মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি’২২ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৫ ভাই নিহত এবং আহত হন তিন ভাইবোন। উল্লেখ্য দশ দিন আগে তাদের বাবা চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক স্বাস্থ্য পরিদর্শক সুরেশ চন্দ্র শীল মারা যান। “নিহতদের নিকটাত্মীয়রা জানান, ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রয়াত বাবার আত্মার শান্তি কামনায় ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে তারা বাড়ির কাছের নির্জন এলাকায় ধর্মীয় কার্য সম্পাদন করতে যান। তখন সবাই ছিলেন এক পোশাকে (সাদা কাপড়ে)। সেখানে তারা মহাসড়কের পূর্বাংশে সড়ক থেকে অন্তত দুই ফুট দূরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে চকরিয়া থেকে কক্সবাজারমুখী একটি সবজি বোঝাই পিকআপ তাদেরকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে {সূত্রঃ দৈ/ আজাদী, ৯ ফেব্রুয়ারি’২২}। এই দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটে গেছে আরেকটি দুর্ঘটনা “ফটিকছড়িতে ট্রাফিক পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দ্রুত পালানোর সময় ধানবাহী চাঁদের গাড়ির ধাক্কায় দুই স্কুল ছাত্রী নিহত হয়েছে। আহত হয় আরও একজন। ৯ ফেব্রুয়ারি’২২ (বুধবার) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের ফটিকছড়ির সিএন্ডবি মাঠ সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলো, পাইন্দং ইউনিয়নের শ্বেতকুয়া গ্রামের আবুল বশরের মেয়ে মিশু আকতার (১৭) ও মোহাম্মদ লোকমানের মেয়ে নিশা মনি (১৮)। তারা দুইজনই হাইদচকিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী। এতে সড়কেই দুই স্কুল ছাত্রীর স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়{সূত্রঃ দৈ/ আজাদী, ১০ ফেব্রুয়ারি’২২}।
দেশের প্রচলিত আইন কানুনকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের মধ্যে অহেতুক অশুভ প্রতিযোগিতার পাশাপাশি অযত্ন অবহেলা যথাযথ নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহার ফলে সড়কে অহরহ মর্মান্তিক দুঃখজনক মর্মন্তুদ হৃদয়বিদারক অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত প্রাণহানি ঘটেই চলেছে। দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই ছোট বড় সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্ররা নিরাপদ সড়কের দাবীতে আন্দোলন করেছিল। সরকারে প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর ছাত্ররা আন্দোলন থেকে সরে আসে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরে বিভিন্ন আইন কানুন প্রণয়নের ফলে মানুষের প্রত্যাশা ছিল সড়কে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, দুর্ঘটনা ক্রমশ হ্রাস পাবে। আসলে আমরা এখনো যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। সড়কের বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্য বন্ধ হয়নি বা কমেনি বরং তা ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে। “গত তিন বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু—দুটোই আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সদ্য বিদায়ী ২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮০৩ জনই শিক্ষার্থী। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের ১৩ শতাংশই শিক্ষার্থী। সড়ক দুর্ঘটনায় এমন মৃত্যুকে হত্যা বলে মনে করছেন সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা”। {সুত্রঃ প্রথম আলো, ০৯ জানুয়ারি ২০২২}। পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক, নৌ ও রেলপথে ৪ হাজার ৯৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৬৮৯ জন নিহত হয়েছেন।
স্বামীহারানোর শোকে মুহ্যমান ৬৫ বছর বয়সী মৃণালিনী শীল দশ দিনের মাথায় প্রাণপ্রিয় পাঁচ সন্তানকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন। শুধু তিনি নন তাঁর পুত্রবধূরাও স্বামীহারা হয়ে শোকের সাগরে নিপতিত হয়েছেন। একসঙ্গে এতগুলো মানুষের মৃত্যু শুধু পরিবারকে নয় স্বজন ও প্রতিবেশী সবাইকে মর্মাহত করে তুলেছে। সত্যিকার অর্থে আমাদের চারাপাশে সড়কগুলো যেন মৃত্যুর ফাঁদ পেতে আছে। প্রাণ ও সম্পদহানির পাশাপাশি দুর্ঘটনায় পতিত অনেকেই সাময়িক বা চিরকালের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে অসহনীয় অসহ্য নির্মম জীবন যাপন করছে। অনেক উপার্জনক্ষম ব্যাক্তির মৃত্যুর জন্য পরিবারে নেমে আসছে অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্ভোগ দুর্দশা এবং ভোগান্তি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ ও সম্পদহানি পঙ্গুত্ব মানুষের বিবেককে গভীরভাবে নাড়া দেয়। রক্তক্ষরণ হয় সাধারণ এবং স্বজনহারা মানুষের হৃদয়ে। শোকাভিভূত করার পাশাপাশি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। মানব জীবনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ও পথচলায় ছন্দপতনের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার আতঙ্ক শঙ্কা ডর ভয় যেন মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠছে।
একথা অনস্বীকার্য যে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবী। পাশাপাশি গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ, দক্ষ চালক তৈরি, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও তদারকি জোরদার, চালকদের মধ্যে অহেতুক প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা বন্ধ করা, লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ বন্ধ করা,পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার বৃদ্ধি, ট্রাফিক আইন মেনে চলা, পথচারীদের অবাধ ও নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিতকরণের জন্য জন্য ফুটপাতকে অবৈধ দখল মুক্ত করা, সড়ক আইনের সুষ্ঠু তদারকি এবং কঠোর ও যথাযথ প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি আইনের প্রতি সকলের শ্রদ্ধাশীল হওয়া খুব জরুরি অন্যথায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল এবং রক্তের স্রোত বন্ধ করা যাবে না। একথা ভুলে গেলে চলবে না মানব জীবন অমূল্য সম্পদ। ক্ষতিগ্রস্থ ভুক্তভোগী এবং স্বজন হারানোরাই বুঝে মানুষের জীবনের মূল্য। মানুষের চলাচল নিরাপদ নির্বিঘ্ন নিরুদ্রূপ করার পাশাপাশি মানুষের জীবন রক্ষা করা দেশ জাতি সরকার এবং রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্বও বটে।