কাপাসিয়া (গাজীপুর) থেকে শামসুল হুদা লিটন :
ইছব আলী তখনো জানেনা কোথায় তার গন্তব্য…। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা স্বিকার করে মানবতার অনন্য ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মানসুর শিকদার। স্ত্রী শিল্পী বেগম ও তার ৫ সন্তান নিয়ে রাত পোহানোর আগেই বাড়ি ভিটা ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লো অনিশ্চিত ঠিকানার সন্ধানে। ব্যাটারী চালিত অটোরিক্সা চালক তাকে গাজীপুরের শ্রীপুরের সোনাকর গ্রাম থেকে কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদ গেইটে নামিয়ে দিয়ে গেলো। বলে গেলো, এখানে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। গত সোমবার ভোরে ৭ সদস্যের পরিবার নিয়ে ইছব আলী নামে এক ব্যক্তি খোলা আকাশের নিচে বসেছিল। এ প্রতিবেদক জিজ্ঞেস করতেই ৪৫ বছর বয়সের ইছব আলী বললো, গত প্রায় এক বছর আগে তার স্ত্রী শিল্পী বেগম রান্না করার সময় আগুন লেগে তার শরীরের বেশীর ভাগ অংশ ঝলসে গিয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে আছে। দীর্ঘ আট মাস ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরলেও তার স্বামী ইছব আলী বাড়ি ভিটে রক্ষা করতে পারেনি। বাড়ি ভিটা সহ এক বিঘা সম্পত্তি ১৭ লাখ টাকায় বিক্রি করে সব টাকাই তার স্ত্রী শিল্পী বেগমের চিকিৎসা বাবদ খরচ করেছে। সহায়-সম্বলহীন ইছবের ভিটেবাড়ি ছেড়ে চলে যাবার ছয় মাস পেরিয়ে গেলে জমি ক্রেতা তাকে আর সময় না দেয়ায় অনিশ্চিত যাত্রা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। দিনমজুর হলেও আতœসম্মান নিয়ে তাই সে স্ত্রী শিল্পী বেগম (৩৮), ৪ পুত্র খায়রুল (১৫), রাজীব (১১), আল-আমীন (৫), দেড় বছরের আলম ও ১ কন্যা বৈশাখী (৮)সহ এলাকা ছেড়ে চলে এসেছে। লোক-লজ্জার ভয়ে হাড়ি-পাতিল যা ছিল তা নিয়েই পৈত্রিক বাড়িভিটা ফেলে নতুন ঠিকানার সন্ধানে চলে এসেছে।
শ্রীপুরের সোনাকর গ্রামের মৃত: আব্দুল মোতালিবের একমাত্র পুত্র ইছব আলীর সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতায় যা জানা গেছে, তাতে বুঝা গেছে সে একজন আদর্শ কৃষক। কৃষি কাজের সব কিছুই তার জানা আছে। এক সময় তাদের জায়গা-জমি, হাল-গরু সবই ছিল। সময়ের ব্যবধানে আজ সে নিস্ব:। এসময় পাশে দাঁড়িয়ে মানসুর শিকদার নামে একব্যক্তি আগ্রহভরে সবকিছু শুনছিলো। একপর্যায়ে চলে আসতে চাইলে মানসুর আমার পথরোধ করে বলেন, এখন ওরা যাবে কোথায় ? কোথায় থাকবে, ছোট ছোট বাচ্চারা কি খাবে ? তার আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছিল, মানসুর হয়তো মানবিক কারনে তাদের আশ্রয় দিতে চায়।
মানসুর শিকদারের বাড়ি উপজেলার রায়েদ ইউনিয়নের আমরাইদ বাজার এলাকায়। বাড়ি, জায়গাজমি, মার্কেট ও বিত্তশালী হলেও ছেলে মেয়ের পড়া-লেখার সুবিধার জন্য পরিবার পরিজন নিয়ে কয়েক বছর যাবত উপজেলা সদরে বসবাস করছেন। তাই অসহায় ইছব আলীকে দেখে তাকে আশ্রয় দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। যেই কথা সেই কাজ। পৈত্রিক বাড়িভিটার ঠিকানা নিশ্চিত করার শর্তে প্রস্তাব দেয়ার সাথে সাথে ইছব আলীও রাজি হয়ে গেলো। সকাল দশটার দিকে একটি অটোরিক্সা নিয়ে মানসুর তাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেলো। বিভিন্ন ফল-ফলাদির গাছ ও শাক-সবজির বাগান ঘেরা বিশাল ফাঁকা বাড়ি দেখে ইছব আলীর স্ত্রী-সন্তানরা তো মহাখুশি। ওদের আগ্রহ দেখে মনে হলো বাড়িটি যেন তাদের অনেক চেনা। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা পুরো বাড়িটিকে আপন করে নিলো। সবাই মিলে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, অতপর কাকতালিয় ভাবে আশ্রয় এবং কাজের সংস্থান হওয়ায় মহান আল্লাহ্তালার নিকট শুকরিয়া আদায় করেন। বিশেষ করে আশ্রয়দাতা বাড়ির মালিক মানসুর শিকদারের পরিবারের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তাদের একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই এবং এতোটুকু প্রাপ্তিতে সীমাহীন মহাখুশিতে তাদের চোখের কোনে আনন্দঅশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সেই দৃশ্য দেখে যে কারো চোখের পানি ধরে রাখার কথা না।