স্ক্যাবিস – বর্তমান সময়ে এক চর্মজনিত আতংকের নাম যা অনেকাংশে বেড়ে গিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করছে বর্তমানে বাংলাদেশে স্ক্যাবিসের প্রাদুর্ভাব মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গিয়েছে, যা মানুষের ত্বকে চুলকানির মাধ্যমে প্রথমে দেখা দেয়। অনেকেই একে সাধারণ চুলকানি মনে করে অবহেলা করছেন, যার ফলে এটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে এবং এটি সব বয়সের মানুষের হতে পারে।
-স্ক্যাবিস কি?
স্ক্যাবিস বা খোসপাঁচড়া ত্বকের খুবই সংক্রামক একটি চর্মরোগ , যা সারকোপটিস স্ক্যাবি (Sarcoptes scabiei) নামের একটি ক্ষুদ্র পরজীবীর কারণে হয়।
এই মাইটগুলো খুবই ক্ষুদ্র, প্রায় ০.৩ থেকে ০.৫ মিলিমিটার লম্বা, যা খালি চোখে দেখা যায় না।
এই পরজীবীটি মানুষের ত্বকের নিচে গর্ত করে বাসা বাঁধে এবং ডিম পাড়ে, মাইটের ডিম থেকে লার্ভা জন্ম নেয়, যা পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ মাইটে পরিণত হয়।
এর ফলে ত্বকে তীব্র চুলকানি ও লাল দানা দানা দেখা দেয়।স্ক্যাবিস ত্বকের অন্য সমস্যা যেমন অ্যালার্জি, ভাইরাস বা ছত্রাক সংক্রমণ থেকে আলাদা। সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এই মাইট (ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু) ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এই জীবাণু মানুষের ত্বকের ঠিক নিচের অগভীর স্তরে বাস করে এবং দিনে দুই-তিনটা ডিম পাড়ে।
-সংক্রমণ প্রক্রিয়া
স্ক্যাবিস খুব দ্রুত ছড়াতে পারে, বিশেষত যেসব পরিবেশে মানুষের ঘনিষ্ঠ মেলামেশা হয়। যেমন:
আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ার সরাসরি সংস্পর্শে এলে,
ঘনিষ্ঠভাবে একসাথে বসবাস করলে (যেমন—শিশুদের স্কুল বা হোস্টেল কিংবা কলেজ),
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে-
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।
হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের মতো জায়গায়।
স্ক্যাবিস সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম হলো:
দীর্ঘ সময় ধরে ত্বক-সংস্পর্শ।
সংক্রমিত ব্যক্তি ব্যবহার করা পোশাক, বিছানা বা তোয়ালে ব্যবহার করা।
-শরীরের যেসব স্থানে স্ক্যাবিস দেখা যায়:
হাত ও পায়ের আঙুলের ফাঁকে
কব্জিতে
ঊরুসন্ধিতে
বগলের ভাঁজে
কোমরের চারপাশে
কব্জির ভেতরের দিকে
কনুইয়ের ভেতরের অংশে
পায়ের তলায়
বুকে
স্তনের চারপাশে
নাভির চারপাশে
গোপনাঙ্গের চারপাশে
কুঁচকির অংশে
নিতম্বে
একপর্যায়ে সারা শরীরেই
শিশু ও ছোট বাচ্চাদের মধ্যে স্ক্যাবিস সাধারণত হয়:
আঙুলে
মুখমণ্ডল, মাথার ত্বক ও গলায়
হাতের তালুতে
পায়ের তলায়
-স্কাবিসের লক্ষণগুলো কী কী?
স্ক্যাবিসের লক্ষণগুলো রোগীর সংক্রমণের ২ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ পায়। তবে যাঁরা আগে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে লক্ষণ দ্রুত প্রকাশ পায়।
প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
১) প্রচন্ড চুলকানি বিশেষ করে রাতে। চুলকানি সাধারণত প্রথমে হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে তারপর সেখান থেকে ঘাড়ে, নাভির আশে পাশে চামড়ায়, লজ্জাস্থানের আশেপাশে ও পায়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
২) চুলকানোর জায়গা একটু ফোসকা পড়ে লাল হয়ে ফুলে যাওয়া।
৩) অতিরিক্ত চুলকানির কারণে চামড়া ফেটে যাওয়া।
৪) আগে থেকে আপনার কোনো চামড়ার অসুখ থাকলে সেটা আরো খারাপ হওয়া।
৫) ত্বকে ফুসকুড়ি ওঠা বা ত্বক আঁশের মত হয়ে যাওয়া।ত্বকে ছোট ছোট গুটি, ফুসকুড়ি বা দাগ দেখা যায়।দাগগুলো সাধারণত আঙুলের ফাঁক, কনুই, কবজি, কোমর, নাভি, স্তনের চারপাশ, এবং শিশুর পায়ের তলায় বেশি দেখা যায়।হাতের আঙুলের ফাঁকে, কনুই, কোমর, বুক বা শরীরের ভাঁজে লাল দানা বা ফুসকুড়ি ত্বকে ঘষা বা খোঁচাখুচির দাগ। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মাথা বা মুখেও হতে পারে
৬) ত্বকে ক্ষতের সৃষ্টি।
-জটিলতাঃ
স্ক্যাবিস যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
১) সেকেন্ডারি ইনফেকশন: চুলকানোর ফলে ত্বকে ক্ষত তৈরি হয়, যা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটাতে পারে।স্ক্যাবিস আক্রান্ত স্থানে অতিরিক্ত চুলকানোর ফলে ইম্পেটিগো ও সেলুলাইটিসের মতো ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।
২) নোডুলার স্ক্যাবিস: কিছু রোগীর ত্বকে লালচে গুটি (নোডুল) তৈরি হয়, যা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত থেকে যায়।
৩) ক্রাস্টেড স্ক্যাবিস: এটি স্ক্যাবিসের একটি গুরুতর ধরণ, যেখানে ত্বকে পুরু খোসা পড়ে। এটি সাধারণত ইমিউন সিস্টেম দুর্বল রোগীদের মধ্যে দেখা যায়।
৪)বেদনাদায়ক ত্বকের ঘা /সেপ্টিসেমিয়া (আপনার রক্তে সংক্রমণ)
৫)কিডনি রোগ
৬)দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের সমস্যা
৭)অবিরাম চুলকানি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, ফলে দৈনন্দিন জীবন ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
-প্রতিরোধের উপায় ঃ
স্ক্যাবিস প্রতিরোধে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে:
১) আক্রান্ত ব্যক্তির পরিপূর্ণ চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
২) সংক্রামিত ব্যক্তির পোশাক, বিছানার চাদর ও তোয়ালে উচ্চ তাপমাত্রায় ধুয়ে রোদে শুকানো।ব্যক্তিগত সকল সামগ্রী যেমন বিছানার চাদর, পোশাক ও তোয়ালে গরম পানি (৫০° সেলসিয়াস বা তার বেশি) দিয়ে ধুতে হবে এবং যদি ড্রায়ার না থাকে তবে গরম ইস্ত্রি দিয়ে শুকাতে হবে। যেসব কাপড় ধোয়া যায় না, সেগুলো একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে যাতে মাইটগুলো মারা যায়।
৩) পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও চিকিৎসা নেওয়া উচিত, কারণ স্ক্যাবিস খুব সহজে ছড়াতে পারে।
৪) ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।
৫)যদি পরিবারের কেউ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে থাকা সবার চিকিৎসা করা উচিত।
মাইট দূর করতে ফার্নিচার, কার্পেট ও গদি ভ্যাকুয়াম করা জরুরি।
চিকিৎসা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সরাসরি শারীরিক সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিত।
চিকিৎসা শুরু না হওয়া পর্যন্ত শিশুদের স্কুলে না পাঠানোই উত্তম, যাতে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি কমে।
চিকিৎসা ঃ
স্কাবিস একেবারে নিরাময়যোগ্য রোগ।
স্ক্যাবিস সংক্রমণকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে এবং চিকিৎসা করার জন্য, চিকিৎসকের দ্বারা নির্দেশিত অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক ওষুধগুলি ব্যবহার করা অপরিহার্য। এই ওষুধগুলি পরজীবী নির্মূল করে এবং দ্রুত লক্ষণগুলির উপশম করে থাকে। চিকিৎসকের দ্বারা বর্ণিত ওষুধের নির্দেশাবলী এবং চিকিৎসার সময়কালকে ঘনিষ্ঠভাবে মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু, যারা একজন সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন তাদেরও একই সাথে চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ ক্রিম, লোশন ও ট্যাবলেট ব্যবহারের মাধ্যমে স্ক্যাবিসের জটিলতা এড়ানো সম্ভব। সংক্রমিত ব্যক্তির পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও পার্টনারের জন্যও একই চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
বি.দ্রঃ স্ক্যাবিস হলে শরীরের সাথে কাপড়েরও চিকিৎসা করতে হবে।স্ক্যাবিসের জীবানু শরীরের বাইরে ৭২ ঘন্টা বেচে থাকে।যে কাপড় রেগুলার পরেন ৩দিন পরবেন না।চিকিৎসা শুরু করার পর টানা ১৪ দিন কাপড় আলাদাভাবে গরম পানি-ডেটল দিয়ে ধুবেন এবং ইস্ত্রী করে পরবেন।
Dr. Sayed Bin Anwar
MBBS, MCGP
DOC(Skin)
CCD(diabetes)