এডভোকেট মোঃ সাইফুদ্দীন খালেদ
ফুটপাত পায়ে চলার পথ। পথচারীদের জন্যই নির্মিত হয়েছে রাস্তার পাশের ফুটপাত। ফুটপাত শুধু রাস্তা বা সড়কের সৌন্দর্যই বাড়ায় না। পথচারীদের নিরাপদে হাঁটা ও চলাচলের উপযুক্ত স্থান। প্রশস্ত ফুটপাতের কারণে যানজট বা দুর্ঘটনাও কমে অনেক। ব্যস্ত নগরীকে যানজটমুক্ত রাখতে স্বল্প দূরত্বে হেঁটে চলারও কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এই ফুটপাত কি আসলেই পথচারীদের জন্য? ফুটপাতের বর্তমান চিত্র হচ্ছে, ফুটপাত আছে আবার ফুটপাত নেই। ফুটপাত যে মানুষের চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে, একটা চরম বিশৃঙ্খলা এবং সময়ের বিশাল অপচয় হচ্ছে, যার ফলে মানুষের জন্য নগর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কি থাকাবেন? ছোট ছোট দোকান, নির্মাণ সামগ্রী, ব্যবসা সামগ্রী আর হকারদের ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রতিদিনই হয়রানি পোহাচ্ছেন পথচারিরা। ফুটপাতে ব্যবসা বা খাবার বিক্রয় কেন করবে।
সম্প্রতি চসিক মেয়র মহোদয় বলেছেন, ‘ফুটপাতের খাবার নিরাপদ নয়। আমরা চাই, নগরে যেন বিশুদ্ধ খাবার প্রস্তুত এবং বিক্রি হয়। এ লক্ষ্যে যত রকম উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন তার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কাজ করে যাবে।’
ফুটপাতে ভাসমান ব্যবসায়ী, হকার, অবৈধ পার্কিং ইত্যাদি কারণে ব্যস্ততম রাস্তাগুলোতে দিনের বেশির ভাগ সময় লেগে থাকে যানজট। মানুষ যেন মেনেই নিয়েছে এই পরিস্থিতিকে। আবার চট্টগ্রাম মহানগরীর কয়েকটি স্থানে ফুটপাতে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ফলে বিশেষ করে নগর ব্যবস্থাপনার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে সমন্বয় ও সমঝোতার অভাব। বর্ষাকালে ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার, ওয়াসার লাইন স্থাপনের জন্য সংস্কার করা রাস্তা খুড়ে লাইন বসানো হয়। আবার কোথাও কোথাও রয়েছে ডাস্টবিন। চকবাজার, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর ও কাপাসগোলাসহ বেশ কয়েকটি এলাকার ফুটপাতের চিত্র এমনই। মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন ও নগরবাসীকে যানজটমুক্ত রাখতে হলে ফুটপাত দখলমুক্ত ও সংস্কার করার কোনো বিকল্প নেই। আসলে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হলে উভয় পক্ষ থেকেই দায়িত্বশীল কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। স্রোতের মতো হকাররা আসতে থাকবে আর তারা ফুটপাতে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, তারপর পুনর্বাসনের দাবি তুলবে—এটি কখনো বাস্তবসম্মত নয়। হকার স্থায়ী পুনর্বাসনের এই মানবিক দিকটি বিবেচনা করা দরকার। এ জন্য চাই সুস্পষ্ট নীতিমালা। কারা প্রকৃত হকার তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। এ জন্য সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। কাজেই এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে পথচারী-হকার উভয় পক্ষের স্বার্থই রক্ষা হয়। গণসচেতনতা বাড়ানোর জন্য ফুটপাত দখলকারী ব্যবসায়ীদের দোরগোড়ায় যেতে হবে। তাদের পথচারীদের অধিকার সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে হবে। আবার অনেক এলাকার রাস্তার ফুটপাত সংকীর্ণ, ভাঙাচোরা, কোথাও কোথাও এমন সংকীর্ণ যে একজন মানুষও হাঁটতে পারে না। ফুটপাত সংকীর্ণ করা নয় বরং প্রয়োজন হলে আরো প্রশস্ত করতে হবে। কোথাও আবার সড়কের সঙ্গে ফুটপাত মিশে একাকার হয়ে গেছে। সম্প্রতি রাজধানীতে একটি বেপরোয়া বাস ফুটপাতে উঠে একজনের মৃত্যু ঘটিয়েছে। পথচারীদের অবাধ যাতায়াতের সুবিধার জন্য ফুটপাত মেরামত করার মাধ্যমে পথচারী হাঁটার উপযুক্ত করা প্রয়োজন। জনবহুল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সাড়ে ছয় মিটার ফুটপাত রাখার মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। যেখানে চার মিটার পথচারীদের জন্য, সবুজায়ন ও বিশ্রামের জন্য দেড় মিটার। অথচ এদেশে কোথাও বিশ্ব মানদণ্ড অনুসরণ করে ফুটপাত নির্মাণ হচ্ছে না।
ফুটপাত ব্যবহারের পাশাপাশি জেব্রা ক্রসিংও সড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পথচারীদের নিরাপদে সড়ক পার হওয়ার জন্য সাদা দাগ কেটে জেব্রা ক্রসিং তৈরি করা হয়। কিন্তু নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, যেসব স্থানে জেব্রা ক্রসিং আছে, সেখানে এর ব্যবহার তেমন নেই। অনেক জায়গায় ক্রসিংয়ের সাদা দাগের ওপরেই যানবাহন থেমে থাকছে। অধিকাংশ ড্রাইভার সেটা মানেন না। অধিকাংশ ড্রাইভার জানেনই না জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামাতে হয়। জেব্রা ক্রসিংয়ের কাছাকাছি এলে গাড়ির গতি কমানোর নিয়ম। পথচারীরা পারাপারের সময়েও চালক যানবাহন না থামিয়েই দ্রুত চলে যায়। অনেক সময় জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তোলা হয় যানবাহনে। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি সময়ের চেয়ে আমাদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। নিরাপদ রাস্তা পারাপারে জনগনকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে। সরকার জনগণের নিরাপদ রাস্তা পারাপারের জন্য ফুট ওভারব্রীজ, জেব্রা ক্রসিং তৈরী করে, আর আমরা যদি তা ব্যবহার না করি তাহলে তার দায়ভার আমাদেরকেই নিতে হবে।
এখানে আরেকটি বিষয় সম্পর্কে না বললেই নয়। চ্ট্টগ্রাম আদালত ভবনে (পরীর পাহাড়) ওঠার মুখে (বাংলাদেশ ব্যাংকের গেইট সংলগ্ন) মেইন সড়কের উভয় পাশে জেব্রা ক্রসিং/স্পীড ব্রেকার/ওভারব্রীজ এর খুবই প্রয়োজন। এখান দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পারাপার হয়। এখানে রয়েছে সরকারী মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়-বাংলাদেশ ব্যাংক- আদালত ভবন এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যাওয়ার মূল প্রবেশদ্বার। আগে একপাশে জেব্রা ক্রসিং ছিল, সাদা চিহ্ন মুছে যাওয়াতে এখন বুঝা মুশকিল। অনেক সময় দেখা যায় ক্রসিংয়ের দাগের ওপরেই যানবাহন থেমে থাকছে। জনজীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চট্টগ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জনগণের রাস্তা পারাপারের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দ্রুত যুগোপযোগী পদক্ষেপ কামনা করছি। আমরা যদি সবাই সচেতন হয়ে ফুট ওভারব্রীজ/জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করি এবং ফুটপাত সমস্যার সমাধান করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যাবে। আমাদের হাঁটার পথ হোক নিরাপদ।
লেখক- আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।