের আধাআধি পথ
তবুও তুমি আমার একমাত্র উষ্ণতার গল্প” -ভালোবাসি বলে
সর্বগ্রাসী প্রেম সংগীতের রেশের মতো অনুরণিত হয়েছে কাব্য জুড়ে –
“আমার একান্ত পুরুষ
তোমাকেই চাই সর্বান্তকরণে”- ওয়ার্ড-১৪২
কিংবা
“আত্মগত একন্ত পুরুষ
ভালোবাসি ভালোবাসি” -একান্ত পুরুষ
দেহাতীত অনুভূতির প্রকাশ-
“শিরায় শিয়ার
মস্তিষ্কের কামনায়
অনুভব চায়
ভালোবাসি তোমাকে
ভালোবাসায়”
একান্ত বন্ধুদের নিয়ে কবি ছোট জগত প্রত্যাশা করেন। মানুষ থেকে মানুষ যখন আলাদা, কৃত্রিমতা, অবিশ্বাস, নাগরিক ব্যস্ততা, যান্ত্রিকতায় কবি বন্ধুদের খুঁজে ফিরে পৃথিবীর পথে –
“জানি মিছেই আশার বাগান-
মিথ্যে ফলের চাষ-
কোথাও আছে এ সংসারে-
বন্ধুর আবাস?”- মাটির পুতুল
সংসারে বন্ধুদের দেখা মেলা ভার তাই কবি বাধ্য হয়ে ফেইসবুকের পাতায় পাতায় বন্ধুদের খুঁজে বেরায়-
“কোথায় আছিস সখী তোরা
পৃথিবীর কোন কোনে
অন-লাইনে ছবি দেখি ফেইসবুকের কল্যাণে।”- প্রিয় পদরেখা
তবুও কবি তৃপ্ত বন্ধুত্বের ভালোবাসায়, একান্ত মানুষে ,মাতৃত্বে । এসব কিছুই নিয়েই কবির রঙিন জীবন। এই রঙে রাঙাতে চান বিশ্বলোক-
“রঙিন সব রঙে একাকার আমি
সেই রঙ ছড়িয়ে দিই জীবনের তরে
বাকি রং ভরে রাখি বুকের ভিতর” – থাকো তো হৃদয় মাঝে
কবি যেন প্রকৃতির কাছে ঋণী, যেখানে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া নিজেকে খুঁজে পান কবি। শহুরে প্রকৃতিকে কবি আপন করে নিয়েছেন, প্রকৃতির আলোতে নিজেকে আলোকিত করেতে চেয়েছেন –
“বিকেল বেলার স্নিগ্ধ বাতাস জুড়িয়ে দিলো গা
ক্যাম্পাসে লাল কৃষ্ণচূড়া, হলুদ সোনালু রাঁধাচূড়া
কুরচি মিলে গড়েছে সোনার আলো” – মাটির পুতুল
টি এস এলিয়টের “There is nothing again.” কিংবা জীবানানন্দ দাশের “এই পৃথিবী একবার পায় তারে পায় নাকো আর” এর মতো সময় ধরে রাখা যায় না, ফেরানো যায় না, আবার বলে কিছু নেই এই নিগূঢ় সত্য ফুটে উঠেছে ‘মেহমান’ কবিতায়-
“সব কিছু ক্ষয়ে যাবে
রয়ে যাবে জীবনের ভোর-
আসবে না ফিরে আর
যে গেছে পার হয়ে কোল!”
একটি দেশের গৌরবোজ্জল ইতিহাস একটি প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস। একটি মাত্র পঙক্তিতে তা ব্যক্ত করেছেন কবি-
“একটি দেশ, একটি প্রতিষ্ঠান
এটাই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’।” – একটি দেশ, একটি প্রতিষ্ঠান।
রাজনীতি সচেতন কবি অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতি সদা সোচ্চার ছিলেন, বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন –
“কোথায় রানা প্লাজার ঘাতকের বিচার রায়?
কী পরিণতি হবে সীতাকুণ্ডের এই অতিলোভী অমানুষ জানোয়ারদের?”- বিবর্ণ আলো
সূর্য না ডোবা দেশ বাংলাদেশে মানুষ পরাজিত হতে পারে না এই বিশ্বাস কবির কবিতায় ফুটে উঠে, কবি ভবিষ্যতের ছবি এঁকেছিলেন ‘শতবার মরি, কোটিবার বেঁচে উঠি’ কবিতায়-
“আমাদের অগ্নিজনতা কেড়ে এনেছিল স্বাধীনতা
তাদের উত্তরসূরি আমরা-
আজ আমরা-
গুড়িয়ে দেব সব অন্যায়-”
কবিকে তাই ৫ই আগস্ট পতাকা হাতে বিজয়ীবেশে ঢাকার রাজপথে দেখা যায়।
দেশ আর কবি যেন সহোদর, যিনি দেশকে ভালোবাসতে পারে তাঁর ভালোবাসা জগতের সব কিছুকে স্পর্শ করে। যুদ্ধ থেকে মুক্ত শান্তিময় পৃথিবী চায় কবি। বিশ্বের কোথাও মানবতার অবমাননা দেখলে কবি হৃদয় কেঁদে উঠে-
“ইউক্রেন আর রাশিয়ার তুমুল যুদ্ধ
ভূলুণ্ঠিত মানবতা”-আমার বসন্তে দীবা ঢাকায় এসেছে\
“আফগানিস্তানে নেমে আসুক শুভছায়া
গ্রিস আর তুরস্কে দাবানল নিভুক
কুষ্টিয়া-জাপান জুড়ে বন্যা থামুক,” – বর্তমান
নারীদের বঞ্চনার ইতিহাস, বেদনাগাঁথা ফুটে উঠেছে বিভিন্ন কবিতায়। ‘আকাশ ভাঙা বৃষ্টি’ কবিতায় এমন এক চিত্র তুলে ধরেন কবি-
“কোন এক সকালে
এমনি করে ব্যস্ত নগরবাসী
মাইকে ঘোষণা শুনবে- একটি শোক সংবাদ
আমার জন্য এটাও হবে না –
আমি নারী তাই”
নিজেদের ইতিহাস নিজেদের তৈরি করতে হবে, জেগে উঠতে হবে আপন মহিমায়। ‘নীরব কোলাহল’ কবিতায় নারীদের প্রতি কবির আহ্বান –
“জীবনের গান গাও
জেগে উঠ নারী
তুমিও মানুষ”
মানুষ সবচেয়ে বড় প্রত্যয়, লিঙ্গ বৈষম্য না থাকার অভিপ্রায় কবিতায় স্পষ্ট। “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” চণ্ডীদাসের এই দর্শন কবির মনেপ্রাণে বিরাজ করে। কবি রবি ঠাকুরের মতো মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে পাপী হতে চান না। ‘মানুষ জিতবেই’ কবিতায় বিশ্বাসী কবিকে দেখা যায়-
“একবার বিশ্বাস করে দেখো
সময় তোমাকে
বন্ধু তোমাকে
ভালোবাসা তোমাকে
আলিঙ্গনে আবদ্ধ করবে”
সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখতে, অশুভ শক্তির কালো হাত ভেঙে দিতে চান কবি-
‘মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু
আজ সবার আনন্দ উৎসব
প্রকৃতি গড়েছে এ ঐক্য
কে তাতে দিবে হাত?
ভেঙে ফেল সেই হাত” – প্রকৃতি ঐক্য
বাস্তববাদী কবি সব কিছু মেনে নেন অবলীলায়। জীবন থেকে পালানোর অবকাশ নেই, সকল তিক্ততা মেনে নিয়েই বিদায়কে স্বাগত জানাতে চায় ‘বিদায়’ কবিতায়-
“পৃথিবীর তিক্ততা সইবার
বেলা শেষে হাসিমুখে
বিদায়টা বলবার।”
জীবন অগাধ কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য, এইভাবেই মৃত্যু চেতনা আসে কবিতায়-
“লাশের মতো ভারী হয় সব
অথচ তখনি ভিড় করে ভীষণ সব আয়োজন।”- জীবনের জয়গান
অবহেলা, অযত্ন, ভালোবাসাহীনতা যেন মৃত্যুর নামান্তর-
“এই নীরব মৃত্যু-
কোন চুম্বন নেই
ভালোবাসা বোধহয়-
নিষিদ্ধ জীবনালাপ” – জীবনালাপ
সক্রেটিস বলেছিলেন ‘Know thyself’, লালন বলেছেন “একবার আপনারে চিনতে পারলে রে, যাবে অচেনারে চেনা, যাবে অচেনারে চেনা” আমরা নিজেদের চিনতে পারিনি, চিনতে পারি না তাই নিয়ে কবির সংশয় –
“তবু কি তুই চিনতে পারিস তোরে
এক্কেবারে একান্ত আপনে?”- হোক তব নব প্রত্যয়
আঙ্গিকের ব্যাপারে কবি সচেতন ছিলেন। দীর্ঘ কবিতা পরিহার করেছেন, কম কথায় বেশি ভাব প্রকাশে কবির কৃতিত্ব। আধুনিক কবি কোন কিছুতেই দায়বদ্ধ নন তাই সূক্ষ্ম ভাবানুভূতি ব্যক্ত করায় কবিতায় প্রচলিত প্রকরণ থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা লক্ষণীয়। তিনি কখনও জাপানি হাইকো, কখনও ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের মতো কবিতা লিখেছেন। নানা ধরণের রঙের ব্যবহার আছে কবিতায়, আছে প্রকৃতির বিভিন্ন অনুসর্গ, অযাযিত অলংকারের ব্যবহার নেই তবে রসের কমতি নেই। গতিময় কবিত্বের বিকাশ আছে যা অনন্য সাধারণ দক্ষতার পরিচয় বহন করে। একজন সচেতন কবি সময় থেকে দূরে পারেন না, তাই সময়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে ‘নীরব কোলাহল’।
লেখক: প্রভাষক,বাংলা বিভাগ
কবিরহাট সরকারি কলেজ, নোয়াখালী