আজ ১৭ই রমজান ঐতিহাসিক ‘বদর দিবস’। বদর একটি জায়গার নাম। মক্কা থেকে কিছুটা উত্তরে, মদিনা থেকে ৮০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে। আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশ বছর আগে (১৩৯৮ সৌরবর্ষ ও ১৪৪১ চন্দ্রবর্ষ) ওই আমলের আরব দেশে মক্কা নগরীর কুরাইশদের সাথে যে বাণিজ্য হতো সেই বাণিজ্যের কাফেলাগুলো চলাচল করার যে পথ ছিল সেটি ‘বদর’ নামক জায়গার পাশ দিয়েই যেত। বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল হিজরি দ্বিতীয় সালে রমজান মাসের ১৭ তারিখে (১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে)।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে চলে এলেন। তারপর মদীনায় নতুন একটি নগররাষ্ট্র, নতুন সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা ও দ্বীন ইসলামের মূল কেন্দ্ররূপে গড়ে তোলার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলেন। এটা দেখে মক্কার কুরাইশগণ ঈর্ষান্বিত হলো। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে তারা নানা ষড়যন্ত্রের পথ খুঁজতে লাগল। মক্কার কুরাইশগণ চিন্তা করলো যে, আমরা তো সবাই মিলে মক্কায় তাঁকে (মুহাম্মদ সা.) দমন করে রাখতে পেরেছিলাম, কিন্তু এখন মদীনায় গিয়ে তিনি নতুনরূপে বাঁধাহীনভাবে ইসলাম প্রচার করতে লাগলেন। যদি এরূপ প্রচার অব্যাহতভাবে চলতে থাকে আর তাঁর এই সংগ্রাম সামনে অগ্রসর হতে থাকে তাহলে অচিরেই মদীনার মুসলিমগণ মক্কার লোকজনের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। অতএব তাদের অঙ্কুরেই বিনাশ করা প্রয়োজন।।
অপর দিকে, মাত্র জন্ম নেয়া মদীনা নামক নগররাষ্ট্র তথা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি ক্রমবর্ধমান হচ্ছিল, যেটি সেখানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার সাথীরা চিন্তা করলেন যে, আমরা মক্কা থেকে বের হয়ে এসেছি সত্য, কিন্তু মক্কার হুমকি থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। আমরা এখনো তেমন শক্তি অর্জন করতে পারিনি। তাই আগে আমাদের শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন এবং আল্লাহর দ্বীনকে তার জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে যুদ্ধের কোনো বিকল্প নেই। মোটামুটি এ ধরনের চিন্তাভাবনার প্রেক্ষাপটের পরেই মক্কা ও মদিনা এই দুই শহরকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠির মধ্যে একটি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
তাছাড়া পরোক্ষভাবে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো যুদ্ধের প্রস্ততি গ্রহণ করার। অবশেষে রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্বে মদীনা থেকে মুসলমানদের একটি দল বের হলো। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়াগামী মক্কা নগরীর আরবদের বাণিজ্য কাফেলা, যেটা সিরিয়া থেকে ধনসম্পদ নিয়ে মক্কায় ফেরত যাবে তাদের মোকাবেলা করা। সে জন্য তারা চলাচলের রাস্তার পাশে ওঁৎ পেতে ছিল। অপর দিকে ধনসম্পদ নিয়ে মক্কা নগরীর ব্যবসায়ীদের কাফেলা সিরিয়া থেকে ফেরত যাওয়ার সময় সংবাদ পেলো, এই পথ ধরে গেলে পথিমধ্যে তাদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। তাই তারা সবার সিদ্ধান্তক্রমে তাদের গতিপথ একটু পরিবর্তন করে মক্কায় যাওয়ার জন্য নতুন পথ আবিষ্কার করলো এবং সেই পথ ব্যবহার করে তারা মক্কার কাছাকাছি চলে গেলো।
কিন্তু ইতোমধ্যে অন্য একটি ঘটনার উদ্ভব হলো। বাণিজ্য কাফেলার অনুরোধে মক্কা থেকে একদল সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রওনা দিয়েছিল বাণিজ্য কাফেলাকে এগিয়ে আনার জন্য। মক্কা থেকে উত্তর দিকে যে পথ ধরে বাণিজ্য কাফেলা আসছে, সেই পথ ধরে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে বাণিজ্য কাফেলার ওপর কোনো বিপদ-আপদ হলে যেন তারা সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু বাণিজ্য কাফেলা মদিনার মুসলমানদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে গেলো, এমনকি মক্কা থেকে আসা সাহায্যকারী লোকদেরও দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলো। মক্কা থেকে আগত সাহায্যকারী দল যখন বদর নামক স্থানে এসে অবস্থান করছিল তখন তারা সংবাদ পেল মুসলমানগণ তাদের আশপাশে আছে। আবার মুসলমানগণ বদর নামক স্থানটির কাছেই অবস্থান করেছিল; ফলে তারাও জানতে পারলো মক্কা থেকে আগত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একদল সৈন্যবাহিনী তাদের পাশে অবস্থান করছে। ফলে যুদ্ধটি চূড়ান্ত রূপে দেখা দিলো।
বদর নামক স্থানে কাফেরেরা এক দিকে অবস্থান নিল, অন্য দিকে মুসলমানগণ অবস্থান নিলেন। মুসলমান বাহিনী যে স্থানটিতে অবস্থান নিল সেখানে একটি পানির কূপ ছিল। যেহেতু পানির কূপটি মুসলমানদের দখলে সেহেতু কাফেররা পানির সঙ্কট অনুভব করলো। কূপের পাশেই একটি পাহাড়, সেখানে মুসলমানদের সদর দফতর স্থাপন করা হলো। একটি তাঁবুর বন্দোবস্ত করা হলো, সেখানে রাসূলে পাক (সা.) অবস্থান নিলেন। এলাকাটি ছিল সমতল, কিন্তু তিন দিকে ছিল পাহাড়-বেষ্টিত।।
বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা আর কাফেরদের সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে ছোটখাটো মতপার্থক্য আছে। তবে যে মতামতটি জোরালোভাবে গ্রহণযোগ্য সেটা এ রকম: মুসলমানগণ ছিলেন ৩১৩ জন, অপরপক্ষে কাফেরদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। মুসলমানদের ৩১৩ জন সাহাবির মধ্যে ৮০ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবি; বাকি ২৩৩ জন ছিলেন মদিনার আনসার। আনসারদের মধ্যে ৬১ জন আউস গোত্রের আর বাকি ১৭২ জন ছিলেন খাজরাজ গোত্রের। পুরো ৩১৩ জনের দলে উট ছিল ৭০টি আর ঘোড়া ছিল মাত্র দু’টি। অপরপক্ষে কাফেরদের এক হাজারের দলের ৬০০ জনের কাছে ছিল দেহ রক্ষাকারী বর্ম এবং তাদের কাছে ঘোড়া ছিল ২০০টি।।
যুদ্ধের ক্ষেত্রটির অবস্থান এবং পরিবেশের বর্ণনা দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন। মুসলমানেরা যে স্থানটিতে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে সূর্যের তেজ সরাসরি তাদের মুখের ওপরে পতিত হয়। কিন্তু কাফেরদের মুখে দিনের বেলায় সূর্যের আলো পড়ে না। মুসলমানেরা যেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবেন সেখানের মাটি একটু নরম, যা যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। অপর দিকে কাফেররা যেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানের মাটি শক্ত এবং যুদ্ধের জন্য স্থানটি উপযুক্ত।।
রমজান মাসের ১৬ তারিখ দিনটি শেষ মাগরিবের পর তারিখ বদলে গেল, অতঃপর ১৭ রমজান শুরু হলো। সেই রাতে উৎকণ্ঠিত মুসলমানগণ এবং কাফেররা নিজ নিজ ক্যাম্পে অবস্থান করছে। সেই রাতে মহান আল্লাহ্ তা’য়ালার নিকট সেজদায় পড়ে সাহায্য প্রার্থনা করছেন মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন অনেকটা এ রকম:
“হে রাজাধিরাজ মহান আল্লাহ্, আগামীকালের নীতিনির্ধারণী যুদ্ধে তোমার সাহায্য আমাদের অতি প্রয়োজন। এই যুদ্ধে আমরা তোমার সাহায্য ছাড়া বিজয় লাভ করতে পারবো না। আর আমরা যদি পরাজিত হই হয়তো তোমাকে সেজদা করার কিংবা তোমার নাম ধরে ডাকার লোক এই পৃথিবীতে আর নাও থাকতে পারে। অতঃপর তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো কী করবে; কারণ তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মালিক। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। আমরা আমাদের জীবন তোমার পথে উৎসর্গ করলাম। বিনিময়ে তোমার দ্বীনকে আমরা তোমার জামিনে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তুমি আমাদেরকে বিজয় দান করো। আমরা তোমার কাছে সাহায্য চাই।”
রাসূল (সা.)-এর আন্তরিক আকুতি-মিনতি মহান আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে গেল। হযরত জিব্রাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে জবাব এলো- সাহায্য আসবে, তোমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তত হও, তোমাদের শিরকে উঁচু করো এবং দৃঢ় পদক্ষেপে দাঁড়াও। পবিত্র কুরআনের সূরা আনফালের ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণাটি নিম্নরূপ: “আর স্মরণ কর, যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট ফরিয়াদ করছিলে, তখন তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন যে, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে পর পর আগমনকারী এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করেছি’।”
এই যুদ্ধে মানবতার নবী মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমান সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে যে যুদ্ধপূর্ব ভাষন দিয়েছিলেন তা বিশ্ব মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ ও দুর্বলদের আঘাত করবে না। বসতবাড়ি, ফসল ও ফল-ফলাদি বিনষ্ট করবে না। শুধুমাত্র যারা তোমাদের আঘাত করবে তাদের সাথে যুদ্ধ করবে।” আল্লাহু আকবার
আল্লাহর রাসুল(সা.)-এর এই সুন্দর আদর্শের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন অনেক অমুসলিম, পৌত্তলিক, ইহুদি কাফের সত্যের ডাকে সাড়া দিয়ে কালিমা পড়ে মুসলমান হয়েছিল।
আজও যদি মুসলমানগণ বদরী সাহাবিদের মতো ইমানী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাতিলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়, তাহলেই আবারও বিশ্বময় মুসলমানদের বিজয় আসবেই আসবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সেই ইমান ও একীন দান করুন। আ-মী-ন ইয়া রাব্বাল আলামীন।
আলী ওসমান শেফায়েত
শিক্ষক ও গবেষক
কুতুবদিয়া, কক্সবাজার।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০