অ্যান্টিবায়োটিককে আমরা এক ধরনের জীবন রক্ষাকারী ঔষধ হিসবেই জেনে এসেছি,
কিন্তু সামনের শতাব্দীতে এই এন্টিবায়োটিক ই জীবন নাশের সবচেয়ে বড় কারন হতে যাচ্ছে,
কারন? আ্যন্টিবায়োটিক রেজিজস্ট্যান্স!
আ্যন্টিবায়োটিকের ইতিহাস অনেক পুরনো -১৯০০ সালের শেষের দিকে রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করার বিষয়টি পর্যবেক্ষণে আনেন জার্মান চিকিৎসক পল আরলিচ এবং তারই প্রেক্ষিতে ১৯০৯ সালে তিনিই প্রথম সিফিলিস চিকিৎসার জন্য আর্সফেনামিন নামক এক কেমিক্যালের সফল ব্যবহার করেন। ফলে অনেকে এটাকেই প্রথম আধুনিক অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে চিহ্নিত করেন। ১৯২৮ সালে লন্ডনের সেন্ট মেরি হসপিটালের অধ্যাপক আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের ঐতিহাসিক আকস্মিক আবিষ্কার পেনিসিলিন থেকে এন্টিবায়োটিকের যাত্রা শুরু হয়
কিন্তু আ্যন্টিবায়োটিকের বানিজ্যিকিকরন শুরু হয় ১৯৪০ সাল থেকে।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যখাতে নতুন এক অশনি সংকেত অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর ৭ লাখ মানুষ মারা যায় আ্যন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের কারণে এবং ধারনা করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করবে কার্যকরী আ্যন্টিবায়োটিকের অভাবে, আ্যণ্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সালে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় বাড়বে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার।
আর এই আ্যন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছাচার আমাদের এখন খুব সামান্য রোগে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে, কারন দেখা যাচ্ছে যে অনেক আ্যন্টিবায়োটিক রেজিজস্ট্যান্স হওয়ার কারনে রোগিকে দেওয়ার মত কার্যকর আ্যণ্টিবায়োটিক পাওয়া যায় না অনেকক্ষেত্রে, এতে দেখা যায় রোগীর সামান্য ইনফেকশন ও ভালো হচ্ছে না,এবং ইনফেকশন বেড়ে গিয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন এবং এই অবস্থা দিন দিন বেড়েই চলছে!
তাছাড়া
মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স সেকেন্ড-লাইন এবং থার্ড-লাইন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজনীয়তার দিকে পরিচালিত করতে পারে, যেগুলি খুবই ব্যয়বহুল
একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধের সাথে, চিকিত্সা অকার্যকর হতে পারে এবং রোগীরা দীর্ঘ সময়ের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে
এই দীর্ঘায়িত অসুস্থতা ও অন্যান্য অঙ্গগুলির ক্ষতির জন্য আরও ব্যয়বহুল চিকিত্সার প্রয়োজন হয় এবং বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগের আবির্ভাব হয়
আ্যণ্টিবায়োটিক রেজিজস্ট্যান্স কি?
অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ড্রাগ এমন এক ধরণের ওষুধ যা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে,
এবং জিনগত পরিবর্তনের ফলে কিছু জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের ধ্বংস করা ক্ষমতাকে (অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স) অভিযোজন করে নেয়। অথবা সাধারনভাবে বলা যায়
শরীরে কোনো ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করতে প্রয়োগ করা নির্দিষ্ট ওষুধের বিপক্ষে যুদ্ধ করে ওই ব্যাকটেরিয়ার টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করাকে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলে এবং এতে করে আ্যন্টিবায়োটিকের কার্যাকরিতা থাকে না
সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক সময় পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করলে শরীরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয় না। যে ব্যাকটেরিয়াগুলো বেঁচে থাকে সেগুলো রোগীর শরীরে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যার ফলে পরবর্তীতে রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করা হলে তখন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ আর কাজ করে না।
কেন হয়?
কয়েকটি কারনে আ্যন্টিবায়োটিক রেজিজস্ট্যান্স হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম কারন হচ্ছে আ্যণ্টিবায়োটিক এর যথেচ্ছাচার, যা আমাদের দেশে অকল্পনীয় হারে বিদ্যমান, যেমন-
অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা ও সময় না মানা।
এর অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার( ভাইরাল সংক্রমনে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার)
আমাদের দেশে ভাইরাল জ্বর সর্দি তেও আমরা না জেনে আ্যণ্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকি
রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন কিংবা ফার্মেসী থেকে গ্রহন করা
সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা।
অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ না করে রোগের উপসর্গ কমে গেলে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া।
প্রয়োজন ছাড়া দুই বা ততোধিক অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার।
পশুপাখির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ও অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার।
অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় ও ক্রয় সম্পর্কিত আঈন না থাকা ও না মানা কারন একমাত্র আমাদের দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া আ্যন্টিবায়োটিক ক্রয় বা বিক্রয় করা যায় না
এই ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশী যথেচ্ছাচার হয়ে থাকে, রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ কিংবা প্রেস্ক্রিপশন ছাড়াই মানুষ হর হামেশা ফার্মেসী থেকে আ্যণ্টিবায়োটিক ক্রয় করতে পারেন, সামান্য অসুখেই তারা আ্যণ্টিবায়োটিক শুরু করে দেন যা পরবর্তীতে হীতে বিপরীত হয়,
এবং দেখা যায় যে পরিবারের কারো যদি কোনো আ্যন্টিবায়োটিক রেজিজস্ট্যান্স তৈরি হয় তা পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে ও ছড়িয়ে যেতে পারে,
আ্যন্টিবায়োটিক রেজিজস্ট্যান্স রোধে আমাদের করনীয় :
প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে এর বাইরে ফার্মেসী থেকে বা অন্য কোনো উপায়ে যথেচ্ছাচার করা যাবে না, বিনা প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা যাবে না।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে।অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স শেষ না করে মাঝপথে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করা যাবে না।
প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না যা শুধুমাত্র আপনার রেজিস্টার্ড চিকিৎসক প্রেস্ক্রাইব করতে পারেন
অন্যের অবশিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না, কিংবা নিজের অ্যান্টিবায়োটিক অন্যকে দেয়া যাবে না।
সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
পরিষ্কার রুমাল বা টিস্যুতে নাক-মুখ চেপে হাঁচি দিতে হবে।
স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।
লেখক:
ডা:সাঈদ বিন আনোয়ার
চিকিৎসক, জেনারেল প্র্যাক্টিশনার
এম.বি.বি.এস,এমসিজিপি
সিসিডি,ডিওসি
আল খিদমাহ স্পেশালাইজড ডায়গন্সটিক সেন্টার