----+
সালটা ২০১৭। পড়ি তখন ক্লাস নাইনে। আমাদের যুগে সিনেমা হলে কি ছবি দেখার চল শেষ হবার পথেই বলা যায়। বড়দের মুখে শুনতাম স্কুল পালিয়ে হলে গিয়ে নতুন নতুন সিনেমা দেখার রোমাঞ্চকর সব কাহিনী। এসব কাহিনী শুনে শুনে নিজেরও খুব ইচ্ছা হলো হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে যাবো। যেই ভাবা সেই কাজ, সঙ্গী হলো আমার আরো ৯ জন বন্ধু (পরে আরো একজন যুক্ত হয়েছিল) । আম্মুকে মিথ্যে বলে সকালে বাসা থেকে বের হলাম। নাঈমা ম্যামের প্রাইভেটে পরীক্ষা আছে বলে সকাল সকাল স্কুলে আসছি। একটা ইজিবাইক ভাড়া করে আমরা ১১ বন্ধু চললাম কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। "মানসী" হলে প্রথমবার বড়পর্দায় সিনেমা দেখলাম। প্রাইভেট, ক্লাস সব বাদ দিয়ে সিনেমা দেখলাম আমরা । তারপর পার্কে ঘুরাঘুরি করে গেলাম খাওয়া দাওয়া করতে। সারাদিন ভালোই গেছিলো, বিপদ হলো খাওয়ার সময়। বাড়ি থেকে বাবা ফোন করলেন, অজুহাত দিতে লাগলাম কেন আজকে এখনো বাসায় যাই নি। কিন্তু, একটু পরে বুঝলাম ধরা পড়ে গেছি৷ আসলে বাবার এক বন্ধু দেখে ফেলেছিলেন আমাদের। আমি উনাকে দূর থেকে খেয়াল না করলেও উনি করেছিলেন। যাই হোক পরে ভয়ে ভয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি গেলাম। গিয়ে দেখি আম্মু আমার বই খাতা সব বস্তায় ভরে ফেলেছে। আমি যাবার পর বলতেছে আর পড়াশোনার দরকার নাই। পরে অনেক বার মাফ টাফ চেয়ে, হাতে পায়ে ধরে আম্মুকে ঠান্ডা করতে সক্ষম হলাম৷ ভাবলাম যাক বাঁচলাম। কিন্তু, আসল কাহিনী তো বাকি ছিল। পরের দিন স্কুলে গেলাম৷ যাবার পর দেখি আমার সাথের ৬ জন পাপী ও উপস্থিত। বাকি ২ জন আগেই মনে হয় কিছু বুঝতে পেরেছিল তাই ওরা আসেনি স্কুলে৷ এসেম্বলির পর যখন ক্লাসে গেলাম তখন হুট করে ক্লাসে ঢুকলেন রবিন স্যার, উনি সম্পর্কের দিক দিয়ে আমার মামা হন। উনার সাথে ক্লাসে ঢুকলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক কারার আব্দুর রশীদ স্যার। দুজনেই দেখলাম হাতে জালি বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে। ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো। রবিন স্যার প্রথমে এসেই ডাক দিলেন, "এই ইশিন, স
দাড়া। কালকে ক্লাসে আসিস নাই কেনো? স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখা? বাইরের স্কুলের টিচার দের কাছে তোদের জন্য কথা শোনা লাগবে কেন? তোর সাথে আর কারা ছিল? দাড়া সবগুলা" আমি তখন মাথা নিচু করে দাড়িয়ে, আস্তে করে বললাম স্যার আমি একা ছিলাম আর কেউ ছিলো না। রশীদ স্যার ও তখন হুংকার দিয়ে উঠলেন। আমাকে সত্য স্বীকার করতে বললেন। আমার মধ্যে তখন বন্ধুত্বের শক্তি জেগে উঠলো, জোর দিয়ে বললাম যে আর কেউ ছিলো না। রবিন স্যার তখন বেত নিয়ে আমার দিকে এগোতে লাগলো। এমন সময় বন্ধু কাওসার দাঁড়িয়ে বললো, "স্যার, আমিও ছিলাম"। ও দাঁড়ানোর সাথে সাথে এক এক করে শাকিল, মাহফুজ, শোভন, অজিত আর জয় ও দাড়ালো। আমাকে স্যার শাস্তি দিতে আসছে দেখে তাদের মধ্যে ও বন্ধুত্বের টান জেগে উঠে। স্যারেরা তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। হেডস্যার বেত ফেলে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পরে রবিন স্যার আর অজিত স্যার আমাদের কে ঠান্ডা মাথায় উপদেশ দিলেন আর ভবিষ্যতে যেন এভাবে মিথ্যা বলে, স্কুল পালিয়ে কোথাও না যাই তা বললেন। আমরা তাদের কাছে ক্ষমা চাইলাম। বললাম যে আর কোনদিন এমন করে স্কুল পালাবো না (যদিও পরে স্কুল পালিয়ে এর থেকে বড় বড় কাজ করেছি। সেগুলা এখন বলতে গেলে পাঠক বিরক্ত হতে পারেন) স্যারেরা তখন আমাদের আর শাস্তি না দিয়ে চলে গেলেন।
সেদিন মনে হয়েছিল এটাকেই বলে বন্ধুত্ব। এক জন অন্যের বিপদে পাশে থাকা এই তো বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে কিছুই আসতে পারবে না। কিন্তু, সময়ের আজব খেলায় এখন একেকজন একেক জায়গায়। আমি আছি গোপালগঞ্জে, কাওসার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে, শাকিল পল্লী বিদ্যুৎ এর চাকরির জন্য লক্ষীপুর, জয় কোরিয়া যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, অজিত চলে গেছে বিমানবাহিনী তে, শোভন ঢাকায়। এভাবে সবাই ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত। চাইলেও আগের মত আড্ডা আর হয়না। আমাদের আড্ডাখানা ছিল পোস্ট অফিসের মোড়ে। এখন সেখানে শূন্যতা। মান্না দে'র গানের মত তাই বলতে ইচ্ছে হয়,
" পোস্ট অফিসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই,
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই"।
যে যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস বন্ধুরা।
---------
তানজিম হাসান ইশিন
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০