আলো আরজুমান বানু একজন কবি,গবেষক ও শিক্ষক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক।
আলো আরজুমান বানু কবিতা লিখেন মিতা আলী নামে। কবিতা ছড়াও ছোটগল্প লিখেন। ইতোমধ্যে তাঁর একটি গবেষণা গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। তবে মিতা আলীর প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র কবিতার জগতেই। একক ও যৌথভাবে লিখিত তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চারটি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাহিত্য সাময়িকীতে তার কবিতা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি কবি মিতা আলী নিউজ ভিশনের সাহিত্য পাতার মুখোমুখি হয়ে তার ব্যক্তি এবং কবি জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেন।
নিউজ ভিশনের সাহিত্য বিভাগের পক্ষে কবি মিতা আলীর একান্ত সাক্ষাৎকার নেন নাজমুস সালেহীন বিন সাইফ।
প্রশ্ন: কেমন আছেন ? আপনার লেখালেখি কেমন চলছে?
মিতা আলী: ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। আসলে যারা লেখালেখি করে তাদের লেখালেখি কখনো থামে না। তো সেই অর্থে লেখালেখি চলছে । তবে হ্যাঁ, এখন লেখা একটু্ কচ্ছপ গতিতে চলছে বলতে পারেন। কারণ চাকরি ছাড়াও পরিবারে আমার অনেক দায়িত্ব ।এরই ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু পারি লেখালেখি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করি ।
প্রশ্ন: একটি কথা প্রচলিত আছে যে তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে তরুণ সমাজ ক্রমশ সাহিত্যপাঠ বা বই বিমুখ হয়ে পড়ছে। তারা এখন কবিতা আর উপন্যাস পড়ার পরিবর্তে স্মার্ট ফোন নিয়ে ব্যস্ত । এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।
মিতা আলী: তথ্য-প্রযুক্তি এখন মানুষের জীবনের বাস্তবতা। আমাদের নিত্য জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ। কেবল তরুণরাই নয়, সকলেই এর দ্বারা প্রভাবিত। এর নেগেটিভ এবং পজেটিভ দুটো দিকই আছে। তথ্য প্রযুক্তিকে তরুণ সমাজ সবসময় নেগেটিভ ভাবে ব্যবহার করছে এমনটা মনে করি না। পজিটিভ অর্থে এভাবে যে, এখন অনলাইনে ইচ্ছে করলেই খুব সহজেই কবিতা, উপন্যাস তথা সাহিত্যের ভুবনে প্রবেশ করা যায়। আগ্রহী হলে যে কেউ সাহিত্যের রসাস্বাধন করতে পারে। আর যদি আমাদের কথা বলেন, ঐ সময় বইয়ের জন্য আমাদের দৌড়াতে হতো, তারপর জোগাড় করতে পারলে সেটি পড়তে পারতাম। সেইদিক থেকে কিন্তু আজকের তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে আছে। আপনার দ্বিতীয় কথাটার সাথে পুরোপুরি একমত নই। তরুণ কিংবা পাঠকরা যদি বই বিমুখ হতো প্রতি বছর বই মেলায় বা সারা বছর এত বই বিক্রি হতো না । আর রকমারির মতো অনলাইন বই যোগানদাতা অনেক প্রতিষ্ঠান এখন গড়ে ওঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান তথ্য প্রযুক্তির ফসল। এর ব্যবহার করে মানুষ এখন ঘরে বসে বই সংগ্রহ করে পড়ছে।
প্রশ্ন: আপনিতো ইতিহাসের ছাত্রী। কবিতা লেখার প্রতি আপনার ঝোঁক কিভাবে তৈরি হলো? কিংবা যদি বলি ,বাংলা সাহিত্যের কোন কবির লেখার প্রেমে আপনি বিশেষভাবে পড়েছিলেন?
মিতা আলী: আপনার প্রথম প্রশ্নটার উত্তরে বলতে চাই যে, আমার দুই মামা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছিলেন। আমাদের সময় এসএসসি পরীক্ষার পর ফলাফল প্রকাশ হতে প্রায় তিন মাস সময় পাওয়া যেতো। এই সময় মেজো মামা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে আমাদের তার সব বই আমাদের বাসায় নিয়ে এলন। তার সংগৃহীত বইয়ে আমাদের বাসার একটা রুমের অর্ধেক অংশ ঠাসা হয়ে যায় । এর ফলে চর্যাপদ থেকে শুরু করে বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলসহ অনেক দেশি-বিদেশি কবি সাহিত্যিকের রচিত সাহিত্য সম্ভার হাতের কাছে পেয়ে গেলাম। আমাদের সময় এমন প্রযুক্তি ছিল না, যে অনলাইনে সময় কাটাবো। ঐসময় একটা প্রচলন ছিলো মেয়েরা বড় হলে বাইরে যেতে পারবে না। এ কারনণ ওই তিন মাস আমার বাংলা সাহিত্যের সাথেই কেটেছে। বই পড়ার অভ্যাস আমার ছোট বেলা থেকেই ছিল। কিন্তু এবার যে সুযোগটা পেলাম, এর ফলে সাহিত্যের বন্ধনেই আমি আবদ্ধ হয়ে গেলাম।
আর বিশেষ কোনো কবির কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম এমনটা নয়, রবীন্দ্র কাব্য যেমন ভালো লাগতো, তেমনি নজরুল বা জসিমউদ্দিনের কবিতাও। সুফিয়া কামালের কবিতারও মুগ্ধ পাঠক ছিলাম।
প্রশ্ন: কবিতা লেখা শুরু কবে থেকে? আপনার এ পর্যন্ত কোন কোন বই বের হয়েছে? ভবিষ্যত পাঠকদের জন্য আপনি কি ভাবছেন?
মিতা আলী: কবিতা লেখা শুরু মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময়ই। স্কুল ম্যাগাজিনে আমার কবিতা প্রকাশিত হতো প্রতিবারই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রোকেয়া হলে হল ম্যাগাজিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপা হতো। এসময় আবৃতিও করতাম। কণ্ঠশীলনের সাথে যুক্ত ছিলাম।আমার প্রথম কবিতার বইটি ছিল যৌথ কাব্য গ্রন্থ। সবুজ অঙ্গন নামে ১১ জন কবির একটি কাব্য সংকলন ছিল এটি। প্রথম একক গ্রন্থটি একটি গবেষণা গ্রন্থ। গ্রন্থের শিরোনাম মুন্সি মহম্মাদ মেহেরুল্লাহ: ধর্মসেবা সমাজ চিন্তা ও সাহিত্য সাধনা। এটা আমার এমফিলের গবেষণা অভিসন্দর্ভের পরিমার্জিত গ্রন্থরূপ। আমার দুটো একক কাব্য গ্রন্থ হলো অনিবার্যের অনুরণন এবং তুমিময়তা। যৌথভাবে রচিত কাব্যগ্রন্থটির শিরোনাম স্বপ্নচারী হেমলক পিয়াসী। এতে আমার সাথে আছেন কবি সুমাইয়্যা বুলবুল।
পাঠকদের জন্য ভালো কিছু লিখতে চেষ্টা করছি। আর আমি মনে করি, মানুষের জন্য বইয়ের চেয়ে ভালো বন্ধু আর কিছু হয় না । দেখুন, ব্যক্তিগতভাবে আমি যখন কোনো কারণে বিষন্ন হই, তখন যদি একটা ভালো বই পড়তে পারি, তাহলে আমি সবকিছু ভুলে যাই। তো আমি একদম মন থেকে চাই যে, আমি এমন কিছু লিখি যা পড়ে পাঠক আমার মতো মানসিক প্রশান্তি অনুভব করবে, বিষন্নতা দূর হবে এবং তাদের মনটা ভালো হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নিয়ে লিখে যাচ্ছি, পত্র-পত্রিকা, সাহিত্য-সাময়িকী এবং এমনকি সোস্যাল মিডিয়াতেও তা প্রকাশ করছি। আশা করছি আমার লিখাগুলো মলাটবদ্ধ কাব্যগ্রন্থকারে পাঠকদের হাতে তোল দেয়ার।
প্রশ্ন: আপনার তুমিময়তা কাব্য বের হয়েছে। সেখানে “গ্রামের ছায়া ” কবিতার শেষ লাইন ছিল “সবুজ মনে সবুজ গ্রামের সেই ছবিটি আঁকি”।সবুজ মন দিয়ে আপনি কি বুঝিয়েছেন?
মিতা আলী: সবুজ মন মানে তারুণ্য ও সজীবতা-সহজ ও সারল্য । ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি ক্যাম্পাসেই আছি। সবুজ তারুণ্যের সাথেই আমার বাস, আমার নিত্য-দিনের কাজ কারবার । আমি পড়াই স্কুল ও কলেজে। তো সব সময় আমি তরুণদের সাথে থাকি। ওদের মনের সরলতা বা ওদের মনের যে সজীবতা এটাই মূলত বুঝিয়েছি।
প্রশ্ন: যৌথভাবে রচিত আপনার আরেক কাব্যগ্রন্থ স্বপ্নচারী হেমলক পিয়াসী এর বসন্ত আবহ কবিতায় আপনি লিখেছেন “করোজ্জ্বল দিন ব্যর্থ হলো কালো মেঘের মিতালীতে”। এর মানে কি?
মিতা আলী: করোজ্জ্বল দিন মানে ঝকঝকে একটা দিন, একদম রবির ছায়া। ধরুন, আমরা যখন কোন কিছু নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে আগাই সেটা ভালোবাসা, ভালো কাজ, ভালো চিন্তা হতে পারে, কিন্তু সেইগুলো অনেক সময় শেষ পর্যন্ত ইতিবাচকতায় শেষ হয় না। সেটা অনেক ক্ষেত্রে কালো একটা আঁধারে ঢেকে যায়। আমার কবিতার এই লাইনটাতে আমি এমন একটা প্রতিকূল অবস্থার কথাই বুঝিয়েছি ।
প্রশ্ন: একই কাব্যগ্রন্থের ‘কর্মজীবী নারী’ কবিতায় আপনি লিখেছেন “আমরা ভূমি আমরা নারী একই আধারী, একে অন্যের হাতিয়ার হই সকল বিভেদ ভুলি। ” এর ভাবার্থটা আসলে কী?
মিতা আলী: কর্মজীবী নারী বলতে গৃহ পরিচারিকা থেকে শুরু করে গৃহিণী, এমনকি কর্পোরেট জগতের উচ্চপদাধিকারী থেকে রাষ্ট্র প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় সকল নারীকেই বুঝিয়েছি। একজন নারী সে যে কাজই করুক না কেন, পারিবারিক জীবনেও তাকে নানা দায়িত্বপালন করতে হয়। এত কিছু করেও নারীরা সবসময় তার যথার্থ মূল্যায়নটা পায় না। সমাজে অবহেলার শিকার হন তারা। আমি মনে করি নারী হিসেবে সমাজের এই সাপোর্টটা দেওয়া উচিত। মানে আমরা সবাই এক। আমরা আমাদেরকে যেন সাহায্য করি এটাই মূল কথা।
প্রশ্ন: কাব্য রচনার পাশাপাশি আপনি ইতিহাস বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থও রচনা করেছেন। আপনার রচিত মুন্সি মহম্মাদ মেহেরুল্লাহ: ধর্মসেবা সমাজ চিন্তা ও সাহিত্য সাধনা গ্রন্থটি ২০১৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ইতিহাস সচেতন পাঠকদের জন্য কেন তাঁকে অধ্যয়ন করা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
মিতা আলী: মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ডিগ্রি প্রাপ্ত ছিলেন না। তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একজন নায়ক হিসেবে তাকে স্মরণ করা জরুরি। বর্তমান সময়ে তো আরো বেশি দরকার। পেশাগত জীবনে একজন দর্জি ছিলেন তিনি। ওইখানে তখনই তিনি ইংরেজ মিশনারিদের বিরুদ্ধে তার নিজের ধর্মের পক্ষে কথা বলেছেন। নিজের স্বজাতির সামাজিক দুরাবস্থার কথা তুলে ধরে প্রতিকারের চেষ্টা করেছেন। এসব কাজের নিমিত্ত হিসেবে মানুষের মাঝে বক্তব্য রেখেছেন, কলমযুদ্ধ করেছেন, রচনা করেছেন সাহিত্য। আজকের দিনের সমাজ বাস্তবতায় অন্যায়, অবিচার, অনৈতিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে এমন সোচ্ছার প্রতিবাদী মানুষের প্রয়োজন। এখানেই আমার আলোচ্য গ্রন্থটির গুরুত্ব। বস্তত একটি দেশপ্রেমিক জাতি গঠনের জন্য এ ইতিহাস আপনাকে পড়তেই হবে। কারণ অতীতই আমাদের ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করবে।
আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মিতা আলী: আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০