হাছান মাহমুদ সুজন, কুতুবদিয়া (কক্সবাজার):
দেশের মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া।বাতিঘরের জন্য বিখ্যাত বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত এ জনপদের পুরোটায় যেন পর্যটনের বিশাল ক্ষেত্র।চট্টগ্রামের কর্নফুলী নদীর মোহনা থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিনে বঙ্গোপসাগরের কোলে কুতুবদিয়া দ্বীপের অবস্থান।মানচিত্রে কুতুবদিয়া দ্বীপ দেখতে অনেকটা মুরগির রানের মত।চারদিকে সাগর বেষ্টিত।কুতুবদিয়ার পশ্চিমে বিশাল আকারের বঙ্গোপসাগর,পূর্বে জাহাজ চলাচলের গভীর চ্যানেল,দক্ষিনে সাগর পেরিয়ে মাতারবাড়ির কয়লা বিদ্যুৎ এবং কক্সবাজারের পান ক্ষেতের জন্য বিখ্যাত মহেশখালী দ্বীপ,উত্তর দিকে সাগর পেরিয়ে বাঁশখালী।
এই দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে রয়েছে প্রায় ২২কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দৃষ্টিনন্দন সমূদ্র সৈকত। নানান রকম বৈচিত্র্য পরিপূর্ণ এই দ্বীপে রয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বায়ু-বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দু'টি বড় বড় স্টেড়িয়াম,দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, শুটকির আড়ত,সিটিজেন পার্ক,প্রতিটা ইউনিয়নে দীর্ঘ লবণ চাষ দৃশ্য,মৌসুমী ফল ও শাক সবজির ক্ষেত, রাতের অন্ধকারে নাবিকদের পথ দেখানো ঐতিহাসিক বাতিঘর,কালারমার মসজিদ,কুতুব শরীফ দরবার এবং কুতুব আউলিয়ার মাজার।দ্বীপের পশ্চিমে রয়েছে বিশাল জলরাশি,ঝাউবন ঘেরা সমূদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত। পর্যটকদের সব কিছুই যেন হাতছানি দিয়ে ড়াকছে এ কুতুবদিয়া দ্বীপে।
চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে সাগরের বুকে জেগে উঠে এই কুতুবদিয়া দ্বীপ ।এ দ্বীপে মানুষের পদচারণা শুরু হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে। কুতুব উদ্দীন নামের এক বুজুর্গ,পরহেজগার ব্যক্তি এ দ্বীপে আস্তানা স্থাপন করেন। পরবর্তীতে আরাকান থেকে বিতাড়িত মুসলমানরা যখন এই দ্বীপে আগমন শুরু করে তখন কুতুব উদ্দিন এদের আশ্রয় প্রদান করেন। শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে কুতুব উদ্দীনের নাম অনুসারে এ দ্বীপের নাম রাখা হয় " কুতুব উদ্দীনের দিয়া " যা পরবর্তীতে ‘ কুতুবদিয়া ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯১৭ সালে থানা হিসেবে গঠিত হয় এ কুতুবদিয়া দ্বীপ।পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে থানা থেকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়েছে।এ দ্বীপে ৬টি ইউনিয়নে রয়েছে ছোট ছোট ৩৫টি গ্রাম।
এই কুতুবদিয়া দ্বীপে রাতের অন্ধকারে গভীর সাগরের মাছ ধরার নৌকা এবং জাহাজের নাবিকদের পথ দেখানোর জন্য চান্স এন্ড ব্রাদার্স কোম্পানী লিমিটেড কর্তৃক বার্মিংহাম এর তত্ত্বাবধানে ক্যাপ্টেন হেয়ার-এর পরিচালনায় এবং ইঞ্জিনিয়ার জে.এইচ.টুগুড এর নকশায় ১৮৪৬ সালের দিকে ঐতিহাসিক সেই বাতিঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
উপমহাদেশের শ্রেষ্ট সাধক শাহ আব্দুল মালেক মহিউদ্দিন আল কুতুবী(রঃ) এর জন্ম এই কুতুবদিয়া দ্বীপে। সারা বছর জুড়ে প্রতিদিন শত শত পর্যটক /ভক্ত আসে মাজার জিয়ারতে।বাংলা বছরের ফাল্গুনের ৭তারিখ বার্ষিক ওরস্ ও ফাতিহায় দেশের ভিবিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হন এই কুতুব শরীফ দরবারে।ঐতিহাসিক কুতুব শরীফ দরবার ছাড়াও এখানে রয়েছে কুতুব আউলিয়ার মাজার।
গৌধুলী বেলায় দ্বীপের ঝাউবন সহ ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন সমূদ্র সৈকতে দেখা যায় সমূদ্রের গভীর থেকে ভেসে আসা কাছিম,লাল কাঁকড়া,শামুক, ঝিনুক, সমূদ্রের পানির উপরি ভাগে উড়ন্ত গাঙ্গচিল, বক, মাছরাঙ্গা।সন্ধ্যায় ঝাউবনের শো শো আওয়াজে সাড়া দেয় ভিবিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি।সমুদ্রের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সহ বৈচিত্রে ভরা বহু প্রজাতির চেনা অচেনা প্রাণী ৷ বিশাল বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির হালকা হালকা ঢেউয়ে যেন শীতল হয়ে যায় অশান্ত মন-প্রান। বিকেল বেলায় সাগরে জেগে উঠা বালির চরে ধুম পড়ে ফুটবল, ক্রিকেট সহ ভিবিন্ন প্রতিযোগীতার।এ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে মন রাঙ্গায় দ্বীপে আসা দেশি বিদেশি পর্যটকরা।
এক লক্ষ ত্রিশ হাজার লোকের আবাস এ কুতুবদিয়া লবণ ও শুটকি মাছের অন্যতম ক্ষেত্র।বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল কুতুবদিয়ায় লবণশিল্প বৃদ্ধি পাচ্ছে বছরের পর বছর। সমুদ্রের লোনা পানি দ্বারা ডিসেম্বর হতে মে মাস পর্যন্ত লবণ উৎপাদিত হয়ে থাকে।পূর্বে মাটির উপর লবনাক্ত পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রোদের তাপে লবণ উৎপাদন হলেও ২০০০-২০০১ সাল থেকে পলিথিন পদ্ধতিতে এ দ্বীপে লবণ উৎপাদন শুরু হয়।পর্যাপ্ত পরিমাণের লবণ উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে লবন রপ্তানি করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করে এ দ্বীপের চাষীরা।
অপরদিকে শীত মৌসুম শুরুর সাথে সাথেই এ দ্বীপে শুটকি তৈরির ধুম পড়ে। দ্বীপের ভিবিন্ন পল্লীতে বেড়ে উঠে শুটকি তৈরির আড়তে ব্যবসায়ি,মালিক ও শ্রমিকের ব্যস্ততা।বর্তমানে কুতুবদিয়ার শুঁটকির আড়ত গুলোতে বইছে শুটকির গন্ধ। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,প্রতিদিন সাগর থেকে আহরন করা নানান প্রজাতির মাছ আড়তে এনে কোনো প্রকার কীটনাশক ও লবণ মেশানো ছাড়া তৈরি হচ্ছে শুটকি।সূত্রমতে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম সম্ভাবনাময় এই শিল্পে বিদেশের বাজারে শুঁটকি রপ্তানির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন।এই উৎপাদনকৃত শুটকির দ্বীপে যেমন চাহিদা রয়েছে তেমনি দ্বীপের বাইরে সারা দেশে প্রচুর পরিমান শুটকি রপ্তানি হচ্ছে।
পর্যটন আর ব্যবসার জন্য অনন্য ক্ষেত্র এই কুতুবদিয়া।কিন্তু অযত্ন-অবহেলায় ব্যবসা আর পর্যটনে ক্ষেত্র হিসেবে কোন উন্নয়ন হচ্ছে না।দ্বীপের মানুষেরা বঞ্চিত আশার আলো থেকে।যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাবে ব্যবসা, কর্মসংস্থান যেমন সঠিকভাবে হচ্ছে না,তেমনি ক্ষতি হচ্ছে দ্বীপের অর্থনীতিরও।দেশি -বিদেশি পর্যটকরা বঞ্চিত হচ্ছে অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ থেকে।যুগ যুগ ধরে পর্যটন আর ব্যবসায়ের ক্ষেত্র হিসেবে এ দ্বীপের আলো এখন নিভু নিভু।
যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বৈদ্যুতিক উন্নয়ন হলে পর্যটক বাড়বে এবং এখানকার মানুষ ও সরকার আর্থিক ভাবে লাভবান হবে বলে মন্তব্য করেন দ্বীপের সচেতন মহল।কুতুবদিয়ার ভাগ্য পরিবর্তনে প্রয়োজন বিদ্যূৎ এবং টেকসই বেড়িঁবাধ।কুতুবদিয়া রক্ষার্থে বিশাল বেড়িবাঁধের নির্মাণ কাজ চলমান হলেও বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপনের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে না এ দ্বীপের মানুষ।সরকারি বেসরকারি ভাবে আর্থিক সহযোগীতা পেলে দেশের দক্ষিনাঞ্চলে পর্যটন ও ব্যবসায়ের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠবে এ দ্বীপ।
কুতুবদিয়া দ্বীপে ভ্রমণে যাওয়ার উপায়;
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট কিংবা নতুন ব্রিজ থেকে কক্সবাজারের বাসে উঠে মাঝ পথে যাত্রা বিরতি স্থান ইনানী রিসোর্টের এক কিলোমিটার সামনে বড়ইতলি মোড়ে নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি যোগে যেতে হবে মাগনামা ঘাট। ভাড়া জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা। মাগনামা ঘাট থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হতে হয় ইঞ্জিন নৌকা অথবা স্পিড বোটের মাধ্যমে।মগনামা ঘাট থেকে বড়ঘোপ স্টিমার ঘাট এবং দরবার ঘাট দিয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপে প্রবেশ করা যায়। উভয় ঘাট দিয়ে দ্বীপে পৌছতে ইঞ্জিন নৌকায় সময় লাগে ২০-২৫ মিনিট, ভাড়া ৩০ টাকা। আর স্পিডবোটে সময় লাগে ১০ মিনিট, ভাড়া ৮০ টাকা। চ্যানেল পার হলেই কুতুবদিয়া। এছাড়া চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এবং নতুনব্রীজ বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি এস আলম, সান-লাইন বাস যায় মাগনামা ঘাটে। ভাড়া চট্টগ্রাম থেকে জনপ্রতি ১৫০ টাকা।
কুতুবদিয়া দ্বীপে আসা পর্যটকদের থাকার জন্য মানসম্মত একমাত্র অফার ব্যবস্থা হল হোটেল সমুদ্র বিলাস,হোটেল বেলাভুমি বড়ঘোপ বাজার।হোটেলে বসে উপভোগ করা যায় সমুদ্রের অপরুপ সৌন্দর্য।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০