ঢাকাবুধবার , ২৪ এপ্রিল ২০২৪
  1. সর্বশেষ

ভর্তি যুদ্ধ ও বর্তমান অনুভূতি

প্রতিবেদক
নিউজ এডিটর
১৯ মার্চ ২০২৩, ৪:০৮ অপরাহ্ণ

Link Copied!

——–
যে দিন আমার উচ্চ মাধ্যমিকের শেষ পরীক্ষা ছিল তখনও জানতাম না আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব । এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চিন্তা মাথাতেও আসেনি । পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু’দিন পর মামা কল করে বললেন, তোমাকে বাইরে আসতে হবে । বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতির জন্য । অমান্য করার ফুসরত পাইনি বলব না, অমান্য করতে চাইনি ।

ছয় দিনের মাথায় চলে আসলাম রংপুরে । একটা প্রাইভেট ক্লাশ করতাম । না বুঝেই প্রথমে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে । চলতে থাকলাম । কিন্তু প্রস্তুতিতে কিছু ত্রুটি থাকায় আমি চরমভাবে ব্যর্থ হই ‌। কিছুটা ভেঙে পরেছিলাম। যার ধাক্কাটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাতেও লাগে । ফলে দ্বিতীয় ধাপে দেখা স্বপ্ন টাও ধুলিসাৎ হতে ভুল করেনি । একরকম হতাশা সত্ত্বেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এ পরীক্ষা দিলাম । একটা ইউনিটে ভালো করেও একটা ইচ্ছাকৃত ভুলের কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়ে ওঠেনি ।

সর্বশেষ গুচ্ছ ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে অংশ নেই । ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগর পর্যন্ত একধারে একরকম অকৃতকার্য হয়ে শেষ ভরসা গুচ্ছতে । গুচ্ছে যখন মোটামুটি একটা রেজাল্ট আসলে তখন স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে । গুচ্ছ প্রক্রিয়াগত কিছু কারণে সেটাও হয়ে উঠল না । বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর এ ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলাম । আমার এই পুরো ভর্তি যুদ্ধে এরকম প্রতিটা সেক্টরে ব্যর্থ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না । কারণ এর জন্য আমার পূর্ব পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি ছিল না । প্রস্তুতি নিতে এসে আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করি । যা দেখি তাই ভালো লাগে । তুলনা করে ভালোলাগা আর স্বপ্নকে সম্বল হিসেবে নিয়ে যদি আমি আগেই গন্তব্য ঠিক করতে পারতাম তাহলে হয়তো এক ধাক্কাতেই হয়ে যেত । তবে ভর্তি যুদ্ধের এই তিক্ত অভিজ্ঞতার পরেও আমি বলবো, এখন আমি আমার নিজস্ব ক্যাম্পাস নিয়ে অনেক আনন্দিত! অনেক আবেগাপ্লুত!!

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পেছনে আমার আগে থেকে কোন স্বপ্ন ছিল না‌ । তাই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি গতানুগতিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতই ভেবেছিলাম । আমার মনে হতো প্রাইমারি, হাই-স্কুল এরপরে কলেজ যেরকম ধারাবাহিকতা, ইউনিভার্সিটি সেরকমই কিছু একটা হবে । হয়তো উচ্চ মাধ্যমিক পরবর্তী উচ্চ শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ । কিন্তু ক্যাম্পাসে আসার পর আমার এই সেকেলে ধারনার সম্পূর্ণ ইতি ঘটেছে । আমি আশ্চর্যিত! আমি কৃতজ্ঞ! সবার প্রতিই ।

এখন আমার কাছে মনে হয়, কেউ যদি পড়াশোনার আনন্দ অনুভব করতে চায়, কিংবা নিজেকে জানার একটা পরিপূর্ণ সুযোগ দিতে চায় তাহলে তাকে অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করতে হবে । আমি যে সত্যি টা স্বীকার করব সেটা হল, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগের স্বপ্ন বা প্রত্যাশা যেমন ছিল, ক্যাম্পাসে আসার পরে সেই ইচ্ছা বা স্বপ্নের সাথে বিস্তার পার্থক্য তৈরি হয়েছে ‌। আমার কাছে মনে হয়, আমি যে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছি সেই স্বপ্নটি এখন এক আকাশ সমান হয়েছে । বন্ধুরা এবং ক্যাম্পাসের পরিবেশ মূলত এই স্বপ্নের পথের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ।

একটা সময় ছিল যেখানে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রতিটি সেক্টরে পাঠ্যপুস্তক এর বাইরে একটি জিনিস ও শেখার ছিল না । ছিল কিন্তু আমার জায়গা থেকে আমার পরিবেশে আমি সেই সুবিধাটা পেতাম না । তখন মূলত সারা বছর একটা প্রস্তুতি ছিল কখন অনুষ্ঠান আসবে, কখন সংস্কৃতিক দিক দিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করার সুযোগ পাবো । প্রতিটি সেক্টরে শিক্ষার উপকরণের একটা সীমাবদ্ধতা নিয়ে বড় হয়েছি । হয়তো ক্লাসরুমটা পর্যাপ্ত পরিমাণ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারত না, তথ্য প্রযুক্তির যুগে এসেও কম্পিউটার শেখার সুযোগ ছিল না বা লাইব্রেরী থাকলেও নিয়ম জনিত কিছু ত্রুটির কারণে সেটাও আমাদের মত সাধারন শিক্ষার্থীদের পক্ষে কাজে লাগানো কঠিন হয়ে পড়ত । এক কথায় প্রান্তিক অঞ্চল গুলোতে মূলত শিক্ষার পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি এখনো । আমার ক্ষেত্রেও একই সিমাবদ্ধতা টা ছিল ।

এখন আমি একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী । আর কিছু পাই বা না পাই, আমি এটা দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারবো যে, এখন আমি নিজেকে জানার, তুলনা করার পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগ পেয়েছি । সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আত্ম উন্নয়নমূলক সংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় চিন্তাধারায় সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে অসংখ্য সংগঠনের পদচারণা রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে । রয়েছে লাইব্রেরী, রয়েছে কম্পিউটার ল্যাব, রয়েছে ক্লাসে উন্নত তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের পর্যাপ্ত সুযোগ । এক কথায় যেটা বলব যে, আমাকে পুরো পৃথিবী হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমার নিজের পক্ষে যতটা সম্ভব আমি লুফে নিতে পারব । নিজেকে জানার, জানানোর ও সমৃদ্ধ করার সকল সুযোগ এখানে প্রস্তুত করে রাখা আছে । আমার শুধু সংগ্রহ করে নেয়ার পালা ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুঃ

বন্ধুদের কথা আর কি বলব । বন্ধু এমন একটা জিনিস যা ছাড়া জীবনকে অসম্পূর্ণ বলবো আমি । একটা সময় ‘কলিজার বন্ধু ‘ আত্মার বন্ধু’ এ ধরনের কিছু কথা আমাকে বিরক্তিকর অনুভূতি দিত । কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সহপাঠীদের সাথে মিশে বন্ধুত্বের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পেরেছি । দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের ভেতর থেকে আমরা একত্রিত হয়েছি এক পরিবারে আবদ্ধ হয়েছি । অন্যের সংস্কৃতিকে জানার, আমার দেশের সংস্কৃতির ব্যাপকতা সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য এ যেন এক বিশাল সুযোগ । আমি অন্যদের জানতেছি, অন্যেরা আমাকে জানতেছে‌ । বন্ধুদের উদ্দেশ্যে আমার একটাই বলার, “তোরা সবসময় পাশে থাকবি । তোরা না থাকলে জীবনের একটা অংশ অপরিপূর্ণ থাকবে ।” ইতিমধ্যে আমরা কয়েকটা জায়গায় সবাই মিলে একসাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম । আমাদের ভ্রমণ গুলো আমাদের আনন্দদানের পাশাপাশি একে অপরকে চেনার, কাছে আসার বিশাল সুযোগ দিয়েছে । শুধু নিজের সহপাঠীদের সাথেই নয়, বিভাগের সিনিয়র ভাই-বোনদের সাথেও একটা সুসম্পর্ক এখানে স্হাপন করা যায,

অনেকেই করেছি । প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে থাকাকালীন সময়ে আমরা এই পারস্পরিক যোগাযোগকে এতটা গুরুত্ব দেই না, দিতাম না । কিন্তু আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চলে আসছি, পরস্পরের সাথে একটা ভালো যোগাযোগ রাখার মাধ্যমে একটা মধুর সম্পর্ক যে গঠন করা যায় এটা ইউনিভার্সিটি তে না আসলে বুঝতামই না । সবার সাথে ভালো যোগাযোগ রাখা যে একটা দক্ষতা, এটা যে একটা সম্পদ এই সত্যটা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেই উপলব্ধি করতে পেরেছি ।

স্বপ্ন নিয়েঃ

সর্বশেষ আসি স্বপ্ন পূরণের পথের যাত্রা নিয়ে । আমরা যারা এখানে এসেছি প্রত্যেকের ভেতরে কিছু মৌলিক গুণাবলী আছে, সুপ্ত প্রতিভা আছে । সেই প্রতিভার বিকাশ, নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া, দেশ এবং জাতির সেবা করার এই বিশাল দায়িত্বটা আমাদের সর্বদাই তাড়না দেয় সামনে এগিয়ে যাওয়ার । আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যারেরা সব সময় বলেন, তোমরা এখানে এসেছ তোমাদের পেছনে দেশের ১৬ কোটি মানুষের ঋণ রয়েছে । নিজেকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে, দেশের সেবা করার মাধ্যমে সে ঋন তোমাদেরকে শোধ করতেই হবে । প্রত্যেকের পেছনেই বাবা-মা, ভাই-বোন সবার স্বপ্ন জড়িয়ে আছে । এখানে আমার একার জয়ী হওয়ার অর্থ আমার পরিবার জয়ী হওয়া, আমার বাবার শ্রমের জয়ী হওয়া ‌। মায়ের শত অশ্রুর জয়ী হওয়া ।

নতুন ক্যাম্পাস, পরিবেশ, নতুন একটা জীবন, একটা নতুন পথের যাত্রা । সকলের এই যাত্রা শুভ হোক । আনন্দময় হোক । ভাগ্য মোদের সহায় হোক, শুভ হোক আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশের এক ঝাঁক কারিগরদের নতুন এই পথযাত্রা । এদের দাঁড়াই গঠিত হোক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, গড়ে উঠুক দক্ষিণ এশিয়ার সুইজারল্যান্ড হিসেবে । স্বপ্নের পথে সকলের পথ চলা সহজ হোক ।

মোঃ ফজলুল হক
শিক্ষার্থী,
ইংরেজি বিভাগ ।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

312 Views

আরও পড়ুন