মো. মাহবুবুর রহমান সাজিদ :
শহুরে জীবনের নিত্যদিনের ঝুটঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে ঘুরতে যাব। যাব মোরা প্রকৃতির সান্নিধ্যে। ঝরণা, নদী, ইকোপার্ক, লেক, সৈকত আর পাহাড়ের রাজ্যে। যেথায় হারিয়ে যাওয়া যাবে প্রকৃতিতে।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত "দুরন্ত ৪" এর চারজন ভ্রমণপ্রেমী যথাক্রমে নিগার সুলতানা সুপ্তি, আবু মুছা প্রিন্স, ফেরদাউস খান এবং আমি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলাম।
দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সীতাকুণ্ড যাব। এটি আমাদের দ্বিতীয় শিক্ষা সফর। ৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত "দুরন্ত ৪" সংগঠনের প্রথম শিক্ষা সফর হয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। "সৃষ্টিজগত জানতে মোরা বিশ্বজগত দেখব" স্লোগানে চার ভ্রমণপ্রেমীর এই সংগঠন যাত্রা শুরু করে।
ঝরণা, পাহাড়, সৈকত আর হৃদের জন্য সুপরিচিত সীতাকুণ্ড। ভ্রমণপ্রেমীদের অতিপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। বিশেষ করে প্রকৃতিপ্রেমীদের। চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ চন্দ্রনাথ পাহাড়, সীতার স্মৃতিবিজড়িত সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক, সুপ্তধারা ও সহস্রধারা ঝরণা, খৈয়াছড়া ঝরণা, হরিণমারা, হাঁটুভাঙ্গা, নাপিত্তাছড়া, বাঘবিয়ানী, বোয়ালিয়া, ঝরঝরি ঝর্ণা, কমলদহ অমরমাণক্য প্রভৃতি ঝরণা ও জলপ্রপাত। এছাড়া রয়েছে গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত, বাঁশবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম হৃদ মহামায়া লেক।
"দুরন্ত ৪" এ মাত্র একজন মেয়ে রয়েছেন। আরও দুজন মেয়ে প্রয়োজন। ফেরদাউস খান বলল, মেয়ে ম্যানেজ করা খুবই সহজ। উল্লেখ্য ভাইটি দীর্ঘ তিনবছরে একটি মেয়েও জুটাতে পারেননি।
এই গুরুদায়িত্ব কাধে নিলেন স্বয়ং নেত্রী। দুরন্ত ৪ এর সভাপতি নিগার সুলতানা সুপ্তি। অনায়াসে পেয়ে গেলাম দুজন মেয়েকে। ফেরদাউসের ভাগ্যাকাশে পূর্ণীমার চাঁদ উদয় হল। একজন আমাদের পরিচিত জুয়েনা আক্তার। শান্তশিষ্ট, নিভৃতচারী এবং লেখক। অন্যজন কনকচাঁপা। বন্ধুভাবাপন্ন এবং মিষ্টিমেয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে যাত্রা শুরু। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌছে জনপ্রতি ১২০ টাকা মূল্যে টিকেট কেনা হল। চট্টগ্রাম মেইল ট্রেন। ছাড়বে রাত ১০. ৩০ মিনিট। সিট পেতে অংশগ্রহণ করতে হবে ২০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায়। ট্রেন আসবে ২ নং প্লাটফরমে। ৮. ৩০ মিনিটে আমরা ২ নং প্লাটফরমে একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। সবাই দৌড়াচ্ছে। আমরাও দৌড়াতে শুরু করলাম। জানালা দিয়ে প্রবেশ করলাম। দখল করলাম ছয়টি সিট। সিট পেয়ে যখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছিলাম তখন একজন বলল ট্রেনটি নোয়াখালী যাবে। পুরোই আবাল হয়ে গেলাম। হাসতে হাসতে বের হয়ে আসলাম ট্রেন থেকে। আমাদের তো ভিসা পাসপোর্ট কিছুই নেই নোয়াখালী যাব কিভাবে। যাক, সিট দখলের রিহার্সাল হয়ে গেল।
৯.৪৫ মিনিটে আমাদের ট্রেন ২ নং প্লাটফরমে প্রবেশ করল। পূর্বের ন্যায় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলাম। আমাদের সাথে ছিলেন ক্যাম্পাসের স্বনামধন্য দৌড়বিদ, ১৫০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় পদকজয়ী আবু মুছা প্রিন্স। অনায়াসে ৬ টি সিট দখল করলাম।
রেলওয়ে সেক্টরে একটি কালো অধ্যায় উন্মোচিত হলো আমাদের কাছে। আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশরা ট্রেনের সবগুলো সিটের দখল নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে সেগুলো বিক্রি করে। এমন এক অসাধু পুলিশের সাথে দেখা হল আমাদের। তারনাম আখতারুজ্জামান। বাড়ি গোপালগঞ্জ। আমাদের কাছে কয়েকবার এসে টাকা চাইল। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি এবং আমাদের পাঁচজনই সাংবাদিকতা করেন। জানতে পেরে চুপসে গেল। কিন্তু আমাদের চারপাশের বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে অবৈধভাবে অনেক টাকা তুলল। ঠিক একই ঘটনা দেখতে পেয়েছিলাম ফেরার পথে ঢাকা মেইলে। সেখানে আমাদের সার্বিক সহযোগিতার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসাররা এবং সেখানকার দালালরা এই সিট দখল এবং বিক্রির নেতৃত্ব দেয়। আশাকরি, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নেবে।
আমরা বসলাম একেবারে সামনের বগির শেষ প্রান্তে। ইঞ্জিনের শব্দ আর টয়লেটের দুর্গন্ধ আরামের ঘুমকে হারাম করে দিল।
নাক চেপে ধরে, গল্পগুজব করে, ক্যাসিনো খেলে (মোবাইলে লুডু খেলা) কাটিয়ে দিলাম সারারাত।
সেদিন ভোরে পৌছে গেলাম সীতাকুণ্ড। তুন্দুর রুটি দিয়ে ভাই ভাই হোটেলে নাস্তা সারলাম। মাত্র ৮০ টাকায় সিএনজি ভাড়া করে চলে গেলাম চন্দনাথ পাহাড়ের পাদদেশে। প্রতিটি ২০ টাকা মূল্যে শক্ত ও সুন্দর ৬ টি লাঠি কিনলাম। আরোহণ করতে শুরু করি পাহাড়ে। পর্যাপ্ত পানি এবং স্যালাইন সাথে নিয়ে নিলাম।
আশেপাশে থাকা লোকজন আমাদেরকে নিরুৎসাহিত করতে থাকল। আমরা নিরুৎসাহ থেকে উৎসাহিত হয়ে চলতে লাগলাম। সেলফিবাজ, ক্লিকবাজ, ফটোগ্রাফার ফেরদাউস খান প্রতিটা স্টেপে আমাদের পর্যাপ্ত ছবি তুললেন। বিশেষ করে, পাহাড় চূড়া থেকে এক স্টেপ নিচে কিছু সমতল জায়গা রয়েছে। সেখানকার মৃদুমন্দ বাতাস আমাদের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছিল। এভাবে আমরা প্রতিটা স্টেপে বিশ্রাম নিতে নিতে উঠে গেলাম চন্দ্রনাথ মন্দিরে। পাহাড় চূড়া থেকে পুরোটা শহর একপলকে দেখা যায়। সেখান থেকে দেখলাম বিরুপাক্ষ মন্দির। পাহাড়ে উঠার পথে সাধারণত লোকজন বামবাশের অপেক্ষাকৃত সহজ পথ ব্যবহার করে। কিন্তু আমরা ডানপাশের খাড়া পথটিই বেছে নিয়েছিলাম। ফেরার বেলাও আমরা একই পথে ফিরেছি। তাই আমাদের এডভেঞ্চার একটু বেশিই ছিল। একটু অসচেতনতা মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। তাই সচেতনতার বিকল্প নেই। তিনঘণ্টার মধ্যে আমরা চন্দ্রনাথ পাহাড় জয় করে নিরাপদে ফিরে এলাম। লাঠিগুলো ফেরত দিয়ে হাফটাকা নিয়ে নিলাম।
ফিরলাম সিতাকুণ্ড বাজার। ভাইভাই হোটেলে গরুর মাংস দিয়ে লাঞ্চ করা হল। ১০০ টাকা ভাড়ায় সিএনজিযোগে চলে গেলাম সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে। জনপ্রতি ৩০ টাকা মূল্যে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটি চার্ট। যেখানে লেখা রয়েছে দর্শনীয় স্থানগুলোর তালিকা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সুপ্তধারার উপকণ্ঠে। একটি বোর্ডে লেখা রয়েছে, "সুপ্তধারা সুপ্ত থাকি, জেগে উঠি বর্ষায়।" সিড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিচে নামতে থাকি। ঝরণার ডাকে সাড়া দিতে আমাদের মন উতলা হয়ে উঠেছে। কলকল হাসিতে আমাদের হৃদয় জয় করে ফেলে ঝরণা।
রাজ্যের অশান্তি থেকে মুক্ত হয়ে স্বর্গীয় শান্তি খুঁজে পাই ঝরণার বুকে। ঝরণা আমাদেরকে তার সবকিছু উজাড় করে দেয়। আমরা ইচ্ছেমতো সময় কাটাই ঝরণার সাথে। সাঁতার কাটি, লাফালাফি করি, গড়াগড়ি করি ঝরণার সাথে। অঝোর ধারায় ঝর্ণার জল আমাদের শরীর ও মন সিক্ত করছে। সবাই ঘণ্টাখানেক একান্তে কাটাই ঝরণার সাথে। বিকেলবেলা ঘুরতে যেতে হবে মহামায়া লেক অথবা গুলিয়াখালী সী বিচে।
ইকোপার্ক থেকে বেরিয়ে এসে সিদ্ধান্ত নিলাম গুলিয়াখালী সী বিচ দেখতে যাব।
যেই ভাবা সেই কাজ। ২৫০ টাকা ভাড়ায় ইকোপার্ক থেকে সী বিচে পৌছে যাই।
দিনটি ছিল রৌদ্রকোজ্জ্বল। তাই সী বিচটিকে অনন্যরূপে আমরা দেখতে পেলাম। সাধারণত গুলিয়াখালী সী বিচে ১.০০ টা থেকে ২.০০ টার দিকে জোয়ার হয়। আমরা সেখানে পৌছিয়েছি বিকাল ৫.০০ টায়। তখন সূর্য পশ্চিমাকাশ লাল আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একেবারে সমূদ্রের দ্বারপ্রান্তে চলে যাই। অন্তহীন সমূদ্রের অন্যকূল দেখা যায়না। শুধু বিশাল জলরাশি। মনমাতানো বাতাস আর ঢেউয়ের উছলেপড়া। দূরে দেখা যাচ্ছে বিশাল বিশাল জাহাজগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। সমূদ্রতটে পা ভিজিয়ে সমূদৃরের বিশালতা পর্যবেক্ষণ করি। আমাদের কয়েকজন মহিষের মতো কাদায় লুঠোপুঠি খায়। জলরাশি, কাদা, সবুজ ঘাস এবং বৃক্ষের এমন মেলবন্ধন সত্যই বিরল।
সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। সন্ধ্যা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আমরা সাগরে জলরাশিতে হারিয়ে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু হারালে চলবেনা আমাদেরকে দেখতে হবে বিশ্বজগত তাই মন না চাওয়াতেও ফিরে
আসতে হল। কাদায় আছাড় খেতে খেতে ফেরা হল। সিএনজিযোগে চলে এলাম সীতাকুণ্ড। রাতের খাবার খাওয়া হল ভাই ভাই হোটেলে। পাশেই রয়েছে প্রাক্ষালণ কক্ষ। সেখানে সবাই ড্রেস চেঞ্জ করে মানুষের রূপ ধারণ করি। এতক্ষণে ছেলেদের চেহারাগুলো ডাকাতের মতো এবং মেয়েদের চেহারাগুলো ডাইনির মতো দেখাচ্ছিল।
এবার ফেরার পালা। সীতাকুণ্ড রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকা মেইল পাওয়া যাবেনা। যেতে হবে চট্টগ্রাম। টিকেট কেটে চলে গেলাম চট্টগ্রাম। সেখান থেকে আবারো সেই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, সিট দখল, ঝগড়াবিবাদ ইত্যাদির দুই বগিতে ছয়টি সিট ম্যানেজ করা হল। সারারাত গল্প, আড্ডা আর ক্যাসিনো খেলে কাটিয়ে দিলাম। মানুষের জীবন যে কত দুর্বিষহ হতে পারে লোকাল ট্রেনে চলাফেরা না করলে সেটা অনুধাবন করা কঠিন। নির্ঘুম
দুরাত কাটানোর পর সকালবেলা সবাই যখন নিরাপদে এবং সুস্থ অবস্থায় ক্যাম্পাসে ফিরি তখন সকলেই বিধ্বস্ত। ক্লান্তি, অবসাদ আর নির্ঘুম রাত জাগাতে আসল চেহারা ভিন্নরূপে প্রকাশ পাচ্ছিল।
ক্যাম্পাসে ফিরে ২২ ঘণ্টার একটি গভীর ঘুমের পর যখন ভ্রমণকাহিনী লিখছি তখন সবকিছুকে স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। পুরো ভ্রমণে অর্থাৎ চন্দনাথ পাহাড়, সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন, সুপ্তধারা ও সহস্রধারা ঝরণা এবং গুলিয়াখালী সী বিচ দেখে একেবারে ক্যাম্পাসে ফেরা পর্যন্ত আমাদের জনপ্রতি ব্যয় হয়েছে ৭৪৩ টাকা মাত্র। আনন্দ ও বিনোদন, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা, প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে আমাদের একটি দিন যেন হাজারদিনসম। স্মৃতিময় দিনটি স্মৃতিপটে থাকবে আজীবন।
সাংগঠনিক সম্পাদক
'দূরন্ত ৪'
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০