নিউজ ডেস্ক :
প্রতি বছরের ন্যায় এবারো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা পশু কোরবানি করে থাকেন। কোরবানির পর কীভাবে টাটকা মাংস দীর্ঘদিন ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যাবে, তা নিয়ে সবার মধ্যেই চিন্তা কাজ করে।
মূলত স্বাদ ও গুণগত মান যথাসম্ভব অক্ষুণ্ন রেখে মাংসকে জীবাণুমুক্ত রাখাই সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য। এছাড়া, পচন এড়ানোর মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে আর্থিক ক্ষতি এড়ানোর জন্যও মাংস সংরক্ষণ করা হয়।
সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হলে পরবর্তীতে সেই মাংস খেয়ে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় ঘরের খাবার থেকে সৃষ্ট বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) পুষ্টিবিদ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার এবং বাংলাদেশ একাডেমি অব ডায়াটিকস অ্যান্ড নিউট্রিশনের (বিএডিএন) নির্বাহী পরিচালক ডা. সাজেদা কাশেম জ্যোতী বলেন, “পুষ্টিগুণের কথা চিন্তা করলে কোরবানির মাংস এক মাসের মধ্যেই খেয়ে ফেলা উচিত। তবে তা সবার জন্য বাস্তবমুখী হয় না।”
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ দেশ-বিদেশে, ঘরে ও বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন উপায়ে মাংস সংরক্ষণ করে আসছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেটি এখন আরও উন্নত, সহজ ও যুগোপযোগী। চলুন দেখে নিই কি কি উপায়ে দীর্ঘদিন মাংস সংরক্ষণ করা যায়-
রেফ্রিজারেশন পদ্ধতি
মাংস সংরক্ষণের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ডিপ রেফ্রিজারেটরে মাংস সংরক্ষণ করা। মাংসের ৫০-৭৫% অংশই পানি। এ পানি থেকেই পচনশীল জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার নিচে রেফ্রিজারেটরে মাংস সংরক্ষণ করা উচিত। -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে ওই পানির প্রায় ৯৮% অংশই ক্রিস্টাল হয়ে পচন রোধ করে।
রেফ্রিজারেটরে গরুর মাংস ৫-৬ মাস, খাসির মাংস ৪-৫ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তবে কলিজা বেশিদিন রেফ্রিজারেটরে না রাখাই ভালো। এছাড়া, উট ও মহিষের মাংস ৩-৪ মাস রাখা যাবে। আর ভেড়ার মাংস রাখা যাবে ২-৩ মাস। তবে রেফ্রিজারেটরে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইটে থাকলে মাংস প্রায় এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে।
মাংসে চর্বি যত কম থাকবে, মাংস তত বেশিদিন সংরক্ষণ করা যাবে। তাছাড়া, সংরক্ষণের আগে অবশ্যই মাংস থেকে রক্ত, চর্বি, পানি পরিষ্কার করে নিতে হবে। কারণ এগুলো থাকলে ব্যাকটেরিয়া জন্মানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আবার মাংস বেশি মোটা করে না কেটে স্লাইস করে রাখলে বেশিদিন ভালো রাখা সম্ভব।
মাংস ছোট ছোট প্যাকেটে সংরক্ষণ করা উচিত। মাংস সংরক্ষণ করতে অবশ্যই জিপলক ব্যাগ ব্যবহার করা উচিত। মাংস সংরক্ষণে বিভিন্ন প্লাস্টিক ব্যাগ বা বক্স ব্যবহার না করে ভ্যাকিউম-সিল্ড ব্যাগ ব্যবহার করা সর্বোত্তম। মাংস রেফ্রিজারেটরে রাখার এক সপ্তাহের মধ্যে বাসায় বিদ্যুৎ না থাকলে ফ্রিজ না খুলাই উত্তম। কারণ শক্ত হওয়ার আগেই মাংস বাতাসের সংস্পর্শে আসলে তা বেশিদিন ভালো থাকে না।
ঘরোয়া পদ্ধতি
আদা গুঁড়া, মিট এনহ্যান্সার, সয়া প্রোটিন পাউডার, সিরকা, কিউরিং সল্ট, ভেজিটেবল প্রোটিন, পাপরিকা পাউডার, সেলারি পাউডার এবং আলু দিয়ে ঘরোয়া পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা সম্ভব।
ড্রাইং পদ্ধতি
এটি মাংস সংরক্ষণের একটি পুরোনো পদ্ধতি। মূলত অতীতে যখন রেফ্রিজারেটর ছিল না, তখন এ পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা হতো। এ পদ্ধতি অনুযায়ী, মাংস রোদে বা চুলায় জ্বাল দিয়ে ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে নিতে হয়। এটি অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ সাশ্রয়ী। এ পদ্ধতিতে মাংসের চর্বি ফেলে দিয়ে পাতলা করে কেটে ভ্যাকিউম-সিল্ড করে ফ্রিজে এক বছর পর্যন্ত রাখা যায়।
স্মোকিং পদ্ধতি
মাংস সংরক্ষণে এটিও একটি পুরোনো পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে দুটি উপায়ে মাংস মাংস সংরক্ষণ করা হয়। একটি হলো হট স্মোকিং আর অন্যটি হলো কোল্ড স্মোকিং। হট স্মোকিং এর ক্ষেত্রে ৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মাংস পোড়ানো হয়। অন্যদিকে, কোল্ড স্মোকিং পদ্ধতিতে ১২-২৪ ঘণ্টা স্মোকিং আগুনে ৮৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মাংস পোড়াতে হয়। ফলে তাপের ধোঁয়ায় মাংসের জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। সাধারণত মাংস ব্যবসায়ীরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন।
সল্টিং পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে লবণ, কিউরিং লবণ, মসলা এবং ব্রাউন চিনি অথবা খাবার লবণ, সোডিয়াম নাইট্রেট ও সোডিয়াম ল্যাকটেট দিয়ে মাংস মেখে ২৪ ঘণ্টা রেখে ফ্রিজে এক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। মাংসের অক্সিডেটিভ ও মাইক্রোবিয়াল পচন প্রতিরোধই এ পদ্ধতির বিশেষত্ব। টিএফডিএ অনুমোদিত এই সল্টিং বা লবণ পদ্ধতিতে মাংস সবচেয়ে বেশি টাটকা এবং পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ হয়ে থাকে।
ক্যানিং পদ্ধতি
এই পদ্ধতিটি থার্মাল স্টেরিলাইজেশন নামেও পরিচিত। এই পদ্ধতিতে প্রথমে প্রায় ২৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় মাংস ড্রাই করে ঠাণ্ডা করা হয়। কাচের জার বা বয়ামের মুখ আটকে তাতে এ মাংস প্রায় এক বছর পর্যন্ত রাখা যায়। এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে গেলে মাংস কাটা, রান্নার আগে সিমিং, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ঠাণ্ডা করা ইত্যাদি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
কোল্ড স্টেরিলাইজেশন পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে মাংসের সঙ্গে আয়োনাইজড রেডিয়েশন, অর্থাৎ কোবাল্ট, গামা রেডিয়েশন, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশন ইত্যাদির মতো রেডিয়েন্ট এনার্জি ব্যবহার করা হয়। মাংস সংরক্ষণের নতুন এই পদ্ধতিতে অধিকাংশ মাইক্রো অর্গানিজম মেরে ফেলা হয়। ফলে মাংসের সব পুষ্টিগুণাগুণ অটুট থাকে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০