শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ইতিহাস বহু পুরনো। নিজেদের অধিকার ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে পৃথিবীর নানা প্রান্তে অসন্তোষ ছড়িয়ে ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। যেকোনো অরাজকতার বিরুদ্ধে তরুণ সমাজের ফুঁসে ওঠার ঘটনা বহু প্রাচীন। ‘আন্দোলনরত’ বা ‘বিক্ষুব্ধ’ ছাত্র এ পরিচয়ের ভেতরে লীন হয়ে যায় জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গ ও জাতীয়তা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে ছাত্র সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে অগ্রগন্য। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সকল শৃঙ্খল, অন্যায়-অবিচার ও স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তির সুতিকাগার হয়ে উঠেছে ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের হাতে উঠলে বাঁশ বদলে যাবে ইতিহাস।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান
উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান। যে আন্দোলন পতন ঘটিয়েছিলো লৌহমানব আইয়ুব খানের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। আর মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষিত গভর্নর হাউস ঘেরাওয়ের মাধ্যমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি গঠন করা হয় ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ যারা ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১১ দফার মধ্যে ১৯৬৬ সালের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ৬ দফার সাথে ছাত্রদের সমস্যাকেন্দ্রিক দাবি দাওয়া এবং কৃষক-শ্রমিকদের স্বার্থকেন্দ্রিক দাবিসমূহ অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সময়োপযোগী এই পদক্ষেপের ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টিও সামনে আসে। সরকারি নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফুসে উঠা জনগণ ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসভা ও প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি হাতে নেয়। এ মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদউজ্জামান নিহত হলে গণজাগরণ রূপ নেয় গণঅভ্যূত্থানে। ২৪ জানুয়ারি গুলিতে নবম শ্রেনির ছাত্র মতিউর এবং ছুরিকাঘাতে নিহত হলে পরিস্থিতি সরকারের নাগালের বাইরে চলে যায়। সরকার সেনাবাহিনীর উপর শহরের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয় এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। গণঅভ্যূত্থানের শেষ প্রভাবক হিসেবে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। অবশেষে বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করেন এই গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে ২৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এতে করে গণঅভ্যূত্থান কিছুটা স্তমিত হলেও তৈরি হয় নতুন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্খা।
নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন
রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ শে মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ক্ষমতায় বসেই তিনি সামরিক শাসন জারি করেন। সেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে ওঠে ছাত্রসমাজ। ১৯৮৩ এবং ৮৪ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে সেনাবাহিনীর হামলায় নিহত হয় অনেক ছাত্রছাত্রী। এই ঘটনার পর থেকে এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর।
১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর জেহাদ নামক এক ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হলে সেই মৃত লাশকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র সংগঠকরা। ২৪টি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সমর্থনে গড়ে ওঠে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’। এর সাথে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা। ছাত্র সংগঠনের মিলিত শক্তির সামনে সেনাবাহিনী কার্যকর কিছু করে উঠতে পারেনি। ছাত্রদের আন্দোলনে জনগণ সমর্থন দেয়া মাত্রই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এবং গণঅভ্যূত্থানের মুখে ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ইতিহাসে ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন পুরোপুরি ছাত্রদের দৃঢ়তায় সফল হয়েছিল। সে সময় ছাত্ররা নিজ নিজ রাজনৈতিক নেতাদের আদেশ উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়েছিল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে। পতন ঘটায় এরশাদের।
চলমান ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলন
২০১৮ সালে এসে আবার গর্জে উঠেছে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বছরের প্রথমার্ধে শুরু হওয়া সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি সংস্কারের জন্য আন্দোলনে নামে ছাত্র সমাজ। সরকারের মিথ্যে আশ্বাসের সাথে যোগ হয় সরকারদলীয় ছাত্রলীগের হামলা। প্রকাশ্যে হামলা জঘন্য নিদর্শন প্রদর্শন করে তারা। পুলিশ এবং ছাত্রলীগের নির্বিচারে কোটা আন্দোলনকারীদের উপর হামলার কোন বিচারতো দূরের কথা উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয় সরকার। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাড় ভেঙ্গে দেয়া, নারীদের শ্লীলতাহানি, গভীর রাতে হল থেকে বের করে দেয়া, আহতদের বিনা চিকিৎসায় হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ার মতো ন্যাক্কারজনক কাজ করে ক্ষমতাসীনরা। এমনকি প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রাখেননি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।
অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ না হতেই রাজপথে নেমে আসে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর কুর্মিটোলায় বাস চাপায় সহপাঠী নিহতের ঘটনার প্রতিবাদে রাষ্ট্র মেরামতের কাজে হাত দেয় তারা। ফিটনেসবিহিন গাড়ি ভাংচুর, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহিন ড্রাইভারদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা ছাড়াও যানবাহনকে শৃঙ্খলিত করার দারুণ নিদর্শন প্রদর্শন করে তারা। কিন্তু সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাগড়া সরকারের। নৌপিরিবহন মন্ত্রী হেসে উড়িয়ে দেন মৃত্যুর ঘটনা, পরিবহন বন্ধ রাখে তার সংগঠন। বিতর্কিত ‘চুমু’ খাওয়ার বাক্য ব্যবহার করেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী। ছাত্রলীগের উপর দায়িত্ব দেয় আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের আর তাতেই বিধি বাম। ছাত্রলীগ ফেরে তার চিরচারিত চেহারায়। স্কুল পড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমন চালায়। পুলিশও সহযোগিতার হাত বাড়ায়। ছাত্রলীগ পুলিশ যৌথ হামলায় আহতের সংখ্যা অগণিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে দেশ।
ভয় নেই। আমাদের ছাত্র আন্দোলনের সফলতা ইতিহাস বদলে দেবার মতো। ইতিহাস বদলাবে। দেশে শৃঙ্খলা আসবে। একেকজন শিক্ষার্থী বারুদ হয়ে জ্বলে উঠবে। তাই ওদের সুরে বলতে চাই,
‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ,
যদি তুমি ঘুরে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করে পুনরায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক সমাবেশে মিলিত হয়। বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীরা ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘কে রাজাকার কে রাজাকার, তুই রাজাকার তুই রাজাকার’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাষ্ট্র কারও বাপের না’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘আমার স্বাধীন বাংলায়, একের কথা চলে না’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’ অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘হামলা-মামলা দিয়ে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না’ স্লোগান দিতে থাকেন।
ছাত্র আন্দোলন সব সময়ই সমাজ পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বিশ্ব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে ছাত্ররা তাদের অধিকার ও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছে। তাদের সংগ্রাম এবং ত্যাগের মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে এবং এর প্রভাব আজও বিদ্যমান।
লেখক
ইউসুফ আরমান
এডভোকেট
কলামিস্ট ও সাহিত্যিক
yousufarmancox@gmail.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০