একদিকে হাজিরা হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, অন্যদিকে আমরা আলস্নাহর দেয়া বিধান কোরবানির প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। কোরবানি আলস্নাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ। কেননা বান্দাহ কোরবানির মাধ্যমে আলস্নাহর নিকটবর্তী হতে পারে।
আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ সব কিছুই মহান আলস্নাহর দান। পরম প্রভুর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির মূল শিক্ষা। কোরবানির মাধ্যমে মহান প্রভুর জন্য ভালোবাসা ও ত্যাগের মাত্রা নির্ণীত হয়। আলস্নাহর দান আলস্নাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত, তারই একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। আমাদের জীবনসম্পদ আলস্নাহর কাছে উৎসর্গ করার প্রতিশ্রম্নতিই গ্রহণ করি কোরবানির মাধ্যমে। মূলত আমাদের জীবন ও সম্পদের মালিক আলস্নাহ। এ দুটো জিনিস আলস্নাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যয় করাই ইমানের অপরিহার্য দাবি এবং জান্নাত লাভের পূর্বশর্ত। মহান আলস্নাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মুমিনের জীবন ও সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছি। কাজেই জীবনসম্পদ আলস্নাহর এবং তা আমাদের কাছে আমানত। মহান আলস্নাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ও তার পছন্দনীয় পথে ব্যয় করাই ইমানের দাবি। কোরবানি মানুষকে ইমানের এ দাবি পূরণের উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
কোরবানি সম্পর্কে আলস্নাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি, অতএব আপনি আপনার ‘রব’-এর সন্তুষ্টির জন্য সালাত কায়েম করুন এবং তার নামে কোরবানি করুন’। রাসূল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করবে না সে যেন ঈদগাহের কাছেও না আসে। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, কোরবানির দিনে মানবসন্তানের কোনো নেক আমলই আলস্নাহতায়ালার কাছে তত প্রিয় নয়, যত প্রিয় কোরবানি করা। কোরবানির পশুর শিং, পশম ও ক্ষুর কিয়ামতের দিন মানুষের নেক আমলনামায় এনে দেয়া হবে। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আলস্নাহর দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো’ (তিরমিযি)।
প্রথম কোরবানি
মানবসৃষ্টির শুরু থেকেই কোরবানির বিধান চলে আসছে। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতে এ কোরবানি ছিল একটি অপরিহার্য অংশ। মহান আলস্নাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক রীতিপদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আলস্নাহর নাম নিতে পারে, যেসব আলস্নাহ তাদের দান করেছেন’ (সূরা হজ-৩৪)।
মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হযরত আদমের (আ.) দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্যের সততার কারণে হাবিলের কোরবানির কবুল হলো, কিন্তু নিষ্ঠার অভাব ও অমনোযোগিতার কারণে কাবিলের কোরবানি আলস্নাহর কাছে প্রত্যাখ্যাত হলো।
আজকে মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রচলন তা মূলত মুসলিম মিলস্নাতের বা জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিমের (আ.) দেখানো পথ বা সুন্নত। হযরত ইব্রাহিমের (আ.) শতবর্ষ বয়সের পর আলস্নাহতায়ালা তাকে যে সন্তান দান করেছিলেন, তিনি আলস্নাহতায়ালা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তার সে কলিজার টুকরা হযরত ইসমাইলের (আ.) কোরবানির সূত্র ধরে আজও কোরবানি প্রচলিত আছে। কোরবানির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.)। মহান আলস্নাহর জন্য হযরত ইব্রাহিমের (আ.) সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ এবং হযরত ইসমাইলের (আ.) আত্মোৎসর্গ আলস্নাহর কাছে এতই পছন্দ হলো যে, তিনি ইব্রাহিমকে (আ.) আপন বন্ধুরূপে গ্রহণ করলেন। শুধু তা-ই নয়, মহান আলস্নাহ তাকে মুসলিম জাতির পিতার আসনে অভিষিক্ত করলেন এবং তার ছেলে ইসমাইলের (আ.) পবিত্র বংশধারায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদের (সা.) উত্থান ঘটালেন। তিনি হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাইলের (আ.) ত্যাগের ইতিহাসকে চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য সর্বকালের সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানিকে বাধ্যতামূলক করলেন।
কোরবানির তাৎপর্য ও গুরুত্ব
হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কতিপয় সাহাবা রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আলস্নাহর রাসূল (সা.) কোরবানি কি? রাসূল (সা.) বললেন, কোরবানি মুসলিম মিলস্নাতের বা জাতির পিতা ইব্রাহিমের (আ.) সুন্নাত। তারা আবারও প্রশ্ন করলেন, এর মধ্যে আমাদের জন্য কি আছে? রাসূল (সা.) বললেন, কোরবানির পশুর প্রতিটা পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি আছে। তারা বললেন, ভেড়ার তো অসংখ্য পশম আছে। রাসূল (সা.) বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি দেয়া হবে, যদি তা খালেস নিয়তে কোরবানি করা হয় (ইবনে মাযাহ)। আবু দাউদ শরীফের এক হাদিসে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা.) বলেছেন, আলস্নাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদার দিন হচ্ছে কোরবানির দিন।
কোরবানির শিক্ষা
কোরবানি মানুষ মাঝে স্বেচ্ছায় তার প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ত্যাগ করার মানসিকতা সৃষ্টি করে। যেমন হযরত ইব্রাহিম (আ.) শুধু স্বপ্নে দেখেছেন, তোমার প্রিয় বস্তু আলস্নাহর রাহে কোরবানি করো। আর তিনি তার আদরের একমাত্র সন্তান হযরত ইসমাইলকে (আ.) কোরবানির জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। পৃথিবীতে মানুষের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তুর মধ্যে অর্থ-সম্পদ বা টাকা-কড়ি আর সন্তান অন্যতম। মহান আলস্নাহর প্রেমে ও তার নির্দেশের প্রাধান্য দানকল্পে এই অর্থ-সম্পদের মোহ ত্যাগের এ মানসিকতা সৃষ্টি করাই হচ্ছে কোরবানির শিক্ষা। কোরবানি আমাদের ইমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি করে ও পরকালের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। রাসূল (সা.) নির্দেশ করেছেন, হে লোকসকল তোমরা ত্রম্নটিমুক্ত ও উত্তম প্রাণী কোরবানি করো, কারণ কোরবানির এ পশুগুলো হবে তোমাদের জান্নাতে যাওয়ার বাহন।
কোরবানি সচ্ছল সব মুসলমানের ওপর ওয়াযিব। কোরবানির গোশতের ওপর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর, গরিব-মিসকিনের ও মুসাফিরের হক আছে। তাদের হক আদায় করতে হবে।
আর কোরবানির উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহঙ্কারমুক্ত হতে হবে। অনেকেই বাহ্বা পাওয়ার জন্য ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব হওয়ার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার গরু বা উট কিনে লাল ফিতা বেঁধে পথে পথে ঘোরান। এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো সচ্ছল ব্যক্তির জন্য জীর্ণশীর্ণ কম দামি পশু কোরবানিও অনুচিত। এ ক্ষেত্রে মহান আলস্নাহর বাণীর দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। আলস্নাহ বলেন- ‘ওই সব পশুর রক্ত-গোশত আলস্নাহর কাছে কিছুই পৌঁছে না, বরং তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়া তার কাছে পৌঁছে। এই আয়াত থেকে সুস্পষ্ট, উদ্দেশ্যের সততা ও খোদাভীতি কোরবানি কবুলের শর্ত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আলস্নাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। ভোগ নয়, ত্যাগেই আনন্দ- এটিও কোরবানির একটি শিক্ষা। কোরবানির গোশত গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানোও কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। রাসূল (সা.) কোরবানির তিন ভাগের এক ভাগ গোশত গরিবদের মধ্যে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। ইচ্ছা হলে এর বেশি; এমনকি সবটাও দান করা বৈধ। কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ, তবে তা করতে গিয়ে কোরবানির আসল অন্যতম উদ্দেশ্য যেন লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে আমাদের সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। শুধু পশু নয়, পশুত্ব কোরবানি করাও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সঙ্গে আমাদের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে।
আলস্নাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের সব কিছু সহীহভাবে আমল করার তাওফিক দিন। পশু কোরবানির মাধ্যমে ইমানের সাক্ষ্য প্রদান এবং পশুত্ব কোরবানির মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়াই কোরবানির দাবি। কোরবানির মাধ্যমে ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, শত্রম্নতা ইত্যাদি পশুত্বকে দমন করে মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে পারলে আমাদের কোরবানি সার্থক হবে এবং সমাজে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে পড়বে।
নুরুল ইসলাম নূর
শিক্ষার্থী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।