স্টাফ রিপোটারঃ
হাওর জেলা সুনামগঞ্জে দীর্ঘ দেড় যুগ পর প্রকাশ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মীসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুনামগঞ্জের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশও জেলা জামায়াতের এই কর্মীসম্মেলন।
হাওর অধ্যুষিত এ জেলায় জামায়াতের কর্মী সম্মেলনকে ঘিরে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দু:শাসনের যাতাকলে পিষ্ট জামায়াত নেতা কর্মীরা মুক্ত স্বাধীন নতুন বাংলাদেশে কর্মীসম্মেলন করতে পেরে অনেকটাই উজ্জীবিত। কর্মীসম্মেলনকে ঘিরে সুনামগঞ্জের সর্বত্র ছিল উৎসবের আমেজ।
শনিবার (০১/০২/২৫) সকাল ১০ ঘটিকায় সুনামগঞ্জ শহরের সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে (বালুর মাঠ) সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা: শফিকুর রহমান বলেন, আমরা প্রতিশোধে বিশ্বাসী নই। তবে জাতিকে কলংকমুক্ত করতে সকল গুম খুনের বিচার হতে হবে। তিনি জামাত নেতা কর্মীদেরকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার জন্যও আহবান জানান।
আমীরে জামায়াত বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে আমাদের সবগুলো অফিস সিলগালা করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের নেতাকর্মীদের ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুম খুন নির্যাতন করা হয়েছে। আমাদের নেতাদেরকে বিচারের নামে ফাসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের প্রতি প্রতিশোধে বিশ্বাসী নই। তবে জাতিকে কলঙ্ক মুক্ত করার জন্য ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের আওতায় আনা দরকার।
ডা : শফিকুর রহমান আরো বলেন, জামায়াত একটি আদর্শবাদী সংগঠন। আমাদের নেতারা বালু মহাল, জল মহাল, হাটবাজার দখলে জড়িয়ে পরে না। তারা চাঁদাবাজি,টেন্ডারবাজি,
লুটপাটে বিশ্বাসী নয়। তারা জানে এসব কাজ হারাম। এটাই জামায়াতের নৈতিক শিক্ষা।
তিনি বলেন, যে দল বা যারাই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্বে জড়াবে তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে।
ডা. শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে জুলাই বিপ্লবে শাহাদাত বরনকারী সকল শহীদদের স্বরণ করে বলেন,যাদের জীবনদানে আমরা মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি তাদেরকে শ্রদ্ধার জায়গায় রাখতে হবে। তিনি নিরীহ মানুষের অযথা মামলায় হয়রানি না করার আহবান জানিয়ে বলেন, দেশটা সকলের, এদেশের সকল নাগরিক ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার ভোগ করবে। কিছু দুষ্ট লোকের জন্য আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে দেওয়া যাবেনা। ৫ আগষ্টের পর জামায়াত নেতাকর্মীরা টানা ১৫ দিন মন্দির -মঠ পাহারা দিয়ে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিয়েছে।
তিনি বলেন, একটি দল এদেশের সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। আবার তাদের দ্বারাই সংখ্যালঘুরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়।
সংখ্যালঘুদের উপর এসকল নির্যাতন নিপীড়ন বন্ধের জন্য আমি জাতিসংঘে চিঠি লিখেছিলাম।
নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করার জন্য তৎকালীন সরকারকেও একই চিঠি লিখেছিলাম।
সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করবে আওয়ামীলীগ আর দায় চাপাবে জামায়াতের উপর। এজন্যই তারা তদন্ত করে নাই।
আমীরে জামায়াত আরও বলেন, আগষ্টের ৩-৪ তারিখ সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে হত্যাযঞ্জ চালানো হয়। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। যাদের নাম পরিচয় এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। এখনও হাসপাতালে ২২২ জন পঙ্গুত্ববরণকারী, ৭শ জন দু’চোখ হারানো, একচোখ হারানো আরও ৫শ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে।
তাদের এই আত্মত্যাগের একটাই উদ্দেশ্য একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মান করা। এ কাজের জন্য জামায়াত নেতাকর্মীদের উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠতে হবে।
আমীরে জামায়াত বলেন, জামায়াতকে দেশ গড়ার দায়িত্ব দিলে একটি বৈষম্যহীন মানবিক রাষ্ট্র উপহার দেওয়া সম্ভব হবে।
প্রধান অতিথি ডা শফিকুর রহমান ৩০ বছর আগের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমার জীবনের প্রথম কর্মস্থল সুনামগঞ্জ। এই জেলার জামালগঞ্জ হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে প্রথম যোগদান করি।
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সুনামগঞ্জের মৎস্য, পাথর ও ধান সারাদেশে যোগান দিয়ে থাকে।
তিনি বলেন ২০০ বছর আগে বিদেশীরা এদেশে আসত রুজি রোজগারের জন্য। তখন শাসকরা দেশকে ভালবাসত। এখন আমাদের বিদেশে যেতে হয়। কারণ শাসকদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই।
দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার জন্য দেশ প্রেমিক নেতৃত্বের প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জামায়াত আমীর আরো বলেন, বিগত সরকারের আমলে যারা আমাদেরকে কথায় কথায় বিদেশে পাঠানোর কথা বলত তারাই আজ দেশ থেকে পালিয়ে অন্য দেশে চলে গেছে। শহীদদের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমাদের নেতাদেরকে যে জল্লাদ ফাঁসি দিয়েছিল সেই জল্লাদের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। যখন আমাদের নেতাদের ফাসির সংবাদ দেওয়া হয় তারা তা শুনে আলহামদুলিল্লাহ বলে দুই রাকাআত নামাজ পড়েন। পরিচ্ছন্ন পরিপাটি কাপড় পড়ে শাহাদাত আঙুলির ইশারায় ফাসিকে স্বাগত জানান। শাহাদাতের মর্যাদা পেতে উৎফুল্ল ছিলেন আমাদের নেতারা। আমাদের বাগানের সুন্দর ফুলগুলো দুনিয়ার কারো কাছে মাথা নত না করে হাসতে হাসতে ফাঁসিকে বরন করে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারী এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের সুনামগঞ্জের প্রয়াত সাবেক তিন জেলা আমীর আহমদ হোসাইন, আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সালেহ, হাতিমুর রহমানকে স্মরন করে বলেন, হাওরের জেলা সুনামগঞ্জ দেশের ২৩ ভাগ খাদ্য শস্য উৎপন্ন করে থাকে। এখানকার বালি, পাথর, মাছ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তবে সব দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে এই জনপদের মানুষ। দেশে যেন ফ্যাসিবাদী শক্তি আর ফিরে আসতে না পারে সেজন্য তিনি উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার সুনামগঞ্জবাসীর প্রতি আহবান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে, ঢাকা মহানগরী উত্তর জামায়াতের আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলে হাজার হাজার মানুষকে গুম খুন করা হয়েছে। জামায়াতকে রাজাকার জংগীবাদের ট্যাগ লাগিয়ে রাজনৈতিক অধিকার হরন করা হয়েছে। মিথ্যা মামলায় আমাদের নেতাদের ফাসির মঞ্চে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজ তারা নিজেরাই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বর্তমানেও একটি দল চাদাবাজি টেন্ডারবাজিসহ নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে পুরনো কায়দায় জামায়াতের নামে ট্যাগ লাগাতে চায়। কিন্তু পুরনো সেই চক্রান্ত আর কাজে আসবে না।
সিলেট মহানগরী জামায়াতের আমীর ফখরুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, দীর্ঘ আন্দোলনের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। কোন চাদাবাজ দখলদারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিবার জন্য নয়। তিনি নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যদিয়ে সুনাগরিক গঠনের কথা বলেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে জেলা জামায়াতের আমীর উপাধ্যক্ষ মাওলানা তোফায়েল আহমেদ খান জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, অধ্যাপক গোলাম আজম, আলী আহসান মোজাহিদসহ সংগঠনের সকল শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
কর্মীসম্মেলনে সুনামগঞ্জ জেলা জামায়াতের আমীর উপাধ্যক্ষ মাওলানা তোফায়েল আহমেদ খান এর সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এর সঞ্চালনায় কর্মী সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন সিলেট জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা হাবিবুর রহমান।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন হবিগঞ্জ জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা কাজী মখলিছুর রহমান, মৌলভীবাজার জেলা আমীর ইঞ্জিনিয়ার শাহেদ আলী, জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর এডভোকেট শামসউদদীন, সুনামগঞ্জ জেলা শ্রমিক কল্যান ফেডারেশনের সভাপতি মোমতাজুল হাসান আবেদ, সিলেট মহানগরী শিবির নেতা শাহীন আহমদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট শিশির মোহাম্মদ মনির, জামায়াত নেতা মাওলানা আব্দুস সালাম আল মাদানী, সাবেক দোয়ারাবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান ডা: আব্দুল কুদ্দুস, জেলা জামায়াত নেতা এডভোকেট ইয়াসিন খান, মাওলানা আব্দুস সাত্তার, নুরুল ইসলাম, এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন শামীম, সুনামগঞ্জ পৌর আমীর আব্দুস সাত্তার মামুন, তাহিরপুর উপজেলা আমীর অধ্যাপক রুকন উদ্দিন, দোয়ারাবাজার উপজেলা আমীর ডা: হারুনুর রশীদ, শান্তিগঞ্জ উপজেলা আমীর হাফেজ আবু খালেদ, বিশ্বম্ভপুর উপজেলা আমীর মুফতি হারিছ উদ্দিন, জেলা শিবির সভাপতি মেহেদী হাসান তুহিন, সিলেট জেলা পুর্ব শিবির সভাপতি মনিরুজ্জাম পিয়াস, ধর্মপাশা উপজেলা আমীর বুরহান উদ্দিন, জুলাই বিপ্লবের শহীদ আয়াত উল্লাহ এর পিতা সিরাজুল ইসলাম ও শহীদ সোহাগের পিতা আবুল কালাম প্রমুখ।
সম্মেলনে সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলা থেকে নেতা কর্মীরা লঞ্চ ট্রলার গাড়ি করে সম্মেলন স্থলে এসে জমায়েত হতে থাকেন। বেলা ১১টায় সম্মেলনস্থল কানায় কানায় পুর্ন হয়ে যায়। সুনামগঞ্জ শহর ও শহরতলী থেকে পোষ্টার ব্যানারসহ মিছিল নিয়ে সমবেত হন বিভিন্ন শাখার নেতা কর্মীরা। অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলিতে তোরণ নির্মাণ করে সুসজ্জিত করা হয়।