নির্মল এস পলাশ, কমলগঞ্জ প্রতিনিধি
সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য্য নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত কমলগঞ্জ। সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে দেশি-বিদেশি পর্যটকের পদভারে সারাবছর মুখরিত থাকে।
ঈদুল ফিতরের ছুটিতে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভূমি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ।
যেদিকে চোখ যায় কেবল সবুজের সমোরোহ। চা - বাগান, বন অরণ্য। উচু - নীচু টিলার ওপর থেকে চোখ জুড়ানো এক অপরূপা দৃশ্য দেখা মেলে বনের নীল রেখা। অনেক দূরে দিগন্তে নীল রেখা যেন ছুঁয়েছে আকাশের সীমানা। জল পাহাড়, চা-বাগান, আর বুনো নির্জনতার আমেজ। প্রকৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন।
কমলগঞ্জে যেমন বনভূমি রয়েছে; তেমনি রয়েছে অসংখ্য প্রকৃতিক হ্রদ - লেইক পদ্মঝিল। পাশাপাশি আদিবাসী খাসিয়া, মণিপুরী, গারো, ত্রিপুরা - সাওতাল সহ প্রায় ২৫ টি নৃগোষ্ঠী ও বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের বৈচিত্র্যময় কৃষ্টি, সাংস্কৃতি, জীবনধারা।
চা শিল্পের সুনাম ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। ৪২৬.৭২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জনপদের সাথে রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে সারাদেশের। চা, , লেবু, পান, আনারস ও মূল্যবান কাঠের জন্য কমলগঞ্জ ব্যাপক পরিচিতি। শস্য ভাণ্ডার হিসাবে খ্যাাতি রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান জাতীয় উদ্যানের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অপার লীলা ভূমি কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সংরক্ষিত বনাঞ্চল পশুপাখি, বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাস স্থল। এ উদ্যানে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবুজ বৃক্ষরাজি। বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় জীব উল্লুকসহ কয়েকটি জন্তু ও বিলুপ্ত প্রায়।
জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণি ও নান্দনিক সৌন্দর্যের অন্যতম স্থান লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। মিশ্র চিরহরিৎ এ বনভূমিতে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির জীব। রয়েছে ১৬০ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভচর প্রাণি, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি, ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি।
রয়েছে টিলাঘেরা সবুজ চা বাগান, ত্রিপুরা সীমান্তর্বর্তী ধলই চা - বাগানে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, ছায়া নিবিড় পরিবেশে অবস্থিত নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, ঝর্নাধারা হামহাম জলপ্রপাত, মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, ডবলছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, শিল্পকলা সমৃদ্ধ মণিপুরীসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবন ধারা ও সংস্কৃতিসহ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সবুজ জনপদ যা আপনার মন ও দৃষ্টি কেড়ে নেবে।
উপজেলার মাধবপুর চা বাগানে নয়নাভিরাম মনোরম দৃশ্য মাধবপুর লেক ভ্রমন পিপাষু মানুষের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখানকার পাহাড়ি উঁচু নিচু টিলার মাঝে দৈর্ঘে প্রায় ৩ কিঃমিঃ পানির হ্রদ ও তার শাখা প্রশাখা, চারপাশে পাহাড়ি টিলার উপর সবুজ চা বাগানের সমারোহ, জাতীয় ফুল দুর্লভ বেগুনী শাপলার আধিপত্য, ঝলমল স্বচ্ছ পানি, ছায়া নিবিড় পরিবেশ, শাপলা শালুকের উপস্থিতি আনন্দের বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে। এক দিনেই মাধবপুর লেকের দৃশ্য উপভোগ করে বেরিয়ে এসে একই রাস্তায় প্রায় ১০ কিঃমিঃ যাওয়ার পরই বীরশ্রেষ্ট শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ ঘুরে আসা যাবে। এখানে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক, দর্শনার্থী ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন এ স্মৃতিসৌধ দেখতে আসছেন।
এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়ে বিট্রিশ আমলে গড়ে উঠেছে কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরে বিশালাকার বিমান বন্দর। বর্তমানে এখানে আরটিএস (রিক্রুট ট্রেনিং) স্কুল স্থাপন করায় ভেতরে প্রবেশ করে ভ্রমন করা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। শমশেরনগর বিমান বাহিনী ইউনিট এলাকায় পতিত ভূমিকে কাজে লাগিয়ে কাঁঠাল, আনারস, লিচু, কুল, ধান, আলুসহ নানা জাতের ফল, কৃষি ও মৎস্য খামার গড়ে তোলা হচ্ছে। শমশেরনগর বিমান বাহিনীর সংরক্ষিত এলাকা সংলগ্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমির উপর একটি স্মৃতি সৌধও নির্মিত হয়েছে।
ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী দূর্গম পাহাড়ি এলাকা ডবলছড়া। ত্রিপুরা থেকে উৎপত্তি হওয়া একটি পাহাড়ি ছড়ার নামে স্থানটির নাম হয়েছে বলে জানা যায়। ডবলছড়া খাসিয়া পল্লী যেতে পাহাড়ি উঁচু নিচু কাঁচা ১২ কিঃমিঃ রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। পথিমধ্যে শমশেরনগর চা বাগানের দু’টো প্রাকৃতিক হ্রদ, একটি গলফ মাঠ ও ক্যামেলিয়া ডানকান হাসপাতাল যে কোন পর্যটকের নজর কাড়বে। অপরূপ সৌন্দর্য্যে আধার ডবলছড়া খাসিয়া পল্লীটি পাহাড়ি টিলার উপর ঘর করে বসবাস করছে খাসিয়া জনগোষ্ঠীর লোকজন। ছোট একটি গ্রাম খাসিয়া পুঞ্জি দেখতে খুবই সুন্দর।
কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিঃমিঃ পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি বন রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকার প্রায় ১০ কিঃমিঃ অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাত। স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীরা এ জলপ্রপাত ধ্বনিকে হামহাম বলে। তাই এটি হামহাম নামে পরিচিত। সেখানে সরাসরি যানবাহন নিয়ে পৌঁছার ব্যবস্থা নেই। রাস্তায় স্থানীয় বাস, সিএনজি, জিপ ও মাইক্রোবাসে যেতে হয়। বাকি ১০ কিঃমিঃ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সেখান থেকে প্রায় ৫ কিঃমিঃ দূরে সীমান্ত এলাকায় ত্রিপুরা আদিবাসী পল্লী। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তৈলংবাড়ী কলাবন বস্তি থেকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হতে হবে। প্রায় ৬ কিঃমিঃ পাহাড় টিলা ও ২ কিঃমিঃ ছড়ার পানি অতিক্রম করে ৩ ঘন্টা পায়ে হাঁটার পর ১৬০ ফুট উচ্চতার হামহাম জলপ্রপাতের দেখা পাওয়া যাবে। হামহাম জলপ্রপাত ভ্রমণ করতে পুরো একদিনের প্রয়োজন।
এছাড়াও ভ্রমণের জন্য রয়েছে মণিপুরী অধ্যুষিত আদমপুর মাঝেরগাও গ্রামে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম একদম গ্রামীণ এক জীবনধারা ছোয়া। কমলগঞ্জে পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের নিরব স্বাক্ষী বিভিন্ন বধ্যভূমি, ব্রিটিশদের শোষনের প্রতীক তিলকপুর নীলকুটি, ঘটনাবহুল মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ড, বর্নময় শিল্পসমৃদ্ধ মনিপুরী সম্প্রদায়সহ টিপরা, খাসিয়া, গারো সমাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এলাকা সমূহ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০