ঢাকাসোমবার , ২৫ নভেম্বর ২০২৪
  1. সর্বশেষ
  2. বিশেষ সংবাদ

সাম্প্রতিক সম‌য়ে আত্মহত‌্যার আ‌ধিক‌্য! আতংকগ্রস্ত অ‌বিভাবকসমাজ!!

প্রতিবেদক
নিউজ ডেস্ক
১ ডিসেম্বর ২০২৩, ৮:০৭ অপরাহ্ণ

Link Copied!

আত্মহত্যা মানে স্বপ্রনোদিত আত্মহনন। নিজের ইচ্ছায় নিজের জীবন হরণ করার কাজটি অত্যন্ত জটিল ও বহুমুখী ঘটনা। কোন তত্ত্বই এখনো আত্মহত্যাকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। আত্মহত্যার সঙ্গে অনেক কাল্পনিক কাহিনী জড়িত রয়েছে। আত্মহত্যা প্রত্যয়টি সাধারণত: ধনাত্মক অর্থবহন করে এবং সাধারণভাবে এমন ধারণা পোষন করা হয় যে, মানুষ যখন মনে করে বেঁচে থাকা অর্থহীন, তখনই আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়। কিন্তু মনোবিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। মনোবিজ্ঞানীগণ আত্মহত্যাকে বেঁচে থাকার ইচ্ছায় সাহায্যের জন্য সর্বশেষ তীব্র চিৎকার হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ মানুষ যখন নানাবিধ সমস্যার কারণে তার জীবনকে বিপন্ন করে তখন সে স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য সমাজের মানুষের কাজে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা চায়, নানা ধরণের আকুতির মাধ্যমে সে বোঝাতে চেষ্টা করে, বেঁচে থাকার জন্য তার সাহায্যের প্রয়োজন। সমাজ থেকে সাহায্য না পাওয়ার কারণে সর্বশেষ হিসাবে বেঁচে নেয় আত্ম হত্যার পথ। তাকে বলা হয়ে থাকে ‘সাহায্যের জন্য সর্বশেষ চিৎকার’। দেশের পত্রপত্রিকাগুলো নিয়মিত প্রকাশ করছে আত্মহত্যার খবর। ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুল পড়–য়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার দেখা যাচ্ছে ব্যাপক ভাবে। প্রেমের ব্যর্থতা কিংবা সম্পর্কে জটিলতা অথবা পড়াশুনার ফল অসন্তোষজনক অবস্থা অনেককে ঠেলে দেয় আত্মহত্যার দিকে। সাম্প্রতিক কক্সবাজারে প্রেমের জন্য কলেজ পড়–য়া ছাত্র সোহেল রানা (২১) আর স্কুল ছাত্রী ইয়াসমিন আকতার (১৫), আয়েশা নুরী (১৮) এর আত্মহনন আমাদেরকে আতংকিত করেছে তুলেছে। আর এর মাধ্যমে আমাদের পারিবারিক জীবনে জেনারেশন গ্যাপের সমস্যাটির ভয়াবহতা তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেলো। আত্মহত্যার এ রির্পোটগুলো আতংকজনক। অকালে স্বপ্নের পাখি গুলো হারিয়ে যাচ্ছে অজানার দেশে। আর শোকাহত বাবা মায়ের আত্মচিৎকার পরিস্থিতিকে আরো করুণ করে তুলছে। শুধু দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী আজ আত্মহনন এক মারাত্মক সমস্যার রুপ নিয়েছে। আত্মহননের মাধ্যমে তারা পৃথিবীবাসীকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, এখনো পৃথিবীটা তাদের বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যা করে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। যুদ্ধ ও খুনের শিকার হয়েও প্রতি বছর এত মানুষের মৃত্যু ঘটে না। আত্মহত্যা প্রবণ এবং আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় এরও প্রায় ১৫-২০ গুন মানুষ। অন্য এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১০ থেকে ১৪ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে ঐকান্তিকভাবে। আর পাঁচ শতাংশ কখনো না কখনো আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালায়। তবে, আত্মহত্যা বা আত্মহত্যা প্রবণতার প্রকৃত হার এর চেয়েও বেশি হতে পারে বলে গবেষকদের ধারণা। কারণ, কুসংস্কার, ধর্মীয় বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক আত্মহত্যা বা আত্মহত্যা প্রচেষ্টার খবর চেপে যায় পরিবার। সারা বিশ্বে আত্মহত্যা প্রবণতা গুরুত্বপূর্ণ এক সামাজিক ও জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আত্মহত্যা মানে কেবল ঐ ব্যক্তির জীবনাবসানই নয়। পরিবার ও সমাজে এর সুদূরপ্রসারী বিরুপ মানসিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া রয়ে যায়। এছাড়া আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যা প্রচেষ্টার সাথে সংশ্লিষ্ট পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ক্ষতির ব্যাপারটিও সামান্য নয়।

* বাংলাদেশে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান :

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে আত্মহত্যা করছে ২৯ ব্যক্তি। ওই পরিসংখ্যানে আরো বলা হয়েছে, ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ ৭ বছরে দেশে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ৭৩ হাজার ৩শ ৮৯ ব্যক্তি। এর মধ্যে ৩১ হাজার ৮শ ৫৭ জন গলায় ফাঁসি দিয়ে এবং ৪১ হাজার ৫শ ৩২ জন বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে অল্প বয়সী কিশোর, কিশোরী থেকে যুবক, যুবতী, পুরুষ ও মহিলা রয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান মতে, ২০০৩ সালে ১০ হাজার ৩শ ৮৩ জন, ২০০৪ সালে ১০ হাজার ১শ ৬৪ জন, ২০০৫ সালে ১০ হাজার ৩শ ৫৭ জন, ২০০৬ সালে ১০ হাজার ৬শ ৮০ জন, ২০০৭ সালে ১১ হাজার ২শ ৫ জন, ২০০৮ সালে ১০ হাজার ৫শ ৯০ জন, ২০০৯ সালে ১০ হাজার ১০ জন আত্মহত্যা করেছে। পরিসংখ্যানটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছর দেশে গড়ে ১০ হাজার ৪শ ৮৪ জন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। আর প্রতি মাসে আত্মহননের সংখ্যা ৪শ ৭৪ জন। সে হিসাবে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে গড়ে ২৯ জন করে। পুলিশের তদন্তকারী সূত্রগুলো বলেছে, মেট্্েরাপলিটন শহরগুলোতে গলায় ফাঁসি দিয়ে এভং গ্রামাঞ্চলগুলোতে বিষপানে মারা যাওয়ার প্রবণতা বেশি। সূত্র মতে, প্রেমের সম্পর্ক, পারিবারিক কলহ, সাংসারিক অশান্তি, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, পরকীয়া ও মাদকাসক্তির জের এসব আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এছাড়া সামান্য মান অভিমানকে কেন্দ্র করেও আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে কিশোর কিশোরীরা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি।

* কেন মানুষ আত্মঘাতী হয়?

মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, এ নিয়ে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মাঝে নানা ধরণের তাত্ত্বিক আলোচনা রয়েছেন। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, আত্মহত্যার কারণ বহুমুখী ও জটিল। নানা ধরণের শারীরবৃত্তীয়, জেনেটিক, মানসিক ও সামাজিক উপাখ্যান আত্মহত্যার প্ররোচক হিসেবে কাজ করে। যদিও সাধারণভাবে মনে করা হয় নানা ধরণের পারিপাশ্বিক ঘটনা যেমন বলা হয়, পারিবারিক কলহের জের ধরে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে বা চাকরী চলে যাওয়ায় ইত্যাদী কারণে মানুষ আত্মঘাতী হয়ে উঠে । কিন্তু গবেষকরা বলেছেন, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মসহত্যার পেছনে শুধু একটি মাত্র কারণকে দায়ী করা যায় না, এর পেছনে রয়েছে আরো অনেক কিছু। অনেক কারণ মিলে ব্যক্তিকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পথে নিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আত্মহত্যার কারণ হিসেবে প্রায় সময়ই যেটি উপেক্ষিত থেকে যায়, তা হচ্ছে ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতা। গবেষনায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোন না কোন গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকেন। বাংলাদেশ জার্নাল অব সাইকিয়াট্রিকে প্রকাশিত এক মৌলিক গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যা চেষ্টাকারীদের ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগেছিল। হয়তো সেটা গুরুত্ব দেয়া হয় না বা মানসিক রোগ নিশ্চিত হলেও যথাযথ চিকিৎসা করা হয় না। সবচেয়ে আতংকের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে এখনো অজ্ঞতার কারণে মানসিক রোগ গুলোকে জিন ভূতের আছর ভেবে নানা কুসংস্কারমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যা হিতে বিপরীত হয়ে দাড়ায়। অথচ গবেষনায় দেখা যায়, মানসিক রোগাক্রান্তদের ভেতরে আত্মহত্যার হার সাধারণত, সুস্থ মানুষের তুলনায় বেশি। আত্মহত্যার জন্য অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মানসিক রোগটি হচ্ছে বিষন্নতা। গবেষকরা বলেছেন, গুরুতর বিষন্নতা বা মেজর ডিসেসিভ ডিসঅর্ডার এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১৫ শতাংশই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বিষন্নতা রোগে আক্রান্তরা দিনের পর দিন অধিকাংশ সময়ই মন খারাপ করে থাকেন, কোন কাজে উৎসাহ, মনোযোগ পান না, ঘুম, খাওয়ার রুচি, উদ্যম, গতি কমে যায়। পরবর্তীতে তা তীব্র আকার ধারণ করলে আক্রান্তরা নিজেদের জীবনকে বোঝা মনে করতে থাকেন, সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন, প্রতিনিয়ত আত্মঘাতী চিন্তায় মন আচ্ছন্ন হতে থাকে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না করালে এদের অনেকেই নির্মম সিন্ধান্তের পরিণতি ঘটান। আরেকটি জটিল মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরাও অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ১০ শতাংশ সিজোফ্রেনিক রোগী আত্মহত্যা করেন। এছাড়া মাদকাসক্তদেরও আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশী। গবেষকরা জানান, অ্যালকোহলে আসক্তদের ১৫ শতাংশ আত্মহত্যা করেন, হেরোইন আসক্তদের আত্মহত্যার ঝুঁকি মাদকমুক্ত ব্যক্তিদের তুলনায় ২০ গুন বেশী। অন্যান্য মানসিক রোগ, যেমন বিপর্যয়-পরবর্তী মানসিক চাপ বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্টেস ডিসঅর্ডার, অহেতুক ভীতি বা ফোবিয়া, জেনারালাইজড অৎযাংজাইটি ডিসঅর্ডার বা অত্যধিক দুশ্চিন্তাজনিত রোগ এবং কিছু ব্যক্তিত্ব-বৈকল্য বা পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্তদের মধ্যেও আত্মহত্যার হার সাধারণের চেয়ে বেশি। হঠাৎ কোন মানসিক চাপে পড়লে বা জীবনে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে অনেকে এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না। দৃশ্যমান গুরুতর কোন মানসিক রোগ না থাকা সত্ত্বেও কোন পরিকল্পনা বা দীর্ঘমেয়াদী আত্মহত্যা প্রবণতা ছাড়াই হুট করে অনেকে আত্মহত্যা করে বসতে পারেন এমন কোন চাপের মধ্যে পড়লে। পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার ফলে, প্রেমে ব্যর্থতায়, অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে, বাবা মায়ের উপর অভিমান করে এমন হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যারা পূর্ব থেকেই অন্য কোন মানসিক রোগে আক্রান্ত অথবা মানসিক চাপে মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা কম, তাদের ক্ষেত্রে এ ধরণের ঘটনা ঘটার ঝুঁকি বেশী। অবিবাহিত, ডিভোর্সী বা বিপত্মীক, বিধবা, বেকার, দীর্ঘমেয়াদী বা দুরারোগ্য শারীরিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও আত্ম হত্যার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশী। যারা আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তারাও আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়ে যান, কোন কোন গবেষক এ হার প্রায় ৩০/৪০ গুন বেশী বলে অভিহিত করেছেন। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডন জ্যাকসন আত্মহত্যার কারণ গুলোকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন:

১.মানুষ স্বনিয়ন্ত্রিত আগ্রাসী প্রেষণা নিবৃত্তির জন্য আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এ ক্ষেত্রে তিনি যুক্তি হিসেবে ফ্রয়েডের ‘মৃত্যু প্রবণতা’ ধারণাকে গ্রহণ করেছেন। ফ্রয়েডের তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, মানুষের মাঝে বেঁচে থাকা ও মৃত্যুবরণ করা এই দুই ধরণের বিপরীত মূখী প্রবণতা রয়েছে। আত্মহত্যার ঘটনা মৃত্যু প্রবণতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ঘটনা।

২. পূর্ণজন্মের প্রত্যাশা : অনেক মানুষ বিশেষ করে হিন্দুরা বিশ্বাস করে তাদের বর্তমান জীবনের দু:খ,কষ্ট, নানা সমস্যা গুলো এ জন্মে সংশোধনযোগ্য নয়। তাই পরবর্তী জন্মে ভাল হয়ে জন্মানোর মানসে তারা আত্মহত্যাকেই বেছে নেয়।

৩. মানসিক,শারীরিক ও সামাজিক কারণ: মানুষ যখন নানাবিধ কারণে প্রচন্ড মানসিক চাপের সম্মুখিন হয়, তখন তার আত্ম ধারণা বিনষ্ট হয়ে যায়, সে নিজেকে সমাজে, পরিবারে অবাঞ্চিত, ভালবাসা ও সহানুভূতি বঞ্চিত একজন হিসেবে অনুভব করে, অথবা যখন নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখিন হয়, তখন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

আমাদের দেশে আত্মহত্যার যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তাতেও দেখা যায় কিশোর যুবকদের (টিনেজ) মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশী। বিশেষ করে পরীক্ষার বা প্রেমে ব্যর্থতা আত্মহত্যার সাধারণ কারণ ছাড়াও বিশেষ বয়সের গড়টির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো আবেগ প্রবণতা। সে কারণে এই সময়কালকে বলা হয়ে থাকে অস্থির আবেগ প্রবণতার কারণে কিশোর বয়সে খুব সামান্য কারণে প্রচন্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে সমাজের অন্যদের কাজ থেকে সাহায্য সহানুভূতি চায়, ক্রমাগতভাবে সাহায্য ও সহানুভূতি বঞ্চনার কারণে সে বেঁচে থাকার সাহায্যে সর্বশেষ চিৎকার হিসেবে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ।

# আত্মহত্যার সতর্ক সংকেত:

* ঘুম ও খাওয়ার অভ্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন।

* নেশা করা-অ্যালকোহল কিংবা অন্যান্য মাদক গ্রহণ।

* আচমকা ইস্পালসিভ আচরণ করা, বিদ্রোহ করা কিংবা সহিংসতায় জড়িয়ে যাওয়া।

* পরিবার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া, বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী হয়ে যাওয়া।

* পড়াশুনা ও খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ, উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, কাজকর্মে অনাগ্রহ, ঘরের বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেয়া।

* মনোযোগের সমস্যা-পড়াশুনাসহ সব কাজ থেকে মনোযোগ উঠে যাওয়া।

* নিজের চেহারার প্রতি চরম উদাসীনতা, আত্ম অবহেলা।

* আত্মহত্যার বিষয়ে আলোচনা এবং আত্মহত্যার চিন্তা ও আগ্রহের কথা প্রকাশ করা।

# আত্মহত্যার আগাম লক্ষণ:

গুরুত্বহীন তুচ্ছ ঘটনায় হঠাৎ ঝগড়া বিবাদ বাধিয়ে দেয়া (৪০ দশমিক ৩২ শতাংশ), ক্রোধের কারণে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়া (২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ), অন্যের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে দেয়া (২২ দশমিক ৫৮ শতাংশ), হঠাৎ আচার-আচরণ করা (৯৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ) ইত্যাদী।

উপরোক্ত লক্ষণগুলো আত্মহত্যার আগাম ধারণা দিয়ে থাকে। তাই অবিভাবক সহ এ ব্যপারে সবার সচেতন হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

* আত্মহত্যা প্রতিরোধে করনীয় :

আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাদের বেশির ভাগই চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করতে পারে এমন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকে। যেমন, বিষন্নতা, স্কিজোফ্রেনিয়া, মাদকাসক্তি, অস্থির আবেগ ইত্যাদী। আত্মহত্যার মনোবিজ্ঞান বিষয়ে যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে সবচেয়ে বেশি তারা বলেছেন যে, ব্যক্তির অন্তর্নির্হিত মানসিক ব্যাধির চিকিৎসা করাই আত্মহত্যা প্রতিরোধের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। মনোবিজ্ঞানী এডুইন স্নেইডারম্যান বলেন, তিনটি সাধারণ কৌশল এর মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব :

১. তীব্র মানসিক বেদনা ও কষ্ট হ্রাস করা ।

২. চোখের সম্মুখ থেকে পর্দা উঠিয়ে ফেলা, অর্থাৎ ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে দাও, যাতে অনস্তিত্ব এবং অনন্ত দু:খ কষ্ট ভোগ করা ছাড়া অন্যান্য বিকল্প সম্পর্কে ভাবতে পারে তার জন্য তাকে সাহায্য করা।

৩. আত্মবিধ্বংসী কাজ থেকে সামান্য পরিমাণে হলেও তাকে পিছু হটতে বা বিরত রাখতে উৎসাহিত করা।

দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রিক বিভাগের সহকারী রেজিস্টার মো: রাশিদুল হক রানা জানান, আচরণগত অসুবিধা, ব্যক্তিগত সমস্যা, মানসিক বিপর্যয়, অবসাদগ্রস্ততা ও মাদকাসক্তি মানুষকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয়। আত্মহত্যা মানে ‘সেলফ মার্ডার’। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে পুরুষদের মধ্যে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মহিলাদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি। শিক্ষা ও মটিভেশন কর্মসূচির মাধ্যমে আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি জানান।

চিকিৎসক ও গবেষকরা বলেছেন, এই সব আত্মহত্যার অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। এ জন্য দরকার সচেতনতা, কুসংস্কারকে কাটিয়ে ওটা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। দীর্ঘমেয়াদে আত্মহত্যা প্রবণ ব্যক্তি প্রকাশ্যে বা ইঙ্গিতে কোন না কোন ভাবে তার অন্তর্গত ইচ্ছার কথা কারো না কারো কাছে ব্যক্ত করে। কেউ যদি আত্মহত্যার কথা বলে তবে তা গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। তার সমস্যাটা চিহিৃত করে তাকে সেভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতে হবে। যারা আত্মহত্যা করে তারা যেসব চিঠি বা চিরকুট লিখে যায়, সেগুলো বিশ্লেষন করে দেখা গেছে , তারা মৃত্যুর আগে কিছু নির্দেশ দেয়, এবং চিঠিতে তাদের তীব্র মনোকষ্ট এবং ক্রোধ প্রকাশ পায়। তাই তাদের এ অনুভূতিগুলোকে গুরুত্বের সাথে সমাধানের চেষ্টা চালাতে হবে। তাহলেও অনেক আত্মহত্যার ঘটনাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হলে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, চিকিৎসায় কিছুটা কমে গেলে ব্যক্তি চিকিৎসা ও চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন এবং পরিবারও এ ব্যাপারে আর মনোযোগী হয় না। মনে রাখতে হবে অধিকাংশ মানসিক রোগের চিকিৎসাই দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। উপসর্গ কমে যাওয়ার পর চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে দুরে সরে গেলে পুনরায় উপসর্গ ফিরে আসতে পারে এবং জীবননাশী কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। রোগাক্রান্তদের পাশাপাশি এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে পরিবারকেও। যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের করুণার চোখে না দেখে, তিরস্কার বা খোঁচা না দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যাদের মানসিক চাপে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কম, তাদের যথোপযুক্ত কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে। কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমানো, চিকিৎসকের ব্যবস্থপত্র ছাড়া ঔষূধ বিক্রি বন্ধ করার পাশাপাশি মাদকদ্রব্যের ব্যবহার কমাতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন, ধর্মীয় ও সামাজিক সুস্থ রীতিনীতির চর্চা বাড়াতে হবে। সামাজিক সুস্থ, সুন্দর সম্পর্কগুলোকে লালন করতে হবে, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। জীবনের দু:খ কষ্টময় সময়গুলোকে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা অর্জন, নিজের ও অপরের প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রদর্শন, সমস্যা সমাধানের কার্যকর পন্থার অনুসরণ। এছাড়া সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যপ্ত ঘুম, নিয়মিত শরীরচর্চা, ধুমপান ও মাদকাসক্তি থেকে দুরে থাকা এবং শারীরিক ও মানসিক যে কোন সমস্যার যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের মাধ্যমে আত্মহত্যাকে নির্মূল করা সম্ভব। আসুন সরকার সহ সকলে মিলে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আত্মহত্যাকে নির্মূল করি। এই হোক আমাকের অঙ্গীকার।
পারিবারিক বন্ধন আর ভালবাসা দিয়ে ঘিরে রাখুন আপনার সন্তানকে, সঠিক পথটি বেছে নিতে সব সময় তার পাশে থাকুন। সন্তানকে ভালবেসে এগিয়ে নিন সঠিক পথে।
লেখক: মুহাম্মদ ছানাউল্লাহ
সাংবা‌দিক, কলা‌মিস্ট ও ইউ‌টিউভার
sanaullahcoxs62@gmail.com

267 Views

আরও পড়ুন

আইডিইবির ৫৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আধুনগর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের র‌্যালি ও আলোচনা সভা

দোয়ারাবাজারে এফআইভিডিবি’র স্বাস্থ্য সামগ্রী বিতরণ

বোয়ালখালীর নব যোগদানকৃত শিক্ষা অফিসার হারুন উর রশীদকে বরণ

জামালপুরে মৃত আইনজীবী হলেন অতিরিক্ত জিপি

তানযীমুল উম্মাহ হিফয মাদ্রাসা, সাইনবোর্ড শাখার বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান সম্পন্ন

সাইফুল ইসলামের কবিতা : শীতের আমেজ

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ইসলামি বক্তা আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ

পাবনার হেমায়েতপুরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপে সংঘর্ষ : নিহত ১

কাপাসিয়ায় জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপির বিশাল শোভাযাত্রার আয়োজন

কাপাসিয়ায় ইসলাম শিক্ষা শিক্ষক পরিষদের উদ্যোগে সিরাতুন্নবী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন

কক্সবাজারের ঈদগাহতে ফুলকুঁড়ি আসরের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন

জবিস্থ শরীয়তপুর জেলা ছাত্রকল্যাণের নেতৃত্বে সৌরভ – মনির