--
অধ্যাপক ড. এ টি এম সামছুজ্জোহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। চীনে পিএইচডি করার সুবাদে তিনি দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করেছিলেন। ড. জোহার পিএইচডি ছিলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে। বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের ভূমিকা বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় দেশটির প্রভাব ও তথাকথিত ঋণ ফাঁদ তত্ত্ব নিয়ে তিনি নিউজ ভিশনের সাথে কথা বলেছেন।
তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক মোঃ জামিন মিয়া।
নিউজ ভিশন: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বা আফগানিস্তানের ক্ষমতার পালাবদলে বিশ্ব রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এক্ষেত্রে চীন কতটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে?
ড. জোহা: আপনি বিশ্ব রাজনীতির আমূল পরিবর্তনের কথা বললেন। দেখুন, চীন কিন্তু নিজেকে নিয়েই এখন ব্যস্ত। এই যুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই দেশটি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলো। কারণ সে সময় চীন একটা পর্যবেক্ষণমূলক অবস্থায় ছিলো। এর আগেও আমি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম যে, চীন যুদ্ধে জড়াবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত দেশটি নিজে আক্রান্ত হয়। বলতে গেলে চীনের "কমন ইন্টারেস্ট" যতক্ষণ না পর্যন্ত বিঘ্নিত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত দেশটি এটি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। খেয়াল করুন, প্রায় সাত-আট মাস হয়ে যাচ্ছে চীন কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেনি। অন্যদিকে একটা বিষয় লক্ষনীয়, কিছুদিন আগে রাশিয়া এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয়ের বৈঠকের পর সংবাদ মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতির জন্য একটা বার্তা দেয়া হয় যে, "উই (চীন-রাশিয়া) আর ইউনাইটেড"। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র যে রকম ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিরোধীদের বার্তা দিচ্ছে তেমনি তারাও এরকম একটা অবস্থান এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। আমার মনে হয় যেহেতু বেইজিং প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি সেই জায়গা থেকে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
নিউজ ভিশন: পশ্চিমা বিরোধী জোটের প্রথম কাতারে চীনের মতো রাশিয়াও আছে। সম্প্রতি এশিয়ান টাইমসের একটা নিবন্ধে অনেকটা ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে কেবল ইরান এবং উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার বন্ধু। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
ড. জোহা: আপনি জেনে থাকবেন, পশ্চিমা মিডিয়াগুলো নানা সময়ে একপাক্ষিক সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। বাংলাদেশের প্রথম সারির কিছু মিডিয়ার দিকে তাকালে দেখবেন যে, তারাও সেখান থেকে প্রভাবিত হয়ে সংবাদ প্রচার করে। বাস্তবতা কি তাই? আমার তো সেটা মনে হয় না। দেখুন, ইরান রাশিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে- ড্রোন দিচ্ছে; চীন মস্কোর সাথে পুরোদমে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি ভারতের কথা বলি, তারাও রাশিয়ার সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রেখে চলছে এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্বশেষ সফরে রাশিয়া থেকে ভারত আরো আমদানি-রপ্তানির আগ্রহ দেখিয়েছে এবং শুধু তাই নয় ওয়াশিংটনের চোখ রাঙানি সত্ত্বেও দিল্লি পণ্য আমদানি করে যাচ্ছে। এছাড়া আপনি তুরস্কের দিকে লক্ষ করুন, রিসেপ তায়িপ এরদোগানের সরকার কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার খাদ্য শস্যবাহী জাহাজ পরিবহনের চুক্তিতে মধ্যস্ততা করেছে এবং এ চুক্তি কিছুটা ব্যত্যয় ব্যতীত অনেকটা সফলও হয়েছে। এরদোগান সরকারের আমলে তার্কির সাথে রাশিয়ার একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলেই দেশটির মধ্যস্থতা রাশিয়া মেনে নিয়েছে। এমনকি ভেনিজুয়েলা বা কিউবাও মস্কো বলয়ের বাইরে নয় কেননা রুশদের সাথে এদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ চলমান আছে। বলতে গেলে তা এখন শক্ত অবস্থায় আছে। ফলে উত্তর কোরিয়া বা ইরানের কথা যেটি বলা হয়েছে এটি পশ্চিমা মিডিয়ার একটা প্রোপাগান্ডা বলেই মনে হচ্ছে।
নিউজ ভিশন: আপনি রাশিয়া থেকে ভারতের পণ্য আমদানি করার কথা বললেন। কিন্তু এই জায়গায় ঢাকা কেন সরাসরি পণ্য আমদানি করতে পারছে না?
ড. জোহা: বাংলাদেশ ১৭ কোটির অধিক জনসংখ্যার একটি দেশ। আবাসভূমির তুলনায় এখানে জনসংখ্যা বেশি। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় আমাদের অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার উপরে নির্ভর করতে হয়। প্রায় ১৬% বৈদেশিক সহায়তার উপর আমাদের জিডিপি দাঁড়িয়ে আছে। অথচ ২০১৯ সালে ছিলো ১৪%। করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমরা এখন কঠিন সময় পার করছি এবং পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার উপর চাপ বেড়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে রিজার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এবং এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উপর ঢাকাকে নির্ভর করতে হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় আমরা আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণের একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি যার আলোচনা চলমান রয়েছে এবং আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেই ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে। ইতোপূর্বে রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানির জন্য সরকার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো কিন্তু সেটি পশ্চিমা শক্তিগুলো ভালোভাবে নেয়নি। আর যদি সরকার রাশিয়া থেকে সরাসরি কোন পণ্য আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করতো তাহলে এই প্রসেসগুলো (বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা) বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল।এই ঝুঁকি সরকার কোনভাবেই নিতে চায়নি যা একটি ভালো সিদ্ধান্ত বলেই প্রতীয়মান হয়।
নিউজ ভিশন: রাশিয়া এবং চীন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে কিন্তু তাদের সম্পর্ক পশ্চিমা দেশগুলোর মতো নয়। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধে এটার প্রমাণ মেলে। এর কারণ কি?
ড.জোহা: এটির একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রসার পেল তখন চীনে ঘটলো অন্য ঘটনা। আধুনিক চীনের স্থপতি মাও জে দং মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারার মধ্যেই চীনা ধারার এক নতুন মতবাদ গ্রহণ করলেন। অর্থাৎ তিনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে চীনা ধারায় নতুন রূপে সাজিয়ে তুলতে লাগলেন যা ক্রমান্বয়ে মাওবাদে পরিণত হতে শুরু করলো। মাউয়ের সময়কালে আমরা কৃষি বিপ্লব দেখেছি কিন্তু মাও পরবর্তীতে দেং শিয়াও পিং-এর সময়ে আমরা কৃষির সাথে শিল্পের সমন্বয়ে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস লক্ষ্য করি। তার নীতি চীনকে লেলিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছুটা ভিন্ন দিকে নিয়ে গিয়েছিল বলেই দৃষ্ট হয়। মাও-এর বইগুলো অধ্যয়ন করলে দেখবেন যে, তার পলিসিগুলোর কারনেই রুশদের সাথে চীনাদের দূরত্ব বেড়ে যায়; কেননা তিনি চীনকে একটি সার্বভৌম-শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এরই ধারায় মাওয়ের শাসনকালে চীন-রুশ সীমান্তে সীমান্ত সংঘর্ষও হয়েছিল। রাশিয়ার সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়েছিলো চীন সীমান্তে। ফলে, চীন-রাশিয়ার মধ্যে বিশাল সীমান্ত থাকার কারণে ঐতিহাসিকভাবে তাদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস সবসময়ই ছিল, একথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
নিউজ ভিশন: গত ২২ অক্টোবর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০ তম কংগ্রেস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুনরায় বিশ্বের এই বৃহত্তম দলটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন শি চিন পিং। দলে তার এত জনপ্রিয়তার কারণ কি?
ড. জোহা: মজার বিষয় হলো চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সংবিধান অনুযায়ী, কোন নেতাকে দু’বারের বেশি নির্বাচন করার নিয়ম নেই। কিন্তু এবার আমরা দেখলাম যে তৃতীয়বারের মতো শি চিন পিং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। আপনি দেখবেন মাউয়ের পরে দেশটির রাজনীতিতে একটা বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে। চীনে পিএইচডি করার সময় এটি আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। সেখানের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশিপ বিষয় পড়তে গিয়ে আমি দেখেছি চীনা শিক্ষকরা মাউয়ের অবস্থানের চাইতে শি চিন পিংয়ের অবস্থানকে আরো বেশি কার্যকরী বলে দেখানোর চেষ্টা করতেন। তখন থেকে আমার ধারণা পরিষ্কার হলো যে শি চিন পিংয়ের পলিসি থেমে যাবে না, বরং তা আরো এগিয়ে যাবে। বলা যায় এতে শি চিন পিং সফল হয়েছেন। কেননা তিনি চীনের জনগণের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন। ইদানীং দেখা যাচ্ছে যে, শি চিন পিং কে কোন কোন পশ্চিমা মিডিয়া বলেছে যে তিনি প্রেসিডেন্ট থেকে সম্রাট হওয়ার পথে হাঁটছেন। মূলত তারা শি-এর এই তৃতীয়বারের উত্থানকে স্বৈরতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে চীনের ভবিষ্যত শাসন ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তবে পাশ্চাত্যে বিশ্বের সাথে শি-এর একটা দ্বান্দ্বিক জায়গা থাকায় পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের এ ধরণের বক্তব্যে আমি অবশ্য অবাক হইনি।
নিউজ ভিশন: সম্প্রতি চীন ও তাইওয়ানের ইস্যু নিয়ে ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছে। এই ইস্যুতে চীনের কৌশল কতটা ফলপ্রদ হচ্ছে বলে মনে করেন?
ড.জোহা: গত আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান ভ্রমণকে কেন্দ্র করে মূলত উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠেছে। খেয়াল করুন, তাইওয়ান বাড়াবাড়ি করলে (স্বাধীনতা ঘোষণা করলে) বেইজিং দেশটিতে আক্রমণ করবে বলে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে আসছে। কিন্তু আপনি জেনে থাকবেন ১৯৫০ সাল থেকে ওয়াশিংটনের সাথে তাইওয়ানের সুসম্পর্কের সুবাতাস বইতে শুরু করে। এ সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে গেলে চীনের সাথে তাইওয়ানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। আবার ২০১৬ সালে তাইওয়ানের ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি ক্ষমতায় আসার পরে নতুনভাবে চীন-তাইওয়ান দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়ে যায়। ইতোমধ্যে কট্টর চীন বিরোধী বলে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে বেইজিং বিরোধী ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। চীনের উপর অনেক বাণিজ্যিক অবরোধ দেয়া হয়। অন্যদিকে জাপান সাগরকে কেন্দ্র করে জাপান চীন উত্তেজনা সৃষ্টি হলে বেইজিং কোন রকমের ছাড় দেয়নি। দেখুন বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্যান্য পশ্চিমা অর্থনৈতিক সংগঠনগুলো চেয়েছিলো চীনকে একঘরে করে রাখতে এবং চীনের ইকনোমিক অবস্থানকে দুর্বল করতে। কিন্তু আমরা দেখেছি চীন খুব দ্রুত তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বজায় রেখে বিশ্বের অর্থনৈতিক নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়েছে। ২০১৪ সালের আইএমএফের রিপোর্ট দেখলে দেখবেন, চীনের জিডিপি আমেরিকার জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে।উক্ত সংস্থাটি আরো জানিয়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে চীন সকল অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে। এই কারনে ওয়াশিংটনের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আর এই উদ্বেগের জায়গা থেকে চীনকে থামানোর জন্য এখন কি দরকার? দরকার হচ্ছে একটা যুদ্ধ তৈরি করা! আমেরিকা এখন সেই সুযোগই খুঁজছে।
নিউজ ভিশন: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক চীনের ইতিহাস ও রাজনীতির বিষয়ক অধ্যাপক রানার মিত্তার দ্য গার্ডিয়ান নিবন্ধে বলেছেন যে, শি চিন পিং মধ্যযুগীয় কিং ও মিং বংশের শাসকদের মত চীনকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন।
ড. জোহা: এটিকে আমরা পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা বলতে পারি। ইতিহাস বলে মিং সম্রাটদের সময়কালে জাপান এবং কোরিয়ার সাথে চীনের একটা শত্রুতামূলক সম্পর্ক ছিলো। অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে চীনের সীমান্ত বিষয়ক শান্তি চুক্তি হয়েছিলো ১৬৮৯ সালের দিকে যেটি পরবর্তীতে ১০০ বছর পরেও টিকে ছিলো। আপনি শুনে অবাক হতে পারেন, কিছু কিছু শর্ত আজও রাশিয়া এবং চীন পালন করে আসছে। দ্বিতীয়ত, কিং রাজাদের শাসনামলে বিদেশি প্রতিনিধি দলের চীনে ভ্রমণ নিষিদ্ধ ছিলো, কেননা সফরের আড়ালে তারা এখান থেকে তথ্য নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার করতো। ফলে এ ধরণের নীতিতে চীন নিজেকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল যদি যুক্তির মানদণ্ডে আমরা ধরেও নিই তারপরেও আমাদের বলতে হবে যে চীন নিজ নিরাপত্তার জন্যই সেই সমস্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে বলতে দ্বিধা নেই চীন এক সময় রক্ষণশীল ছিল; ২০০০ সালের আগে খুব বেশি মানুষ চীনে যেতে পারত না। চীনারা নিজেদের মধ্যে একটা বলয় তৈরি করে রেখেছিলো।এই বলয় তৈরি করেছিলো মূলত উন্নয়ন অব্যাহত রাখা এবং নিজেদের একটা উন্নত জাতি হিসেবে প্রস্তুত করার জন্য। শি চিন পিং গত ২২তম কংগ্রেসে ৬৪ পৃষ্টার ভাষণে বলেছেন, আমাদের কাজ হচ্ছে চীনকে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করা। এই লক্ষ্যে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এটাই ছিলো তার মূল বক্তব্য। তাহলে বিশ্ব নেতৃত্বের দিকে যদি প্রতিষ্ঠিত করতে হয় তাহলে কোন কোন দিকে উন্নয়ন করতে হয়? প্রথমত: অর্থনৈতিক দিকে ও দ্বিতীয়ত: সামরিক দিকে এবং এরপরে ইন্টেলেকচুয়ালি করতে হবে। চীন সেই জায়গায় কাজ করছে। আফ্রিকা মহাদেশের ৭০% দেশ এখন চীন বলয়ের মধ্যে আছে বলে ধারণা করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে চীনের একটা ভালো যোগাযোগ আছে। আপনি জানেন, ভারত ও জাপানের সাথে শত্রুতামূলক সম্পর্ক থাকলেও তাদের মধ্যে এখনও ব্যাপক বাণিজ্যিক যোগাযোগ আছে। এই বাণিজ্যিক যোগাযোগ বিশ্বে দ্বিতীয় বলে জানা যায়। সুতরাং তিনি যে তথ্য দিয়েছেন তা পূর্ণাঙ্গ নয়, সর্বোপরি সেটি পর্যালোচনার দাবী রাখে।
নিউজ ভিশন:: চীন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গ চলে আসে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প "তিস্তা প্রকল্পে" চীনকে যুক্ত করার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা হচ্ছে। এ ব্যাপারটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
ড. জোহা: এটি বাংলাদেশ সরকারের "কৌশলগত পরিকল্পনা" বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। ভারতের সাথে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে থমকে আছে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনেকগুলো দাবী আলোচনার মধ্যে রয়েছে। বিশেষত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন না হওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই চুক্তিটি সম্পাদিত হচ্ছে না। চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা ব্যাপক রকমের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন শীতকালে পানির ঘাটতি দেখা দেয় অন্যদিকে বর্ষাকালে ব্যাপক বন্যা হওয়ার পাশাপাশি নদী ভাঙ্গন দেখা দেয়। ঢাকার এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চীন একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানতে পেরেছি। এই প্রস্তাবনার ধারাবাহিকতায় তারা প্রায় ৮৯০ কোটি ডলারের মত বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। মোট ব্যয়ের ১৫% বাংলাদেশ সরকারের বহন করার করার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পে চীনকে যুক্ত করার দুটো দিক হতে পারে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে ভারতকে চাপে ফেলে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি সম্পন্ন করা। আর সেটি সম্পূর্ণ না হলে নিজেদের নিরাপত্তাকে (National Security) নিশ্চিত করার জন্য চীনকে যুক্ত করা। এক্ষেত্রে ভারত যদি বলে যে তারা ঢাকাকে কাঙ্ক্ষিত চুক্তির আওতায় নিয়ে আসবে তাহলে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ এখান থেকে সরে আসবে। আপনি জানেন ২০১৫ সালে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির ক্ষেত্রে চীনের সাথে ঢাকার চুক্তি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ভারতের বিরোধিতার কারণে সেটা করা সম্ভব হয়নি।
নিউজ ভিশন: চীনের ঋণফাঁদ তত্ত্বটি রাজনীতির বাজারে বেশ প্রচলিত। এক্ষেত্রে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
ড. জোহা: এই প্রোপাগান্ডা খুব বেশি দিনের ঘটনা নয়। সম্ভবত ২০১৭ সালে এই তথ্যটি প্রথম প্রকাশিত হয় অধ্যাপক ব্রাহামা শিলানীর লেখার মাধ্যমে। তিনি দিল্লির স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সেন্টারের অধ্যাপক। ব্রাহামা তার লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করলেন যে, চীনা ঋণে সুদের হার বেশি। এক্ষেত্রে তিনি দেখিয়েছেন, অর্থ পরিশোধ না করলে চীনের দাবি পূরণ করতে হয়। তিনি উদাহরণ হিসেবে শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দরের কথা তুলে ধরলেন। তিনি অবশ্য ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এমনকি থাইল্যান্ডে চীনের বিনিয়োগ নিয়েও আলোচনা করেছেন।আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, হাম্বানটোটাকে শ্রীলংকার দুঃখ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ বেইজিং হাম্বানটোটাকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়ে নিয়েছে। যাহোক কলম্বো যদি ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করতো তাহলে সেটা আর লিজে দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। অথচ অধ্যাপক ব্রাহামা এই বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে সামনে নিয়ে এসেছেন। শ্রীলংকায় সাম্প্রতিক সময়কালে যে বিষয়গুলো ঘটে গেছে তাতে ব্রাহামার প্রচারণা অনেকের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাপারটা আলাদা। বিশ্ব ব্যাংক বা আইএমএফ এর বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে কোন দেশ মোট জিডিপির ৪০% যদি বিদেশী ঋণের উপর নির্ভর করে তাহলে সে দেশটি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের ১৬.৪ ভাগের মধ্যে শতকরা হিসেবে চীন থেকে গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র ৮%। তাই চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ে আমরা দেউলিয়া হয়ে যাব এমন সম্ভাবনা আপাতত নেই।
নিউজ ভিশন:: চীনকে নিয়ে গবেষণা করার জন্য উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে লন্ডনে চায়না ইনস্টিটিউট আছে। বাংলাদেশে চীনকে নিয়ে কতটুকু পড়ানো হয়?
ড. জোহা: আন্তর্জাতিক বিষয়ে গবেষণার জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (BIISS) আছে যেখানে বিভিন্ন দেশকে নিয়ে গবেষণা করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীতেও অনুরূপ উইং থাকলেও দেশের নীতি নির্ধারণে সেগুলো কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে এদেশে চীনকে নিয়ে গবেষণার করার মতো আলাদা স্ট্রাটেজিক কোন প্রতিষ্ঠান এখনও গড়ে ওঠেনি। এমনকি আমরা সেই সংস্কৃতি তৈরি করতে পারি নি। আমাদের সেদিকে নজর দিতে হবে। আপনি দেখবেন ভারতে চায়না স্টাডি সেন্টার আছে। তারা সেখানে শুধু চীন নিয়ে গবেষণা করে। অন্যদিকে চীনে এশিয়ান স্টাডি সেন্টার আছে এবং ইন্ডিয়া স্টাডি সেন্টারও আছে। আমরা ভারত বা চীনের সাথে দীর্ঘদিন সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছি। ফলে দুটো দেশকে নিয়েই আলাদাভাবে গবেষণা করা জরুরি। এই গবেষণা যদি আমরা অব্যাহত না রাখি তাহলে আমাদের থিংক ট্যাংক শক্তিশালী হবে না। আর থিংক ট্যাংক যদি শক্তিশালী না হয় তাহলে কিন্তু আমরা এশিয়ান তথা বিশ্ব রাজনৈতিক পলিসি প্রণয়নে নানা সমস্যায় পড়বো। বিশেষত: বড় দেশগুলোর সাথে বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন বা দূরদর্শী কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গেলে আমাদের বিপদের মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই আমি মনে করি, বাংলাদেশ সরকারের এই জায়গায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
নিউজ ভিশন:: আপনাকে ধন্যবাদ
ড.জোহা: আপনাকেও ধন্যবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০