|| রাঙামাটি প্রতিনিধি ||
নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শনিবার (১২ এপ্রিল) সকাল থেকে সবুজ পাহাড়ের ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৩ দিনের ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক উৎসব বিঝু, সাংগ্রাই বিষু, বিহু, পাতা ও সাংক্রানের মূল পর্ব
শুরু হয়েছে।
প্রথা অনুযায়ী নারীরা বাহারি রঙের ঐতিহ্যবাহী পিনন-হাদি আর ছেলেরা ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে পানিতে ফুল ভাসানোকে ফুল বিঝু বলে। চাকমা, মারমা, তংচঙ্গ্যা এবং ত্রিপুরা রীতিতে শনিবার ভোরে রাঙামাটি শহরেরর রাজবন বিহার ঘাট এবং কেরানী পাহাড়ে কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ফুল ভাসিয়ে ফুল বিঝুর মাধ্যমে ৩ দিনের উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে।
এদিন সকাল সাড়ে ৬টার পর আনুষ্ঠানিকভাবে রাঙামাটির রাজবন বিহারে পূর্বঘাটে সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) কেন্দ্রীয় নেতা ঊষাতন তালুকদার, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমাসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও পাহাড়ি নারী-পুরুষ ও কিশোর- কিশোরীরা হ্রদের পানিতে ফুল ভাসিয়েছে।
একই নিয়মে শহরের গর্জনতলী, কেরানী পাহাড়, আসাম বস্তিসহ জেলার ১০ উপজেলায়ও নদী, হ্রদ, পাহাড়ি ঝিরির পানিতে ফুল ভাসায়। ফুল ভাসানো ও পূঁজোর সময় সকলেই পুরনো বছরের সব দুঃখ, কষ্ট ও গ্লানি মুছে নতুন বছরের সুখ শান্তি ও সম্মৃদ্ধি কামনা করে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সকল মানুষ।
রাঙামাটির রাজবন বিহারের পূর্ব ঘাটে ফুল ভাসাতে আসা মার্সি চাকমা বলেন, ‘বিঝু হলো, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান ঐতিহ্যবাহী উৎসব। আজকে হচ্ছে (১২ এপ্রিল) বিঝুর প্রথম দিন “ফুল বিঝু”। ফুল বিঝুতে আমরা পানিতে ফুল ভাসিয়ে মা গঙ্গা দেবীর কাছে সকলের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করি- পুরনো বছরের সব দুঃখ-গ্লানি দূর করে নতুন বছর যেন শান্তিতে কাটাতে পারি।’
পারমী চাকমা বলেন, খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পিনন-হাদিতে সেজে
ফুল নিয়ে পানিতে ভাসাতে এসেছি। কামনা করছি -পাহাড়ে যাতে আর কোন হানাহানি না ঘটে।’
চাকমা কালচারাল কাউন্সিল বাংলাদেশের (সিসিসিবি) প্রতিষ্ঠাতা লিটন চাকমা বলেন, ‘আমরা ভোরে বিভিন্ন বাড়ি থেকে ফুল সংগ্রহ করে নদী বা ছড়াতে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করে থাকি। এভাবে আমরা পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করি।
ফুল বিঝু অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কেন্দ্রীয় নেতা ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘বিঝু মানে চেতনা, বিঝু মানে আনন্দ-উচ্ছ্বাস। পুরাতন বছরের গ্লানি, দুঃখ, কষ্টকে ফেলে নতুন বছরে পার্বত্য অঞ্চেেচলর মানুষ যেন নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারি। সকলে মিলে গড়তে পারি সুন্দর বাংলাদেশ।’
রাঙামাটির জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বলেন, ‘উৎসবকে কেন্দ্র করে রাঙামাটি জেলা পুরোপুরি উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। আশা করছি উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে আগামীতে সৌহার্দ্য, সম্প্রতিকে আরও সুদৃঢ় করবে।’
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা চেঙ্গী, মাইনী, মাতামুহুরি, ফেনী নদী, কাচালং খাল, রাইংক্ষ্যং খাল, কর্ণফুলী নদী, কাপ্তাই হ্রদসহ পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝিরি-ছড়ায় ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে তিন জেলায় উদযাপিত হচ্ছে বর্ষবরণ। উৎসবের প্রথম দিনে বন থেকে ফুল আর নিমপাতা সংগ্রহ করে এবং পবিত্র এ ফুলগুলো কলা পাতায় ভাসিয়ে দেয় পানিতে। তাই এর নাম ফুল বিঝু। পানিতে ফুল ভাসিয়ে বিশ্ব শান্তির মঙ্গল কামনায় গঙ্গা দেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয়। যুগ যুগ ধরে
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন এ উৎসব পালন করে আসছে।
আগামীকাল রোববার(১৩ এপ্রিল) বিঝু উৎসবের দ্বিতীয় দিন মূল বিজু। এদিনে বাড়িতে বাড়িতে রান্না করা হবে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘পাজন’। মিষ্টান্ন, নানান পদের মাংস ও ফল ফলাদী।আর খাবারে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হবে। এর পরদিন বা উৎসবের তৃতীয় দিন হচ্ছে গজ্যাপজ্যা বিজু বা নববর্ষ উৎসব। এদিনে বিশ্ব শান্তির কামনায় বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে প্রার্থনা করেন পাহাড়িরা।
উল্লেখ্য যে, আগামী ১৬ এপ্রিল রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার বাঙালহালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মারমা জাতিগোষ্ঠীর সাংগ্রাই জলোৎসব বা জলকেলির মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হবে পাহাড়ের বর্ষবিদায় ও বরণের বর্ণাঢ্য এআয়োজন।#