ব্যধিই সংক্রামক, সুস্বাস্থ্য নয় — চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে কতটুকু সত্য?
বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান প্রবন্ধকার প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন— “ব্যধিই সংক্রামক, সুস্বাস্থ্য নয়।” কথাটি নিছক সাহিত্যিক রসদ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হলেও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান স্পষ্ট ভাষায় জানায়, উক্তিটি বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং বাস্তব প্রমাণে দেখা যায়, সুস্বাস্থ্যও সংক্রামক হতে পারে, এবং সেটিই আধুনিক জনস্বাস্থ্য ও প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার ভিত্তি।
সংক্রামক রোগের যুগ থেকে ইমিউনিটির যুগ
মানবসভ্যতার ইতিহাস মহামারির ভয়াবহতা দিয়ে ভরা। গুটি বসন্ত, প্লেগ, কলেরা কিংবা সাম্প্রতিক কোভিড— সবই দেখিয়েছে যে রোগ আসলেই ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে আমরা আরও গুরুত্বপূর্ণ সত্য আবিষ্কার করেছি: রোগের মতোই রোগপ্রতিরোধও ছড়ায়। এটাই হলো হার্ড ইমিউনিটি(herd immunity)।
যখন সমাজের একটি বড় অংশ ভ্যাকসিন নিয়ে ইমিউন হয়, তখন তারা কেবল নিজেদের নয়, আশেপাশের দুর্বল ও অনাক্রম্য মানুষদেরও সুরক্ষা দেয়। এতে সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙে যায় এবং রোগ নিভে যেতে শুরু করে। অর্থাৎ সুস্বাস্থ্যও সংক্রমণের মতোই ছড়াতে পারে।
টিকা: সুস্বাস্থ্যের সংক্রমণশীল শক্তি
পোলিও নির্মূলের উদাহরণ আমাদের সবার পরিচিত। ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন (OPV) গ্রহণকারী শিশু শুধু নিজেই সুরক্ষিত হয় না, বরং মলমূত্রের মাধ্যমে পরিবেশে ভাইরাস ছড়িয়ে অন্য শিশুদেরও আংশিক সুরক্ষা দেয়। এটি এক অনন্য উদাহরণ— যেখানে স্বাস্থ্য সংক্রমণশীল হয়ে ওঠে।
এডওয়ার্ড জেনারের গুটি বসন্তের টিকা থেকে শুরু করে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন— সর্বত্রই প্রমাণ হয়েছে, টিকা আসলে সুস্বাস্থ্যের সংক্রমণের আধুনিক হাতিয়ার।
জন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সুস্বাস্থ্যের সংক্রমণ
সুস্বাস্থ্যের সংক্রমণ শুধু টিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জন্ম থেকেই শুরু হয়।
বার্থ ক্যানালের ব্যাকটেরিয়া: শিশু জন্মের সময় মায়ের বার্থ ক্যানালের উপকারী ব্যাকটেরিয়া শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। এগুলো শিশুর অন্ত্রে গিয়ে gut microbiome তৈরি করে, যা জীবনের প্রথম দিনগুলোতে সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে।
মাতৃদুগ্ধ: মায়ের দুধে থাকে অ্যান্টিবডি, প্রতিরোধী কোষ এবং নানা প্রতিরক্ষামূলক উপাদান। এগুলো শিশুকে অসংখ্য রোগ থেকে রক্ষা করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে বলা হয় passive immunity— এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সুস্বাস্থ্যের সরাসরি সংক্রমণ।
পরিবেশ ও প্রোবায়োটিক: পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একসাথে থাকা, একই খাদ্যাভ্যাস ও পরিবেশ ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে শিশুর শরীরে নানা উপকারী জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেও সুস্বাস্থ্যের সংক্রমণ ঘটে।
এপিজেনেটিক্স: মায়ের জীবনযাপন— যেমন খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ, কিংবা ঘুমের ধরন— সন্তানের জিন এক্সপ্রেশনে প্রভাব ফেলে। এর ফলেও স্বাস্থ্যের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।
জীবনধারা: আচরণের সংক্রমণ
চিকিৎসাবিজ্ঞান আরও দেখিয়েছে, মানুষের আচরণও সংক্রামক। একজন ব্যক্তি যখন স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গ্রহণ করে— যেমন ধূমপান ত্যাগ, নিয়মিত ব্যায়াম, বা স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস— তখন তার পরিবার, বন্ধু এবং সহকর্মীরাও প্রভাবিত হয়। গবেষণা বলছে, একজন ধূমপায়ী ধূমপান ছাড়লে তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যেও ত্যাগের হার বহুগুণ বেড়ে যায়।
চূড়ান্ত মূল্যায়ন
অতএব, “ব্যধিই সংক্রামক, সুস্বাস্থ্য নয়”— এই বক্তব্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে টিকে থাকতে পারে না। রোগ যেমন ছড়ায়, তেমনি সুস্বাস্থ্যও ছড়ায়— টিকার মাধ্যমে, মায়ের গর্ভ থেকে শিশুর শরীরে, জীবনধারার মাধ্যমে, এমনকি সামাজিক প্রভাবে।
উপসংহার
সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমথ চৌধুরীর উক্তিটি রসাত্মক হতে পারে, কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। সুস্বাস্থ্যের সংক্রমণই মানবসভ্যতার আসল শক্তি, যা টিকা, মাতৃদুগ্ধ, গাট-মাইক্রোবায়োম ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে একে অপরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আজকের বিশ্ব তাই প্রমাণ করেছে।
লেখক পরিচিতি:
মুমতাজুল হাসান
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া।
শুভ