ঢাকাশুক্রবার , ২৯ মার্চ ২০২৪
  1. সর্বশেষ

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার

প্রতিবেদক
নিউজ এডিটর
৯ জানুয়ারি ২০২১, ২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

Link Copied!

২৫ জানুয়ারি ১৯৭তম জন্ম বাষিকী:

☆ জেমস আব্দুর রহিম রানা ☆

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৭তম জন্ম বাষিকী ২৫ জানুয়ারি । তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার। তাঁকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণ্য করা হয়। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলা প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার) সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও তাঁর প্রথমা পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল। মধুসূদনের যখন তেরো বছর বয়স, সেই সময় থেকেই তাঁকে কলকাতায় বসবাস করতে হত। খিদিরপুর সার্কুলার গার্ডেন রিচ রোডে (বর্তমানে কার্ল মার্কস সরণী) অঞ্চলে তিনি এক বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন। মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাঁকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রাম শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। বিদ্বান ইমামের কাছে তিনি বাংলা, ফারসি ও আরবি পড়েছেন। সাগরদাঁড়িতেই মধুসূদনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। তেরো বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি তদনীন্তন হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। মধুসূদন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই অচিরেই কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি. এল. রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। রিচার্ডসন মধুসূদনের মনে কাব্যপ্রীতি সঞ্চারিত করেছিলেন। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগের স্মৃতিও তাঁকে বিশেষ উদ্বুদ্ধ করত। এছাড়া কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আঠারো বছর বয়সেই মহাকবি হওয়ার ও বিলাতে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়।
১৮৪৩ সালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর ওই বছরই ১৩ ফেব্রুয়ারি মিশন রো-তে অবস্থিত ওল্ড মিশন চার্চ নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি। তিনিই তাঁর “মাইকেল” নামকরণ করেন। মধুসূদন পরিচিত হন “মাইকেল মধুসূদন দত্ত” নামে। তাঁর এই ধর্মান্তর সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর ‘‘বিধর্মী’’ পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর মধুসূদন শিবপুরের বিশপস কলেজে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এখানে তিনি গ্রিক, লাতিন, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা শিক্ষা করেন। রাজনারায়ণ দত্ত তাঁকে পরিত্যাগ করলেও, বিশপস কলেজে পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করছিলেন। চার বছর পর তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করেন। বিশপস কলেজে কয়েকজন মাদ্রাজি ছাত্রের সঙ্গে মধুসূদনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। বিশপস কলেজে অধ্যয়ন শেষ করে যখন কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন মধুসূদন। তখন তাঁর সেই মাদ্রাজি বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) চলে যান মধুসূদন। কথিত আছে, আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতসারে নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে সেই টাকায় মাদ্রাজ গিয়েছিলেন তিনি। মধুসূদন মাদ্রাজেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেন নি। স্থানীয় খ্রিষ্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় তিনি একটি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের চাকরি পান। তবে বেতন যা পেতেন, তাতে তাঁর ব্যয়সংকুলান হত না। এই সময় তাই তিনি ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। মাদ্রাজ ক্রনিকল পত্রিকায় ছদ্মনামে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। হিন্দু ক্রনিকল নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই অর্থাভাবে পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে হয়। পঁচিশ বছর বয়সে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি দ্য ক্যাপটিভ লেডি তাঁর প্রথম কাব্যটির রচনা করেন। কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। উভয়ের দাম্পত্যজীবন আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে মধুসূদন এমিলিয়া আঁরিয়েতা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। আঁরিয়েতা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন। এদিকে মাইকেল তাঁর এক কপি দ্য ক্যাপটিভ লেডি বন্ধু গৌরদাস বসাককে উপহার পাঠালে, গৌরদাস সেটিকে জে ই ডি বেথুনের কাছে উপহার হিসেবে পাঠান। উক্ত গ্রন্থ পাঠ করে অভিভূত বেথুন মাইকেলকে চিঠি লিখে দেশে ফিরে আসতে এবং বাংলায় কাব্যরচনা করতে পরামর্শ দেন। ১৮৫৬ সালে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন। পত্নীকে সেই সময় তিনি সঙ্গে আনেন নি। কবি ইংল্যান্ডে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানের আবহাওয়া এবং বর্ণবাদিতার কারণে বেশি দিন ইংল্যান্ডে থাকেন নি। তারপর তিনি ১৮৬০ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে চলে যান। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ ছিল। একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্য তিনি তার আইন বিষয়ে পড়া শেষ করে ভারতে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কখনোই কলকাতায় তাঁর এই লেখাপড়াকে কাজে লাগান নি, উপরন্তু দরিদ্রতার জন্য মৃত্যুবরণ করেন।
মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন বিরচিত ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষ্য নিয়েই তিনি নাটক লেখায় আগ্রহী হয়েছিলেন। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেন দুটি প্রহসন, যথা: ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং পূর্ণাঙ্গ ‘পদ্মাবতী’ নাটক। পদ্মাবতী নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অমিত্রাক্ষরে লেখেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য। এরপর একে একে রচিত হয় ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ (১৮৬১) নামে মহাকাব্য, ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬১), ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতা (১৮৬৬)। মধুসূদন দত্ত তাঁর সাহিত্য জীবনে বিশেষ করে ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের সাহিত্য কর্ম এবং তাঁর জীবন দ্বারা অত্যন্ত বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে ছিলেন। তাঁর মহান সৃষ্টি মেঘনাদ বধ মহাকাব্য প্রকাশ এবং এটি পরিচিত করে তোলা যদিও খুব সহজ ছিল না, তারপরও তিনি নিজেকে মহাকাব্যটির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্রভাব প্রকাশ করেছিলেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি কাব্যে প্রথম হোমেরিক স্টাইলের লেখার প্রবর্তন করেন। তিনি এক সময় নিজেকে বলেছিলেন : “আমি এক সকালে উঠে নিজেকে সফল হিসেবে পাই নি, এই কাব্যের সফলতা বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।”
মাইকেল মধুসূদন দত্ত একাধারে ছিলেন বহু ভাষাবিদ। শিশু কালে গ্রামের টোল থেকে তার ফারসি ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে ভাষা শিক্ষার শুরু হয়। তিনি ইংরেজি ছাড়াও ল্যাটিন, গ্রিক, ফারসি, হিব্রু, তেলেগু, তামিল ইত্যাদি ভাষায় অনায়াসে কথা বলতে পারতেন। তিনি এমনকি ফারসি ও ইতালীয় ভাষায় কবিতাও লিখতে পারতেন। মাতৃভাষা ছাড়া তিনি আরো বারোটি ভাষা জানতেন।
বাংলা নাটকে মাইকেল মধুসূদনের আবির্ভাব আকস্মিক। ১৮৫২ সালে তারাচরণ শিকদার, জে. সি. গুপ্ত ও রামনারায়ণ তর্করত্নের হাত ধরে বাংলায় শৌখিন রঙ্গমঞ্চে নাট্য মঞ্চায়ন শুরু হয়। এই সময় লেখা নাটকগুলির গুণগত মান খুব ভালো ছিল না। ১৮৫৮ সালে পাইকপাড়ার জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী নাটকটি অভিনীত হয়। শিল্পগুণবিবর্জিত এই সাধারণ নাটকটির জন্য জমিদারদের বিপুল অর্থব্যয় ও উৎসাহ দেখে মধুসূদনের শিক্ষিত মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। এরপর তিনি নিজেই নাট্যরচনায় ব্রতী হন। রামনারায়ণ তর্করত্নের সংস্কৃত নাট্যশৈলীর প্রথা ভেঙে তিনি পাশ্চাত্য শৈলীর অনুসরণে প্রথম আধুনিক বাংলা নাটক রচনা করেন।
মাইকেল মধুসূদনের নাট্যচর্চার কাল ও রচিত নাটকের সংখ্যা দুইই সীমিত। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬১ – এই তিন বছর তিনি নাট্যচর্চা করেন। এই সময়ে তাঁর রচিত নাটকগুলি হল : শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০), পদ্মাবতী (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১)। এছাড়া মৃত্যুর পূর্বে মায়াকানন (১৮৭৪) নামে একটি অসমাপ্ত নাটক।
শর্মিষ্ঠা একটি পৌরাণিক নাটক। রচনাকাল ১৮৫৯। এটিই আধুনিক পাশ্চাত্য শৈলীতে রচিত প্রথম বাংলা নাটক। নাটকের আখ্যানবস্তু মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত রাজা যযাতি, শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীর ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী থেকে গৃহীত। অবশ্য পাশ্চাত্য নাট্যশৈলীতে লিখলেও, মাইকেল এই নাটকে সংস্কৃত শৈলীকে সম্পূর্ণ বর্জন করেন নি। এই নাটকের কাব্য ও অলংকার-বহুল দীর্ঘ সংলাপ, ঘটনার বর্ণনাত্মক রীতি, প্রবেশক, নটী, বিদুষক প্রভৃতির ব্যবহার সংস্কৃত শৈলীর অনুরূপ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের রোম্যান্টিক ধারার প্রভাবও এই নাটকে স্পষ্ট। প্রথম রচনা হিসেবে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও, সেই যুগের ইংরেজি-শিক্ষিত পাঠকসমাজে এই নাটকটি খুবই সমাদৃত হয়। বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে নাটকটি অভিনীতও হয়।
শর্মিষ্ঠার পরে ১৮৬০ সালে মাইকেল রচনা করেন একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নামে দুটি প্রহসন। এই প্রহসন দুটি তাঁর দুটি শ্রেষ্ঠ নাট্যরচনা। প্রথম নাটকটির বিষয় ছিল ইংরেজি শিক্ষিত নব্য বাবু সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা ও দ্বিতীয়টির বিষয় ছিল সনাতনপন্থী সমাজপতিদের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন। এই নাটকে মাইকেলের পর্যবেক্ষণ শক্তি, সমাজবাস্তবতাবোধ ও কাহিনী, চরিত্র ও সংলাপ রচনায় কুশলতা বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। কিন্তু নাটকের বিষয়বস্তু নব্য ও সনাতনপন্থী উভয় সমাজকেই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তাই বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে নাটকটি অভিনীত হওয়ার কথা থাকলেও, শেষপর্যন্ত তা হয় নি। এতে মাইকেল খুবই হতাশ হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে প্রহসন রচনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন।
১৮৬০ সালেই মধুসূদন রচনা করেন পদ্মাবতী নাটকটি। এটিও পৌরাণিক নাটক। তবে এই নাটকের ভিত্তি পুরোপুরি ভারতীয় পুরাণ নয়। গ্রিক পুরাণের ‘অ্যাপেল অফ ডিসকর্ড’ গল্পটি ভারতীয় পুরাণের মোড়কে পরিবেশন করেছেন মধুসূদন। গ্রিক পুরাণের জুনো, প্যালাস ও ভেনাস এই নাটকে হয়েছেন শচী, মুরজা ও রতি। হেলেন ও প্যারিস হয়েছেন পদ্মাবতী ও ইন্দ্রনীল। তিন দেবীর মধ্যে রতিকে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নির্বাচিত করলে অন্য দুই দেবী ইন্দ্রনীলের প্রতি রুষ্টা হন এবং ইন্দ্রনীলের জীবনে বিপর্যয় নামিয়ে আনেন। শেষে রতি ও ভগবতীর চেষ্টায় ইন্দ্রনীল উদ্ধার পান এবং বিচ্ছিন্না স্ত্রী পদ্মাবতীর সঙ্গে তাঁর মিলন ঘটে। মূল গ্রিক উপাখ্যানটি বিয়োগান্তক হলেও, মাইকেল এই নাটকটিকে ইংরেজি ট্র্যাজি-কমেডির ধাঁচে করেছেন মিলনান্তক। এই নাটকে সংস্কৃত নাট্যরীতির প্রভাব অল্পই। প্লট-নির্মাণ, নাটকীয় দ্বন্দ্ব উপস্থাপনা ও চরিত্র চিত্রণে মাইকেল এখানে আগের থেকে পরিণত হয়েছেন।
কৃষ্ণকুমারী নাটক রচনার পর মাইকেল কাব্যরচনায় পুরোদমে মনোনিবেশ করেন। শেষ জীবনে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের কর্ণধার শরচ্চন্দ্র ঘোষের অনুরোধে তিনি মায়াকানন নাটকটি রচনায় হাত দেন। নাটকটি তিনি শেষ করতে পারেন নি। করেছিলেন ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এই নাটকটির শিল্পমূল্য বিশেষ নেই। মাইকেলের সৃষ্টিপ্রতিভার কোনো সাক্ষর এতে পাওয়া যায় না।
মধুসূদন দত্তের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে — অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণ উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য নামক মহাকাব্যটি। চরিত্র-চিত্র হিসেবে রয়েছেন : রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, সীতা, সরমা, প্রমীলা প্রমুখ। তিনি তাঁর কাব্যকে অষ্টাধিক সর্গে বিভক্ত করেছেন এবং সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী এতে নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা, যুদ্ধ, মন্ত্রণা প্রভৃতির সমাবেশও করেছেন। কিন্তু সর্গান্তে তিনি নতুন ছন্দ ব্যবহার করেন নি, সর্গশেষে পরবর্তী সর্গকথা আভাসিত করেন নি। যদিও তিনি বলেছিলেন,
“ গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত ”
তবুও কাব্যে করুণ রসেরই জয় হয়েছে। মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণ-আহৃত কাহিনীর পুণরাবৃত্তি নয় — এটি নবজাগ্রত বাঙালির দৃষ্টি নিয়তি-লাঞ্ছিত নবমানবতাবোধের সকরুণ মহাকাব্যের রূপে অপূর্ব গীতি-কাব্য। মেঘনাদবধ কাব্য এ দিক দিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে একক সৃষ্টি।
মধুসূদন অতি আশ্চর্য্যজনকভাবে নির্মাণ-কুশলতা গুণে মহাকাব্যোচিত কাব্য-বিগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। এ কাব্যের তাৎপর্য রাবণ-চরিত্রের প্রতীকতায়। তাঁর সৃষ্ট রাবণ চরিত্রে পরম দাম্ভিকতা প্রকট হয়ে উঠে নি। রামায়ণকে তিনি তাঁর মানবতার আলোকে বিধৌত করে যে মহাকাব্য রচনা করেছেন, তা আসলে রোমান্টিক মহাকাব্য। এ কারণে আকারে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মহাকাব্যোচিত হলেও, এর প্রাণ-নন্দিনী সম্পূর্ণ রোমান্টিক এবং মধুসূদন এ কাব্যে জীবনের যে জয়গান করেছেন, তা বীররসের নয়, কারুণ্যের। কবি তাই, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “ সমুদ্রতীরের শ্মশানে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন। ”
বাংলা সাহিত্যে পত্রাকার কাব্যরচনা প্রথম দেখা যায় বীরাঙ্গনা কাব্যে। ১৮৬২ সালে এই গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়। দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, সোমের প্রতি তারা, দ্বারকনাথের প্রতি রুক্মিণী, দশরথের প্রতি কৈকয়ী, লক্ষ্মণের প্রতি সূপর্ণখা, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা, শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী, পুরুবার প্রতি উর্বশী, নীলধ্বজের প্রতি জনা— এই ১১টি পত্ররূপী কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি রচিত। মধুসূদন তাঁর কাব্যে এই নারীদের পুরাণ-পরিচিতির মূলে আঘাত করেছেন। তিনি মানবিক অনুভূতির আলোকে নারী-হৃদয়ের কথকতায় ব্যক্ত করিয়েছেন।
মাদ্রাজে গিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের চেয়েও কবি যে বিশেষ কাজটি করেছিলেন তা হচ্ছে এক শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করা। মাদ্রাজে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি রেবেকা ম্যাকটাভিশ নামক এক ইংরেজ যুবতীকে বিয়ে করেন। অরফান আস্যাইলাম স্কুলে পড়াতে শুরু করার পরই পরিচয় হয় তাঁর ভাবী স্ত্রী রেবেকার সাথে। বিয়ের এই প্রক্রিয়াটি অবশ্য খুব সহজ ছিল না। তাঁর বন্ধু গৌরি দাশকে লিখেছিলেন””রেবেকাকে পেতে খুব ঝামেলা হয়েছিল, বুঝতেই তো পারছো তার(রেবেকা) সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিল”” তাদের বিয়ে সম্পাদন হয় ৩১ জুলাই ১৮৪৮ সালে। বিদেশে গিয়ে রোগ ভোগ করা, চাকরি জোটানো তারপর এই বিদেশিনীকে বিয়ে করা এই সবই হয়েছিল মাদ্রাজ পৌঁছানোর ছ’ মাসের ভিতরে। কিন্তু তাদের এই দাম্পত্য জীবন বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। তিনি ভেবেছিলেন বিয়ের পর তার প্রাণের রেবেকাকে সাথে নিয়ে সুখী হবেন। কিন্তু সুখ জিনিসটা বিধাতা হয়ত তাঁর কপালে লিখেন নি। সংসারের নানা ঝঞ্ঝাট, গোলমাল দেখা দিল। মাইকেলের একগুয়েমির কারণে স্ত্রীর মতের সাথে অমিল হতে লাগল। এর ফলে তিনি কয়েক বছরের মধ্যেই রেবেকার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়।
মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে মধুসূদন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের কোনো এক শিক্ষকের কন্যা হেনিরিয়েটা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। হেনিরিয়েটাও সর্বগুণ সম্পন্ন রুচিমার্জিত মেয়ে ছিলেন। হেনিরিয়েটা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন। তাদের নেপোলিয়ান নামক এক ছেলে এবং শর্মিষ্ঠা নাম এক মেয়ে। তাঁর বংশধরদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় লিয়েন্ডার পেজ। মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায়ে তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। তাছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন(অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহাকবি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি তাঁর সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায়। তাঁর সমাধিস্থলে নীচের কবিতাটি লেখা রয়েছে : “
‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম)মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী’’’

☆ এক নজরে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম ও সাহিত্য-সাধনা

২৫ জানুয়ারি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৬তম জন্মবার্ষিকী। ১৮২৪ সালের এইদিনে তিনি যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে জন্ম হলেও মধুসূদন যৌবনে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন নাম গ্রহণ করেন এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণবশত ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন আকৃষ্ট হন নিজের মাতৃভাষার প্রতি। এই সময়েই তিনি বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্যরচনা করতে শুরু করেন।
মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য নামক মহাকাব্য। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি হলো দ্য ক্যাপটিভ লেডি, শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী (নাটক), পদ্মাবতী (নাটক), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, হেকটর বধ [৩]ইত্যাদি। মাইকেলের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যু হয় এই মহাকবির।

প্রারম্ভিক জীবন
——————-
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলা প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার) সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও তাঁর প্রথমা পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল। মধুসূদনের যখন তেরো বছর বয়স, সেই সময় থেকেই তাঁকে কলকাতায় বসবাস করতে হত। খিদিরপুর সার্কুলার গার্ডেন রিচ রোডে (বর্তমানে কার্ল মার্কস সরণী) অঞ্চলে তিনি এক বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন।

শিক্ষাজীবন
————–
মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাঁকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রাম শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। বিদ্বান ইমামের কাছে তিনি বাংলা, ফারসি ও আরবি পড়েছেন। সাগরদাঁড়িতেই মধুসূদনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়।
তেরো বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি তদনীন্তন হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। মধুসূদন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই অচিরেই কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি. এল. রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। রিচার্ডসন মধুসূদনের মনে কাব্যপ্রীতি সঞ্চারিত করেছিলেন। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগের স্মৃতিও তাঁকে বিশেষ উদ্বুদ্ধ করত। এছাড়া কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আঠারো বছর বয়সেই মহাকবি হওয়ার ও বিলাতে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়।
১৮৪৩ সালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর ওই বছরই ১৩ ফেব্রুয়ারি মিশন রো-তে অবস্থিত ওল্ড মিশন চার্চ নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি। তিনিই তাঁর “মাইকেল” নামকরণ করেন। মধুসূদন পরিচিত হন “মাইকেল মধুসূদন দত্ত” নামে। তাঁর এই ধর্মান্তর সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর বিধর্মী পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর মধুসূদন শিবপুরের বিশপস কলেজে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এখানে তিনি গ্রিক, লাতিন, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা শিক্ষা করেন। রাজনারায়ণ দত্ত তাঁকে পরিত্যাগ করলেও, বিশপস কলেজে পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করছিলেন। চার বছর পর তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করেন। বিশপস কলেজে কয়েকজন মাদ্রাজি ছাত্রের সঙ্গে মধুসূদনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। বিশপস কলেজে অধ্যয়ন শেষ করে যখন কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন মধুসূদন। তখন তাঁর সেই মাদ্রাজি বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) চলে যান মধুসূদন। কথিত আছে, আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতসারে নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে সেই টাকায় মাদ্রাজ গিয়েছিলেন তিনি।

কর্মজীবন
———–
মধুসূদন মাদ্রাজেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেননি। স্থানীয় খ্রিষ্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় তিনি একটি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের চাকরি পান। তবে বেতন যা পেতেন, তাতে তাঁর ব্যয়সংকুলান হত না। এই সময় তিনি ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। মাদ্রাজ ক্রনিকল পত্রিকায় ছদ্মনামে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। হিন্দু ক্রনিকল নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই অর্থাভাবে পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে হয়। পঁচিশ বছর বয়সে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি দ্য ক্যাপটিভ লেডি তাঁর প্রথম কাব্যটির রচনা করেন। কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

বৈবাহিক জীবন
——————
মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। উভয়ের দাম্পত্যজীবন আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে মধুসূদন এমিলিয়া আঁরিয়েতা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। আঁরিয়েতা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন। এদিকে মাইকেল তাঁর এক কপি দ্য ক্যাপটিভ লেডি বন্ধু গৌরদাস বসাককে উপহার পাঠালে, গৌরদাস সেটিকে জে ই ডি বেথুনের কাছে উপহার হিসেবে পাঠান। উক্ত গ্রন্থ পাঠ করে অভিভূত বেথুন মাইকেলকে চিঠি লিখে দেশে ফিরে আসতে এবং বাংলায় কাব্যরচনা করতে পরামর্শ দেন। ১৮৫৬ সালে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন।

সাহিত্য জীবন
—————-
মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন বিরচিত ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষ্য নিয়েই তিনি নাটক লেখায় আগ্রহী হয়েছিলেন। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেন দুটি প্রহসন, যথা: ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং পূর্ণাঙ্গ ‘পদ্মাবতী’ নাটক। পদ্মাবতী নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অমিত্রাক্ষরে লেখেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য। এরপর একে একে রচিত হয় ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ (১৮৬১) নামে মহাকাব্য, ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬১), ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতা (১৮৬৬)।

সাহিত্যে অনুপ্রেরণা
———————–
মধুসূদন দত্ত তাঁর সাহিত্য জীবনে বিশেষ করে ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের সাহিত্য কর্ম এবং তাঁর জীবন দ্বারা অত্যন্ত বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে ছিলেন। তাঁর মহান সৃষ্টি মেঘনাদ বধ মহাকাব্য প্রকাশ এবং এটি পরিচিত করে তোলা যদিও খুব সহজ ছিল না, তারপরও তিনি নিজেকে মহাকাব্যটির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্রভাব প্রকাশ করেছিলেন।

ভাষাগত দক্ষতা
——————
মাইকেল মধুসূদন দত্ত একাধারে ছিলেন বহু ভাষাবিদ। শিশু কালে গ্রামের টোল থেকে তার ফারসি শিক্ষার মাধ্যমে ভাষা শিক্ষার শুরু হয়। তিনি ইংরেজি ছাড়াও ল্যাটিন, গ্রিক, ফারসি, হিব্রু, তেলেগু, তামিল ইত্যাদি ভাষায় অনায়াসে কথা বলতে পারতেন। তিনি এমনকি ফারসি ও ইতালীয় ভাষায় কবিতাও লিখতে পারতেন। মাতৃভাষা ছাড়া তিনি আরো বারোটি ভাষা জানতেন।

নাটক
——
বাংলা নাটকে মাইকেল মধুসূদনের আবির্ভাব আকস্মিক। ১৮৫২ সালে তারাচরণ শিকদার, জে. সি. গুপ্ত ও রামনারায়ণ তর্করত্নের হাত ধরে বাংলায় শৌখিন রঙ্গমঞ্চে নাট্য মঞ্চায়ন শুরু হয়। এই সময় লেখা নাটকগুলির গুণগত মান খুব ভালো ছিল না। ১৮৫৮ সালে পাইকপাড়ার জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলীনাটকটি অভিনীত হয়। শিল্পগুণবিবর্জিত এই সাধারণ নাটকটির জন্য জমিদারদের বিপুল অর্থব্যয় ও উৎসাহ দেখে মধুসূদনের শিক্ষিত মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। এরপর তিনি নিজেই নাট্যরচনায় ব্রতী হন। রামনারায়ণ তর্করত্নের সংস্কৃত নাট্যশৈলীর প্রথা ভেঙে তিনি পাশ্চাত্য শৈলীর অনুসরণে প্রথম আধুনিক বাংলা নাটক রচনা করেন।
মাইকেল মধুসূদনের নাট্যচর্চার কাল ও রচিত নাটকের সংখ্যা দুইই সীমিত। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬১ – এই তিন বছর তিনি নাট্যচর্চা করেন। এই সময়ে তাঁর রচিত নাটকগুলি হল : শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ইত্যাদি।

শিক্ষক হিসেবে মধুসুদন

শিক্ষকতার মতো মহান পেশা নিয়েই শুরু হয়েছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কর্মজীবন। কবি হিসেবে তিনি মেধাবী ও শক্তিমান ছিলেন; শিক্ষক হিসেবেও তার কৃতিত্ব কম নয়। ভালো ইংরেজি জানতেন তিনি। শুধু ‘ভালো’ বিশেষণটা ব্যবহার করলে অবিচার করা হবে; তার সময়ে তার মতো ভালো ইংরেজি জানা বাঙালীর সংখ্যা ছিল নগন্য। তবে স্কুলে তাকে শুধু ইংরেজি পড়াতে হতো না। তাকে ইতিহাস, ভূগোল, ভাষা সাহিত্যসহ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বাইবেলও পড়াতে হতো।

১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে মধুসূদন কলকাতার বিশপস কলেজ ছেড়ে ভাগ্যোন্বেষণে মাদ্রাজ রওনা হন। কুড়ি দিন সমুদ্রপথে অবস্থানের পর ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি মাদ্রাজ উপকূলে পৌঁছান তিনি। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে অথবা মার্চ মাসের প্রথম দিকে মাদ্রাজ শহরে অবস্থিত মাদ্রাজ মেল অরফ্যান অ্যাসাইলাম ১ স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন মধুসূদন।

সে সময়ে মাদ্রাজে বাঙালিদের বসবাস কম ছিল। খ্রিষ্টান মধুসূদন এখানকার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। বিশপস কলেজে তার বন্ধু এগবার্ট কেনেট আগেই মাদ্রাজে ফিরে এসেছিলেন। মধুসূদন বিশপ হতে চেয়েছিলেন। কলকাতা অবস্থানকালে মাদ্রাজের একজন বিশপের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। যে বিশপ তাকে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন। এই বিশপের ওপর ভরসা করেই মধুসূদন মাদ্রাজ আসেন। কিন্তু মধুসূদনের ধর্মীয় চেতনা সম্পর্কে বিশপদের ধারণা খুব উঁচু ছিল না। তারা মধুসূদনের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে যে অধিক আগ্রহ দেখেছেন, তা একমাত্র নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য, এটা তারা বুঝতে পেরেছিলেন। অধ্যাপক স্ট্রিটের কথায় ’এ এক আত্মপ্রবঞ্চিত মধুসূদন।’ তাই মাদ্রাজের বিশপরা তাকে যাজক হওয়া বা অন্য কোনো চাকরির ব্যাপারে খুব সাহায্য করেননি, এটা স্পষ্ট। তবে কে তাকে সাহায্য করেছিলেন স্কুলের চাকরির জন্য? গবেষক গোলাম মুরশিদ জানিয়েছেন…
‘তার মাদ্রাজ যাওয়ার কথা তিনি দু-তিন জনকে বলেছিলেন। এই দু-তিন জনের মধ্যে একজন ছিলেন মি. টমাস ডিয়ালট্রি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও মাদ্রাজের বিশপ তাকে সাহায্য করেছিলেন বলে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবে তিনি সেখানে সাহায্য পেয়েছিলেন অন্য সূত্র থেকে, কেনেট পরিবার থেকে। এগবার্ট কেনেট তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাইকেলকে কোনো চাকরি দেওয়ার সম্ভব হবে কিনা, এ নিয়ে এগবার্ট এবং তার পিতার মধ্যে আগেই আলাপ হয়েছিল। এ প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এগবার্ট কেনেটের পিতা চার্লস কেনেট ছিলেন অরফ্যান অ্যাসাইলামের সেক্রেটারি। মাইকেল এই অ্যাসাইলামের বয়েজ স্কুলের ‘আশার’ অর্থাৎ সহকারী শিক্ষকের চাকরি পেয়েছিলেন। মাইকেলের চাকরি নিতান্ত সাধারণ এবং তার বেতন অথবা সম্মান কোনোটাই স্পর্ধা করার মতো নয়। কিন্তু একটা অপরিচিত জায়গায় কোনোমতে মাথা গোঁজার ব্যাপারে পরিবেশ তার জন্যে বেশ অনুকূলে ছিল। অনুকূল ছিল না তার ভাগ্য। তিনি সেখানে গিয়ে স্থির হয়ে বসতে না বসতেই তার বসন্ত হয়েছিল। তখন যে অপরিচিত বিভূঁইয়ে কপর্দকহীন অবস্থায় মারা যাননি, তা থেকেও পূর্ব পরিচিতদের সাহায্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।’২ গোলাম মুরশিদ মাদ্রাজে মধুসূদনের প্রতিষ্ঠায় তার বন্ধু কেনেটের যে অবদানের কথা বলেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কেননা মধুসূদন মাদ্রাজ থেকে বন্ধু গৌরদাস বসাককে চিঠিতে জানিয়েছেন, ‘এখানে (মাদ্রাজে) এসে পৌঁছানোর পর থেকে একটু দাঁড়াবার জায়গা খোঁজ করবার জন্য আমাকে অনেক প্রকার চেষ্টা করতে হয়েছে। এ কথা মনে রেখ, একজন স্বজনহীন অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির পক্ষে এ কাজ খুব সহজ নয়। যা হোক ধন্যবাদ ঈশ্বরকে, আমার দুর্দশা কিছুটা দূর হয়েছে। এখন আমি নিজেকে এভাবে ভাবতে শুরু করেছি যে, আমি যেন একটা জাহাজের কর্ণধার, যে ভীষণ ঝড়-ঝঞ্ঝার পরে কিছুটা নিরাপদ আশ্রয়ে নোঙর ফেলতে পেরেছে।’৩
মাদ্রাজ পৌঁছানোর এক বছর পর বন্ধুকে লেখা এ চিঠি থেকে বুঝা যায়, মাথা গোঁজার মতো একটু ঠাঁই খুঁজে পেতে মধুসূদনকে কম কষ্ট করতে হয়নি। তিনি যখন নিজেকে বলেন ‘সজনহীন’ তখন বন্ধু এগবার্ট কেনেট পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বলে মনে হয় না। নিজেকে খ্রিষ্টান ও বিশপস কলেজের ছাত্র পরিচয় দিয়ে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে শিক্ষক হয়েছিলেন। সেখানে কেনেটের যদি কোনো অবদান থাকে, তা নিতান্তই গৌণ।
১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম ভাগে মধুসূদন যখন অ্যাসাইলাম স্কুলের শিক্ষক নিযুক্ত হন, তখন স্কুল থেকে বিদায় নিচ্ছেন সেখানকার একমাত্র শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক জে সি রে নেইলর। তার বিদায়ে শূন্যপদে অভিষিক্ত হন মধুসূদন। তবে মধুসূদনকে তারা প্রধান শিক্ষক হিসেবে নয়, নিয়োগ দিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে। বেতন নির্ধারিত হলো মাত্র ৪৬ টাকা, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি নয় বলে জানিয়েছেন মধুসূদনের জীবনীকারগণ। মধুসূদন নিজেই জানিয়েছেন ‘গরীব স্কুলের সামান্য একজন শিক্ষক।’ তারপরও সেই সময়ের তুলনায় এ বেতন একদম কম নয়। জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট হলেও মধুসূদনের মতো উদারহস্ত মানুষের কাছে প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি নয়। বেতন সামান্য হলেও মধুসূদনকে চাকচিক্যময় ইউরোপীয় পোশাক পরতে হতো। মধুসূদন বলেছেন ‘তাকে একজন ট্যাঁশ ফিরিঙ্গি বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।’ স্কুলের বিধি-বিধান সব কিছুই ছিল ইউরোপীয়। স্কুলের সব ছাত্র ইউরোপীয় ও ইস্ট-ইন্ডীয়। মধুসূদন একমাত্র বাঙালী, যিনি অ্যাসাইলাম স্কুলের শিক্ষক। স্কুল কর্তৃপক্ষ একজন কৃষ্ণকায় বাঙালীকে কেন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলেন? ধারণা করি, জে সি রে নেইলরের বিদায় নেওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ ভালো কোনো ইউরোপীয় শিক্ষক খুঁজে পাননি অথবা মাত্র ৪৬ টাকায় সব বিষয়ে পাঠদানযোগ্য মধুসূদনের মতো একজন পণ্ডিতকে হাতছাড়া করতে চাননি। মধুসূদনকে ঘিরেই আবর্তিত হতো স্কুলের পাঠসক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম।
জানা যায়, স্কুলে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত বাইবেল, ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি পড়ানোর জন্য একজনের বেশি শিক্ষক ছিলেন না। ছাত্রছাত্রী মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫১ জন। পরবর্তী সময়ে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রীদের পাঠদানের জন্য একজন শিক্ষিকা এবং ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে আর একজন শিক্ষিকাসহ এই অ্যাসাইলামের দুজন প্রাক্তন ছাত্রকে মধুসূদনের সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষকের সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচজন। সুরেশচন্দ্র মৈত্র তাঁর ’মাইকেল মধুসূদন দত্ত : জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, অ্যাসাইলামে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা স্কুল ছিল। মধুসূদন মেল অ্যাসাইলামের শিক্ষক ছিলেন। এর পাশেই ছিল লেডিস ইনস্টিটিউট। মধুসূদনের প্রেমিকা, পরবর্তী সময়ে স্ত্রী রেবেকা ম্যাকটাভিস এই ইনস্টিটিউটের ছাত্রী ছিলেন। গোলাম মুরশিদ তার ’আশার ছলনে ভুলি’ গ্রন্থে জানিয়েছেন- বয়েজ স্কুল হলেও এই স্কুলে মেয়েদের পড়ানো হতো। ফিমেল অরফান অ্যাসাইলামের পরিচালকরা ভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিলেও ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দের আগে মেয়েদের জন্য ভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়নি।

কী পড়ানো হতো অ্যাসাইলাম স্কুলে?

সেখানকার Routine of studies উদ্ধার করা হয়েছে ’আশার ছলনে ভুলি’ গ্রন্থে উদ্ধৃত রুটিনে দেখা যায় ছেলেদের ও মেয়েদের জন্য দুটো শিফট ছিল। ছেলেদের শিফটে পাঁচটি ক্লাস। ছেলেদের প্রথম ক্লাসে পড়ানো হতো Scripture and Scripture History-Catechism With Scripture proofs- English Grammar- English History, Geography with especial reference to India– Use of the Globes- Writing and Arithmetic- Latin- Tamil and Teloogoo. দ্বিতীয় ক্লাসেScripture and Catechism with Scripture proofs- English Grammar-English History- Geography- Writing and Arithmetic-Tamil and Tiloogoo. তৃতীয় ক্লাসে Scripture- Geography and Grammar- Arithmetic- Reading and Spelling –Dictation-Writing.চতুর্থ ক্লাস. Reading and Spelling- Church Catechism-Writing on the Board-Arithmetic (viva voce) আর পঞ্চম ক্লাসে পড়ানো হতো Reading and Spelling-Catechism. ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ক্লাস কম। তাদের ছিল তিনটি ক্লাস। Female Orphan Asylum বিভাগে মেয়েদের প্রথম ক্লাসের Subject ছিল Scripture and Portions committed to Memory- Catechism with Scripture proofs- Scripture History and “Young Churchman Armed”- Grammar- Indian Geography- English and Roman History- Arithmetic- Writing. দ্বিতীয় ক্লাসে Scripture and Scripture Catechism and portions committed to Memory- “Young churchman Armed”- Grammar- Geography- Writing- Arithmetic Reading and Spelling. তৃতীয় ক্লাসে পড়ানো হতো Recitation of Scripture verses- Chureh Catechism with Scripture proofs “Young Churehman Armed”- Grammar- Geography- Writing- Arithmetic and Spelling.

১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের যে পাঠ্যক্রম আমরা পাই তা দেখে অবাক হই। ইংরেজি ভাষার এসব পাঠদান পণ্ডিত মধুসূদনের পক্ষে কঠিন কিছু ছিল না। কঠিন ছিল এতগুলো বিষয় পড়াতে সময়ে কুলিয়ে ওঠা। তারপরও সংবাদপত্রের জন্য লেখালেখি, প্রুফ দেখা এসবের পাশাপাশি মধুসূদনকে কত না পরিশ্রমই করতে হতো! স্কুলের পাঠদানের সময় ছিল সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ছেলেদের। আর মেয়েদের পাঠদানের সময় ছিল দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এ স্কুলে ক্লাসের বাইরে নির্দিষ্ট ওয়ার্কসপে হাতেকলমে ছেলেদের বিভিন্ন কাজকর্ম শেখানো হতো। জুতো সেলাই-তৈরি থেকে চেয়ার-টেবিল তৈরির মতো সব কাজকর্ম শেখাতে হতো। আর মেয়েদের শিখতে হতো সেলাইয়ের কাজ। এসবের জন্য ছিল আলাদা প্রশিক্ষক। ইংরেজি সাহিত্য, ইংল্যান্ড-ইউরোপের ইতিহাস, ভূগোল, বানান শিক্ষা, ব্যাকরণ, তামিল-তেলেগু ভাষাসহ মধুসূদন বাইবেল পড়াতেন। আশ্চর্যের বিষয় বৈ-কি! নব্য খ্রিষ্টান মধুসূদন বাইবেলের শিক্ষক!
স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি মধুসূদন সাংবাদিকতা করতেন। মাদ্রাজে এসে প্রথমে তিনি ‘Madras Circulator’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। এ পত্রিকাসহ মাদ্রাজের বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কবিতা, প্রবন্ধ, উপসম্পাদকীয় লিখতে থাকেন। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাদ্রাজের সাপ্তাহিক ‘Eurasion’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। মাদ্রাজ সার্কুলেটর, এথেনিয়ামসহ বিভিন্ন পত্রিকায় মধুসূদনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখালেখি দেখে এখানকার বিশিষ্ট সংবাদপত্রসেবী মি. অ্যাবলপেন সিমকিন্স মধুসূদনের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাকে পত্রিকায় চাকরি দেন। ইউরেশিয়ান পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে মধুসূদনের কাব্য নাটক ‘Rezia: Empress of Inde’। তার আগে মাদ্রাজ সার্কুলেটর পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় মধুসূদনের প্রথম কাব্য ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘The Captive Ladie’. একজন যোগ্য শিক্ষকের পাশাপাশি কবি ও সাংবাদিক হিসেবে এ সময়ে মধুসূদন মাদ্রাজের সুধী-সমাজে আলোচিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।
এ সময় হিন্দু ক্রনিকাল পত্রিকায় ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের বৈরী আচরণের প্রতিবাদে উপসম্পাদকীয় ‘Mussalmans in India’ লিখে তিনি বিতর্কিত ও আলোচিত হন ব্যাপকভাবে। শুধু মুসলমান সম্প্রদায় নয়, মধুসূদন তার পত্রিকায় বিভিন্ন বর্ণ-বৈষম্যের প্রতিবাদে সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লিখে সমাজে অবহেলিত, দলিত শ্রেণীর পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাজ সার্কুলেটর পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় মাদ্রাজ মেল অ্যাসাইলামের পরিচালকরা তাদের স্কুলের জন্য বিলেত থেকে ইংরেজ শিক্ষক চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। মধুসূদনের মতো একজন ভালো শিক্ষক থাকতে কর্তৃপক্ষের কেন এই প্রচেষ্টা? না কি পত্র-পত্রিকায় ব্রিটিশদের প্রতি বিভিন্ন সমালোচনা, মন্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় তারা নাখোশ হয়েছিলেন? অসম্ভব কিছু নয়। আমরা দেখব, মধুসূদন ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পত্রিকায় শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করেছেন। ইউরোপীয় মহল দ্বারা পরিচালিত অরফ্যান অ্যাসাইলামে চাকরি করে ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, এটা কি করে হয়! এ ছাড়া এমনও হতে পারে, পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে তিনি শেষের দিকে স্কুলের দেখভালে মনোযোগী হতে পারছিলেন না। নতুন ইউরোপীয় শিক্ষক নিয়োগের প্রতিবাদে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ এপ্রিল ‘ইউরেশিয়ান’ পত্রিকায় প্রতিবেদনে বলা হয়-
‘একজন ইউরেশিয়ান শিক্ষকের জায়গায় একজন ইউরোপিয়ান নিয়োগের ঔচিত্য সম্পর্কে আমি শুধু প্রশ্নই করছি না, আমি আপসহীনভাবে এর বিরোধিতা করছি। এ স্কুলটি হলো বিশেষ করে পূর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। তাহলে এই স্কুলের শিক্ষককে একজন ইউরোপিয়ান হতে হবে কেন? যারা চামড়ার রঙের পার্থক্যের কাছে নতি স্বীকারের শোচনীয় ক্রোধের আগুন জ্বালানো অব্যাহত রাখেন সেই অবলুণ্ঠিত মোসাহেবী এবং মানসিক দাসত্বের নিন্দা করার মতো কঠোর ভাষা আমাদের জানা নেই। …এই বিদ্যালয়ের দায়িত্ব যার ওপর অর্পিত রয়েছে, মননশীলতা, প্রতিভা এবং কর্মশক্তির দিক দিয়ে তিনি কোনো ইউরোপিয়ানদের তুলনায় ছোট নন।’৪
প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের নাম ছিল না। এটা সম্পাদকীয় দফতর কর্তৃক লিপিবদ্ধ। তাই এটা যে মধুসূদনের নিজের কথা তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রতিবেদনে তিনি নিজেকে ইউরেশিয়ান৫ বললেন কেন? তিনি তো ইউরেশিয়ান নন! তিনি বাঙালী, না কি খ্রিষ্টান বলে নিজেকে ইউরেশিয়ান ভেবেছেন? প্রতিবেদনের বক্তব্যে বর্ণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিফলিত হয়েছে। মধুসূদন বৈষম্যের শিকার। অ্যাসাইলাম স্কুলে ইউরোপিয়ান ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার ছিল না। ইউরেশিয়ান ছাত্রদের জন্য এটা ছিল নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সেখানে বোধ হয় বাঙালী শিক্ষক মধুসূদন তাদের মনঃতুষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাই নতুন প্রধান শিক্ষক নিয়োগের জন্য তাদের এই প্রচেষ্টা।
শিক্ষক হিসেবে মধুসূদন কেমন ছিলেন, সে বিষয়ে আমরা জানতে পারি। মাদ্রাজ স্কুলের বার্ষিক ফলাফল সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রশংসাসূচক মন্তব্য প্রকাশিত হয়। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মার্চ ‘Madras Christian Herald’ (মাদ্রাজ ক্রিশ্চিয়ান হ্যারল্ড) পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে ‘Very satisfactory’ বলা হয়। বলা হয়- ‘Must have been gratifying to the directors of the institution and to all who take and interest in this excellent charity..’৬ মধুসূদনের একক প্রচেষ্টা ও কর্মশক্তির জোরে অ্যাসাইলাম স্কুলের ফলাফল হয়ে ওঠে আলোচিত ও ঈর্ষণীয় । ‘Satisfactory’ এর সবটুকু মধুসূদনের।
অ্যাসাইলাম স্কুলের চাকরি থেকে অব্যহতি নিয়ে ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে মধুসূদন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তবে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি হতে পারেননি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইস্কুল বিভাগের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণে তার সাংবাদিক জীবনের ছেদ পড়ে এ সময়। স্বাধীনচেতা সাংবাদিক মধুসূদন, শিক্ষক হিসেবে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবেন কিনা, এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। মধুসূদন চেষ্টা করেছিলেন সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতা একই সাথে চালিয়ে যেতে কিন্তু পারেননি। সাংবাদিকতা থেকে বিদায়ের খবরে বিখ্যাত ‘Athenaeum’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়-
‘দেশীয় পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘Madras Hindu Chronicle’ই একমাত্র উঁচুমানের পত্রিকা। কিন্তু পত্রিকাটি এখন বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ পত্রিকার সুযোগ্য সম্পাদক মাইকেল ডাট পরিবেশের চাপে পড়ে মাদ্রাজ (বিশ্ববিদ্যালয়ের) স্কুলের চাকরি নিতে বাধ্য হচ্ছেন। স্কুল বোর্ড বলছে শিক্ষকতার সঙ্গে পত্রিকার কাজ করলে শিক্ষকতার ক্ষতি হবে। এটা ঠিক নয়। আসলে ক্ষতি হবে একটি দেশীয় পত্রিকার।’৭
আমরা জানি, মধুসূদন মাদ্রাজ হিন্দু ক্রনিকাল পত্রিকা ছেড়ে আসার কয়েক মাসের মধ্যে এটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে মধুসূদন যে খ্যাতি সম্মানের আসনে ছিলেন, তার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল শিক্ষক হিসেবে তার খ্যাতি ও সম্মান বেশি ছিল না। তার বেতন ছিল একশত পঞ্চাশ টাকা। আগের বেতন ৪৬ থেকে প্রায় সোয়া তিন গুণ বেশি। প্রথম শিক্ষক বা প্রথম টিউটর হলে পেতেন দুইশত পঞ্চাশ টাকা। আর কলেজের শিক্ষক বা ইন্সপেক্টর হলে বেতন হতো পাঁচশত টাকা। তবে মধুসূদন একটা বড় ধরনের আশা ও প্রত্যাশা বুকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল তিনি ‘Captive Ladie’ এর মতো আলোচিত কাব্যের কবি, একটা উঁচুমানের সংবাদপত্রের সম্পাদক, নামজাদা সাংবাদিক। একটা ভালো জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে রাখবেন। কারণ এ রকম একটা প্রত্যাশার কথা কয়েক বছর আগে যিনি বন্ধুকে জানিয়েছিলেন। মাদ্রাজের এডভোকেট জেনারেল নর্টন ছিলেন তার বন্ধু। যার নামে তিনি তার প্রথম কাব্য ‘Captive Ladie’ উৎসর্গ করেছিলেন। নর্টনের প্রতি কবির প্রত্যাশা ছিল অনেক। তার কথা নিয়ে ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বন্ধু গোরৗদাস বসাককে চিঠিতে জানিয়েছিলেন…

‘এ কথা শুনে তুমি বিস্মিত হবে, সত্যিই বিস্মিত হবে যে, এডভোকেট জেনারেল নর্টন লোক পাঠিয়ে আমাকে খবর দিয়েছেন। আমি আশা করেছিলাম, বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার অধিক সম্মান আমাকে দিয়েছেন এবং এখন যে কাজ করছি তার যে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং আমার সমন্ধে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি জেনেছেন। আমার জন্য বর্তমান পদের চেয়ে অধিক সম্মানজনক ও আর্থিক সুবিধার কোনো সরাসরি কাজের জন্য চেষ্টা করবেন বলে কথাও দিয়েছেন। মনে হয় ঢাকা, বারানসী, হুগলী প্রভৃতি স্থানের মতো এখানে প্রিভিন্সিয়াল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। খুব সম্ভাবনা রয়েছে আমাকে প্রধান শিক্ষক বা ইন্সপেক্টরের পদ দেবার।’৮
প্রত্যাশা অনুযায়ী মধুসূদনের ভাগ্যে খুব সম্মানজনক পদ জোটেনি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক। শিক্ষকতার পদটি সরকারি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই যথাযথ সম্মানজনক না হলেও মধুসূদন ক্ষীণ আশার রশিটা ধরে রেখেছিলেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস থেকে শিক্ষকতার পদ জাতীয়করণ হয়। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তিন বছর চাকরি করে তা তিনি ছেড়ে দেন অথবা তিনি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার অল্প সময়ের মধ্যে তার পদবি জাতীয়করণ হল।
জানি না তিনি কেন চাকরি ছেড়েছিলেন। হয়ত ঘরে স্ত্রী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও মাদ্রাজ স্কুলে তার সহকর্মী জজ হোয়াইটের কন্যা হেনরিয়েটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। এমনও হতে পারে স্কুলে কোনো বৈষম্যের প্রতিবাদে মধূসূদন চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়েও বর্ণ বৈষম্য ছিল। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে এক নিম্নবর্ণের ছাত্র ভর্তি হলে তার প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য শ্রীযুক্ত পিল্লে পদত্যাগ করেছিলেন। মাদ্রাজে এ ধরনের সমাজপতিদের পক্ষে মধুসূদনকে মেনে না নেওয়াই স্বাভাবিক। ৯
স্কুলের চাকরি ছেড়ে মধুসূদন আবার ফিরে আসেন সংবাদপত্র জগতে। ‘Madras Spectator’ দৈনিক পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আগস্ট মাসে তিনি যোগদান করেন। স্কুলের চাকরি ছাড়ার পর চার মাস তাকে বেকার থাকতে হয়েছিল। মধুসূদন শিক্ষক হিসেবে সফল ছিলেন। তার ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীকালে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইস্কুলের সবোর্চ্চ শ্রেণীতে সাহিত্য পড়াতেন তিনি। এ সময়ে একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘National vices and the means to rectify them’. এ প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার এক অবাঙালী ছাত্রটি মথ্থুস্বামী আয়ার প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মথ্থুস্বামী স্কুল ইন্সপেক্টর পদে চাকরি পান। যে চাকরির জন্য মধুসূদনকেও আমরা তদবির করতে দেখি। মথ্থুস্বামী পরবর্তীকালে হাইকোর্টের জর্জ হয়েছিলেন এবং ইংরেজ সরকার কর্তৃক ‘স্যার’ উপাধি অর্জন করেছিলেন। জানা যায় মথ্থুস্বামী সারাজীবনে তার শিক্ষক মধুসূদনের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মধুসূদন মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। এ বছরেই তিনি হুগলী নর্মাল স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।

☆ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কয়েকটি জনপ্রিয় কবিতা ***

***বঙ্গভাষা
(চতুর্দশপদী কবিতাবলী)
———————————————-
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে-
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে॥
———————————————-
***কপোতাক্ষ নদ
(চতুর্দশপদী কবিতাবলী)
———————————————-
সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে |
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে ;
সতত ( যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!—
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে!
আর কি হে হবে দেখা?—যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ-জনের কানে, সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে!

———————————————-
***কবি
(চতুর্দশপদী কবিতাবলী)
———————————————-
কে কবি— কবে কে মোরে? ঘটকালি করি,
শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন,
সেই কি সে যম-দমী? তার শিরোপরি
শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন?
সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী
যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন,
অস্তগামি-ভানু-প্রভা-সদৃশ বিতরি
ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ-কিরণ।
আনন্দ, আক্ষেপ ক্রোধ, যার আজ্ঞা মানে
অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা-বলে;
নন্দন-কানন হতে যে সুজন আনে
পারিজাত কুসুমের রম্য পরিমলে;
মরুভূমে— তুষ্ট হয়ে যাহার ধেয়ানে
বহে জলবতী নদী মৃদু কলকলে!

———————————————-
***কমলে কামিনী
(চতুর্দশপদী কবিতাবলী)
———————————————-
কমলে কামিনী আমি হেরিনু স্বপনে
কালিদহে | বসি বামা শতদল-দলে
( নিশীথে চন্দ্রিমা যথা সরসীর জলে
মনোহরা|) বাম করে সাপটি হেলনে
গজেশে, গ্রাসিছে তারে উগরি সঘনে |
গুঞ্জরিছে অলিপুঞ্জ অন্ধ পরিমলে,
বহিছে দহের বারি মৃদু কলকলে|—
কার না ভোলে রে মনঃ, এ হেন ছলনে!
কবিতা-পঙ্কজ-রবি, শ্রীকবিকঙ্কণ,
ধন্য তুমি বঙ্গভূমে!যশঃ-সুধাদানে
অমর করিলা তোমা অমরকারিণী
বাগ্ দেবী!ভোগিলা দুখ জীবনে, ব্রাহ্মণ,
এবে কে না পূজে তোমা, মজি তব গানে?—-
বঙ্গ-হৃদ-হ্রদে চণ্ডী কমলে কামিনী||

———————————————-
***অন্নপূর্ণার ঝাঁপি
(চতুর্দশপদী কবিতাবলী)
———————————————-
মোহিনী-রূপসী-বেশে ঝাঁপি কাঁখে করি,
পশিছেন, ভবানন্দ, দেখ তব ঘরে
অন্নদা!বহিছে শূন্যে সঙ্গীত-লহরী,
অদৃশ্যে অপ্সরাচয় নাচিছে অম্বরে|—-
দেবীর প্রসাদে তোমা রাজপদে বরি,
রাজাসন, রাজছত্র, দেবেন সত্বরে
রাজলক্ষ্মী; ধন-স্রোতে তব ভাগ্যতরি
ভাসিবে অনেক দিন, জননীর বরে|
কিন্তু চিরস্থায়ী অর্থ নহে এ সংসারে;
চঞ্চলা ধনদা রমা, ধনও চঞ্চল;
তবু কি সংশয় তব, জিজ্ঞাসি তোমারে?
তব বংশ-যশঃ-ঝাঁপি—- অন্নদামঙ্গল—
যতনে রাখিবে বঙ্গ মনের ভাণ্ডারে,
রাখে যথা সুধামৃতে চন্দ্রের মণ্ডলে||

———————————————-
***রসাল ও স্বর্ণ-লতিকা
———————————————-
রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে;–
“শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে!
নিদারূণ তিনি অতি;
নাহি দয়া তব প্রতি;
তেঁই ক্ষুদ্র-কায়া করি সৃজিলা তোমারে|
মলয় বহিলে, হায়,
নতশিরা তুমি তায়,
মধুকর-ভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;
হিমাদ্রি সদৃশ আমি,
বন-বৃক্ষ-কুল-স্বামী,
মেঘলোকে উঠে শির আকাশ ভেদিয়া!
কালাগ্নির মত তপ্ত তপন তাপন,—
আমি কি লো ডরাই কখন?
দূরে রাখি গাভী-দলে,
রাখাল আমার তলে
বিরাম লভয়ে অনুক্ষণ,–
শুন, ধনি, রাজ-কাজ দরিদ্র পালন!
আমার প্রসাদ ভুঞ্জে পথ-গামী জন|
কেহ অন্ন রাঁধি খায়
কেহ পড়ি নিদ্রা যায়
এ রাজ চরণে|
শীতলিয়া মোর ডরে
সদা আসি সেবা করে
মোর অতিথির হেথা আপনি পবন!
মধু-মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভুবনে!
তুমি কি তা জান না, ললনে?
দেখ মোর ডাল-রাশি,
কত পাখী বাঁধে আসি
বাসা এ আগারে!
ধন্য মোর জনম সংসারে!
কিন্তু তব দুখ দেখি নিত্য আমি দুখী;
নিন্দ বিধাতায় তুমি, নিন্দ, বিধুমুখি!”
যুদ্ধার্থ গম্ঙীরতার বাণী তব পানে!
সুধা-আশে আসে অলি,
দিলে সুধা যায় চলি,—
কে কোথা কবে গো দুখী সখার মিলনে?
“ক্ষুদ্র-মতি তুমি অতি”
রাগি কহে তরুপতি,
“নাহি কিছু অভিমান? ধিক্ চন্দ্রাননে!”
নীরবিলা তরুরাজ; উড়িল গগনে
যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীর স্বননে;
আইলেন প্রভঞ্জন,
সিংহনাদ করি ঘন,
যথা ভীম ভীমসেন কৌরব-সমরে|
আইল খাইতে মেঘ দৈত্যকুল রড়ে:
ঐরাবত পিঠে চড়ি
রাগে দাঁত কড়মড়ি,
ছাড়িলেন বজ্র ইন্দ্র কড় কড় কড়ে!
ঊরু ভাঙ্গি কুরুরাজে বধিলা যেমতি
ভীম যোধপতি;
মহাঘাতে মড়মড়ি
রসাল ভূতলে পড়ি,
হায়, বায়ুবলে
হারাইলা আয়ু-সহ দর্প বনস্থলে!
ঊর্দ্দ্বশির যদি তুমি কুল মান ধনে;
করিও না ঘৃণা তবু নীচশির জনে!
এই উপদেশ কবি দিলা এ কৌশলে||

———————————————-
***সমাধী-লিপি
———————————————-
দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতী
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী!

[স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যুর তিন দিন পরেই কলকাতা জেনারেল হাসপাতালে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পরলোক গমন করেন। তাঁকে কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোড ক্রিশ্চিয়ান সেমেটারীতে সমাহিত করা হয়।তাঁর বিখ্যাত সমাধী-লিপি তিনি নিজেই লিখে গিয়েছিলেন।]

———————————————-
***ঈশ্বরী পাটনী
(চতুর্দশপদী কবিতাবলী)
———————————————-

“সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী |”
-অন্নদামঙ্গল |

কে তোর তরিতে বসি, ঈশ্বরী পাটনি?
ছলিতে তোরে রে যদি কামিনী কমলে,—
কোথা করী, বাম করে ধরি যারে বলে,
উগরি, গ্রাসিল পুনঃ পূর্ব্বে সুবদনী?
রূপের খনিতে আর আছে কি রে মণি
এর সম? চেয়ে দেখ, পদ-ছায়া-ছলে,–
কনক কমল ফুল্ল এ নদীর জলে—
কোন্ দেবতারে পূজি, পেলি এ রমণী?
কাঠের সেঁউতি তোর, পদ-পরশনে
হইতেছে স্বর্ণময়!এ নব যুবতী—
নহে রে সামান্যা নারী, এই লাগে মনে;
বলে বেয়ে নদী-পারে যা রে শীঘ্রগতি|
মেগে নিস্, পার করে, বর-রূপ ধরে
দেখায়ে ভকতি, শোন্, এ মোর যুকতি!

————————————————–
***মেঘনাদ ও বিভিষণ
(মেঘনাদবধ কাব্য থেকে, ষষ্ঠ সর্গের অংশবিশেষ)
————————————————–

“এতক্ষণে”–অরিন্দম কহিলা বিষাদে
“জানিনা কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
একাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ?–শূলী-শম্ভূনিভ
কুম্ভকর্ণ?ভ্রাতৃপুত্র বাসব বিজয়ী?
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য|ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে|”
উত্তরিলা বিভীষণ;–“বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্!রাঘবদাস আমি; কি প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ?” উত্তরিলা কাতরে রাবণি;–
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে!
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে ও কথা, তাত, কহ তা দাসেরে!
স্থপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধুলায়? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন্ মহাকুলে?
কেবা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে ফেলি রাজ হংস পঙ্কজ কাননে;
যায় কি সে কভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী
কবে, হে বীর-কেশরী, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে|
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?
কহ, মহারথি, একি মহারথিপ্রথা?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা! ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া
এখনি! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি!
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের! কি দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে?
নিকুম্ভিলা-যজ্ঞাগারে প্রগল্ ভে পশিল
দম্ভী; আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি নরাধমে|
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পণ করে
বনবাসী! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য? প্রফুল্ল কমলে
কীটবাস? কহ, তাত, সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি,–ভ্রাতৃ পুত্র তব?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?”
মহামন্ত্রবলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে;–
“নহি দোষী আমি, বত্স; বৃথা ভর্ত্স মোরে
তুমি! নিজ কর্ম দোষে হায় মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি!
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কা পুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কাল-সলিলে!
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি! পরদোষে কে চাহে মজিতে?”
রুষিলা বাসবত্রাস! গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী;–“ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি;–কোন্ ধর্মমতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,–এ সকলে দিলা
জলাঞ্জলি? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা!
এ শিক্ষা হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা! হেন সহবাসে,
হে পিতৃব্য, বর্বরত কেন না শিখিবে?
গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি|”

মৃত্যুবরণ
———-
মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায়ে তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেননি। তাছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন (অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহাকবি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি তাঁর সুগভীর ভালবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায়। তাঁর সমাধিস্থলে নীচের কবিতাটি লেখা রয়েছে :

“’দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে!—-”
*****************************************

তথ্য নির্দেশ ও উল্লেখপঞ্জি :

১. জীবনীকারগণ উল্লেখ করেছেন মধুসূদনের স্কুলের নাম ছিল ‘মাদ্রাজ মেল অরফান অ্যাসাইলাম।’ কিন্তু সে স্কুলের পূর্ণ নাম ছিল ‘মাদ্রাজ মেল অ্যাসাইলাম ফর দ্য চিলড্রেন অব ইউরোপিয়ানস এন্ড দেয়ার ডিসেনডানস।’ স্কুলের রুটিনে লেখা আছে, ‘মেল অরফান অ্যাসাইলাম এন্ড ফ্রি ডে স্কুল ফর বয়েজ।’ ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ মার্চ লেখা একটি চিঠিতে মধুসূদন তার বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিখেছিলেন-‘আমি একটি গরীব স্কুলের সামান্য একজন শিক্ষক। যার নাম ‘মাদ্রাজ মেল অ্যাসাইলাম ফর দ্য চিলড্রেন অব ইউরোপিয়ানস অ্যান্ড দেয়ার ডিসেনডানস।’ (মধুসূদনের চিঠি-খসরু পারভেজ, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ পৃষ্ঠা- ৩৬)
২. আশার ছলনে ভুলি-গোলাম মুরশিদ। আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ-১৯৯৭, পৃষ্ঠা-৯৫।
৩. মধুসূদনের চিঠি- অনুবাদ : খসরু পারভেজ । ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা; প্রথম সংস্করণ- ২০০৫, পৃষ্ঠা-৩৪।
৪. আশার ছলনে ভুলি-প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা-১৩১।
৫. ‘ইউরেশিয়ান’ তারাই যাদের পিতা-মাতা দুজনের মধ্যে যে কোনো একজন ইউরোপীয়, অন্যজন এশীয়।
৬. মাইকেল মধুসূদন দত্ত : জীবন ও সাহিত্য- সুরেশচন্দ্র মৈত্র। পুথিপত্র, কলকাতা -১৯৮৫।
৭. আশার ছলনে ভুলি- প্রাগুক্ত । পৃষ্ঠা-১৪০।
৮. মধুসূদনের চিঠি- প্রাগুক্ত । পৃষ্ঠা-৪০।
৯. মধুসূদন : বিচিত্র অনুষঙ্গ- খসরু পারভেজ। কথা প্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ- ২০১৩, পৃষ্ঠা-৭২।
১০. আজাদ, হুমায়ুন (২০০৭)। “বাংলা লিটেরেচার ইন দ্য নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি” Bangla Literature in the Nineteenth Century [ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্য]। ইসলাম, সিরাজুল। হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ ১৭০৪-১৯৭১: সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল হিস্ট্রি History of Bangladesh 1704-1971: Social and Cultural History [বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১: সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস] (ইংরেজি ভাষায়)। ৩ (৩য় সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২৩৯।

১১. “সাহিত্য-সন্দর্শন”, শ্রীশচন্দ্র দাশ, বর্ণ বিচিত্রা, ঢাকা, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-৭১।

১২. কথাশিল্প অন্বেষণ-ড.সৌমিত্র শেখর – ১৬৬ পৃ।

———————————————————–
কৃতজ্ঞতা : উইকিপিডিয়া,

☆ রেভারেন্ড জেমস আব্দুর রহিম রানা ☆
খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমকর্মী ও জাতীয় পরিচালক, রূহানী চার্চ বাংলাদেশ।

858 Views

আরও পড়ুন

নওগাঁর পত্নীতলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরী সেবা প্রদানের জন্য এ্যামবুলেন্স প্রদান

র‍্যাবের ২৪ ঘন্টা অভিযানে ধর্ষন মামলার আসামী সেলিম গ্রেফতার

নকলায় পৃথক ঘটনায় দুই জনের মৃত্য

কক্সবাজারের রামুতে ছুরিকাঘাতে নিহত কৃষকলীগ নেতা নাজেম হত্যাকান্ডের ঘটনায় আটক ২

গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স’র কর্ণধার নূর মোহাম্মদ গ্রেপ্তার

চকরিয়ার নবাগত সহকারী কমিশনার ভূমি এরফান উদ্দিন

চকরিয়া প্রেসক্লাবের ইফতার মাহফিল সম্পন্ন
সাংবাদিকরাই পারে মানুষের আশার প্রতিফলন করতে- সাংসদ সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম 

“বদর দিবস” এর ইতিহাস, শিক্ষা ও তাৎপর্য

মাইশা আক্তার নিশিলার কবিতা “আসক্ত মেঘকণ্যা”

বোয়ালখালীর ৬টি দুস্থ পরিবারে এম এ হাশেম ফাউন্ডেশনের ঘর হস্তান্তর

” আনজুমনে নওজোয়ান ” বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসা শাখার অনুমোদন

শান্তিগঞ্জে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালিত