অসহায়ত্বের বন্দিশালা
ফারজানা ইসলাম ইতু
দারিদ্র্যের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে কিছু মানুষকে দেখেছি নৈতিকতা হারাতে, কিছু মানুষকে দেখেছি ভালো কিছু অর্জন করতে গিয়ে সর্বস্ব হারাতে। আজ এমন একজনের কাহিনি লিখতে বসেছি যে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে নিজের অস্তিত্বটাই হারিয়েছে।
আমি তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী। আমাদের গৃহকর্মীর নাম ছিলো মর্জিনা। আমাদের প্রতিবেশী ছিলো। তার মা, ভাই, বোম সবার অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলাম। ওর একটা ভাই ছিলো পাগল। একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনি ওর ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ওর মা চিৎকার করে কাদছিলো। খুব মায়া লেগেছিলো সেদিন। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর জানতে পারলাম ওর ভাইকে নাকি অন্য একটি জেলায় একটা লোক দেখেছে। ওদের কাছে যাওয়া আসার ভাড়া দাবি করলো এবং বললো তাকে শীঘ্রই ফিরিয়ে আনবে। ওদের অনেক পরিশ্রমের সঞ্চয় দিয়ে দেয়া হলো হারিয়ে যাওয়া পাগল ভাইকে ফিরে পাবার আশায়। লোকটি কিছুদিন পরে ফিরে এসে জানালো তাকে সে খুঁজে পায়নি। বলা বাহুল্য মর্জিনার পরিবার প্রতারণার শিকার হয়েছিল। লোকটি যে মিথ্যা বলেছিলো সেটা কিছুদিন পার হলেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। এভাবে অনেকদিন কেটে গেলো। আমি দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলাম৷ সামনেই এস এস সি দিবো তাই পড়াশোনার চাপ খুব বেশি ছিলো৷ একদিন টেবিলে বসে অঙ্ক কষছিলাম। হঠাৎ করে কানে এলো মর্জিনা আমার আম্মুকে বলছে সে বিদেশে যেতে চায়। এক দালাল নাকি তাকে কম টাকায় বিদেশে যেতে সহযোগিতা করছে৷ বেশ কিছু দিন পার না হতেই জানলাম বিদেশে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত পাকা হয়ে গিয়েছে। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকু অন্যের হাতে সমর্পণ করে দিয়েছে কাঙ্ক্ষিত জীবনের প্রত্যাশায়। একদিন ভোরে শুনলাম মর্জিনা তার কাঙ্ক্ষিত জীবনের প্রত্যাশায় পাড়ি দিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে আমাদের বাসার মুঠোফোন নাম্বার তার মাকে দিয়ে গেলো। সন্ধ্যার সময় ওর মা এসে আমাদের ঘরের দুয়োরে বসে রইলে মর্জিনার ফোন আসবে এই প্রত্যাশায়। রাত প্রায় ১০ টা বেজে গেলো কিন্তু ওর ফোন আসলো না। এভাবে অনেকদিন কেটে গেলো । মর্জিনার মা প্রতিদিনই আমাদের ঘরের দুয়োরে বসে তার প্রবাসী মেয়ের ফোনকলের অপেক্ষায় থাকে৷ দুর্ভাগ্যবশত প্রতিদিনই অশ্রুভরা চোখ নিয়ে ফিরে যায়৷ হয়তোবা তাকে পাচার করে দিয়েছে। সচ্ছল জীবনের খোঁজে গিয়ে নিজের অস্তিত্বটাই হারিয়েছে।
লেখক: ফারজানা ইসলাম ইতু
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০