———
একপলকে
বই: আকর (উপন্যাস)
লেখক:কবি মিতা আলী
প্রকাশক: ইতিবৃত্ত প্রকাশন
পৃষ্ঠা: ১১২
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা
কবি, লেখক ও গবেষক মিতা আলীর রচনা আকর। এটি একটি সামাজিক উপন্যাস।আকর উপন্যাসের মূল কাহিনী মা ও সন্তানের স্বর্গীয় ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এছাড়া লেখক বইটিতে বাংলাদেশের রাজনীতির স্বরূপ,বুয়েটের ছাত্র শহীদ আবরারের নির্মম হত্যা (উপন্যাসটি যেকজনকে উৎসর্গ করা হয়েছে তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম), করোনাকালের খবরাখবর ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘটনা প্রবাহ সুচারুভাবে তুলে ধরার প্রয়াস করেছেন।আকরের অন্যতম আকর্ষণ মানবজীবনের সাথে বিহঙ্গজীবন বা উদ্ভিদজীবনের তুলনা। প্রকৃতি ও মানবমনকে লেখক এমনভাবে একসূত্রে গেঁথেছেন যে পাঠকের মনে পড়বে কবি শামসুর রাহমানের বিখ্যাত সেই কবিতার লাইন ” আবার আমি যাবো আমার পাড়াতলী গাঁয়ে ” অথবা শাহনাজ রহমাতুল্লাহর সেই গান ” একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গায়”। বলতে গেলে আধুনিক প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহারে শহুরে ও গ্রামীণ সমাজের মধ্যে যে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে -সেই ব্যবধান কমাতেই সম্ভবত লেখক তার উপন্যাসের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে সতর্ক করেছেন।
আয়েশা আকরের কেন্দ্রীয় চরিত্র। প্রিয় সন্তান আনুশকে নিয়েই তার ভাবনার জগত।আয়েশা নিজ ছেলেকে অনেক ত্যাগের মাধ্যমে বড় করেন এবং একসময় আনুশ মেডিকেলে চান্স পায়।একমাত্র আদরের ছেলে ভর্তি হলে প্রিয় পুত্রের জন্য তার চিন্তা বেড়ে যায়।একদিন আনুশের ছুটি পেয়ে বাসায় ফেরার খবর আসলে মা আয়েশার আনন্দের সীমা থাকে না।২৭ পৃষ্ঠার বর্ণনা এরূপ: “এ আনন্দ যেন প্রতি লোম কূপে ছড়িয়ে পড়ে।কি করবে না করবে কেমন একটা দিশেহারা অবস্থা”। ইতালিয়ান ঔপন্যাসিক গ্রাৎসিয়া দেলেদ্দারের নোবেলজয়ী উপন্যাস ‘লা-মাদ্রে’- এর সাথে আকরের ভাবের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত উপন্যাসের কাহিনী এক যাজক ও তার মাকে নিয়ে। বইটি পড়লে জানা যায়, নানা চড়াই-উতরাই পার করে মা তার ছেলে পলকে বড় করেন। একসময় প্রিয় পুত্র পল যাজকত্ব গ্রহণ করেন। এটি ছিল খুবই কঠিন দায়িত্ব। পল তার দায়িত্বের বাইরে গিয়ে পাপের পথে পা বাড়াতে পারে, এরকমই আশঙ্কা তার মা করতেন। হলোও তাই।সুন্দরী এজনিসের প্রেমে পড়েন পল। একদিকে কর্তব্য ও অন্যদিকে প্রেমের আকুতির মধ্য দিয়ে কাহিনী বেড়ে ওঠে এবং শেষ হয় একটি করুণ মৃত্যুতে। সে মৃত্যু পলের মায়ের। দুটো উপন্যাসের মূল ভাবার্থ প্রায় এক হলেও চরিত্র গুলোর চূড়ান্ত পরিণতি ভিন্ন।
উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র আনুশ। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে মা ও বাবার অকৃত্রিম ভালোবাসায় কিভাবে সন্তান বেড়ে উঠে -তা এই চরিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। উপন্যাসে আনুশকে একজন জ্ঞানপিপাসু, ধৈর্য্যশীল ও প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবরার হত্যার পর আয়েশা কেঁদে বুক ভাসালে আনুশ নিজের চাপা ক্ষোভ বজায় রেখে মাকে সান্ত্বনা দেয় এভাবে “ওরা এটাই করে,মা, আমিও শেয়ার করতে পারছিলাম না,তুমি যে এত দূর্বল!” (পৃ:৬)। কয়েক পৃষ্ঠা চোখ বোলানোর পর দেখা মেলে আনুশকে করা আয়েশার এই উক্তির: “তুই বুঝি সব জানিস?।আনুশ উত্তর দেয়: “কি বলো মা জানতে হবেই।No forgive No Forget.” আকরের আনুশ ও রবীন্দ্রনাথের ছুটির (ছোটগল্প) সেই ফটিক চরিত্রের বেশ মিল থাকলেও দুই চরিত্রের পরিণতি যে আলাদা-তাতে পাঠক একমত হবে বলা যায়।
আকরের রহস্যময় চরিত্র আকন আহমেদ।এই চরিত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের বৈচিত্র্যময় জীবনের কথা বর্ণিত হয়েছে।এই চরিত্র একজন সফল বাবা হিসেবেও পাঠকের কাছে পরিলক্ষিত হতে পারে।এ ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক দুটো উল্লেখযোগ্য বাক্য: ১. ” মা ও ছেলের এই কথোপকথনে অবশ্য আকন সাহেব বেশ খুশি (পৃ:৪৪)”। ২. ” মা-ছেলের এ আয়োজনে আকন সাহেব কোন রকম বাধা দেন না।” আকন চরিত্রের সাথে সত্যনাথ ভাদুড়ীর অন্যতম সাড়া জাগানো উপন্যাস জাগরী-এর (প্রকাশকাল-১৯৪৫) সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত উপন্যাসের বিষয়বস্তু হচ্ছে পূর্ণিয়ার একটি বাঙালি পরিবারকে কেন্দ্র করে। চার সদস্যের সেই পরিবারে গৃহকর্তা পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। বিদ্যা ও ব্যক্তিত্বের জোরে তিনি এলাকার সকলের কাছেই সম্মানিত।কিন্তু তার দুই ছেলে রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলে একসময় তাদের জেলে যেতে হয়। ঘটনাক্রমে একসময় তাদের মা ও বাবাও কারারুদ্ধ হন। ঘটনার প্রেক্ষাপট আলাদা হলেও সংগ্রামী ও প্রতিবাদী চরিত্রের কারণে আকরের শিক্ষক চরিত্র আর জাগরীর সেই শিক্ষকের কাহিনীর বেশ সাযুজ্যতা রয়েছে।
আকরের রচনাকাল একবিংশ শতাব্দীর করোনা মহামারী সময়ে। তাই লেখকের বিভিন্ন বর্ণনায় এই মহামারীর ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। কয়েক বছর ধরে চলা এই মহামারী মানবসভ্যতার অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো। সেসময় করোনা এশিয়ার তুলনায় ইউরোপে বেশি হানা দেয়। আকর পড়লে পাঠকের নোবেলজয়ী তুর্কি লেখক ওরহান পামুকের বিখ্যাত উপন্যাস ‘নাইটস অফ প্লেগ’- এর কথা মনে হতে পারে। তবে সেই উপন্যাসের পড়লে জানা যায় প্লেগ ইউরোপ নয়, বরং এশিয়াতে বেশি ছড়িয়ে পড়েছিলো।লেখক মিতা আলী রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও আলোচনা করেছেন। এই দুটি দেশ খাদ্য শস্য উৎপাদনে সারা বিশ্বে বিখ্যাত।সেসময় যুদ্ধের কারণে দরিদ্র দেশ গুলো সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়ে। লেখক রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভীষণ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এর আশু অবসান প্রত্যাশা করেছেন। এ ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করে চোখ বুজলে পাঠকের অন্তরে লিও তলস্তরের পৃথিবী বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর কথা স্মরণ হতে পারে।উক্ত উপন্যাসে যুদ্ধের ভয়াবহ দিক ফুটে উঠেছে। তলস্তয় সেখানে বিশ্ববাসীকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন, যুদ্ধ মানুষের শান্তির পরিপন্থী এক বিধ্বংসী কৌশলমাত্র। ওয়ার এন্ড পিসের জনপ্রিয় চরিত্র ফিল্ড মার্শাল মিখাইল ইলারিওনভিচ কুতুজভ। তিনি হলেন ৬৩ বছরের এক সেনাপ্রধান, যিনি তার এক চোখ তুর্কিযুদ্ধে বুলেটের আঘাতে হারান।অবশ্য অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে কুতুজভ বেঁচে যান। এরপরও তাকেই নিতে হয় পর্বতসম দায়িত্ব।
উপন্যাসে মূল রচনার বাহিরে লেখক বাংলাদেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টেনে এনেছেন। এগুলো হলো বাংলাদেশের ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অগ্রযাত্রার মহানায়ক শহিদ আবরারের হত্যার ঘটনা এবং গণঅভ্যুত্থানের ভবিষ্যৎবাণী। এদেশীয় রাজনীতির সমালোচনা করে বইটির ৮৫ পৃষ্ঠায় লেখকের বক্তব্য: “এখানে রাজনীতি করা নেতারা বেশিরভাগ অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত। না আছে তাদের রুচিবোধ, না আছে শিক্ষার প্রতি অনুরাগ”।প্রসঙ্গত, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় বাংলাদেশ এখন সংস্কার যুগ পার করছে।সুতরাং আকরের লেখকের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে সেটির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।যাহোক,উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে আধিপত্যবাদ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইকারী বুয়েটের ছাত্র শহিদ আবরারের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি মেধাবী এই ছাত্র হত্যার বিচারে গড়িমসি দেখে তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি সুষ্ঠু বিচার হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। উপন্যাসের শেষ অনুচ্ছেদে লেখক দেশে একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তা দুটো বাক্য বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়।যথা:১.’একটা মহাসমুদ্রের তীব্র ঢেউয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ২.’কোথায় কিভাবে এর বিস্ফোরণ ঘটবে সময় তা বলে দেবে।’লেখকের স্বপ্ন যেন পূরণ হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ইতিহাসের অন্যতম বড় গণঅভ্যুত্থান দেখলো বিশ্ববাসী।
পরিশেষে বলা যায়,আকর একটি ঐতিহাসিক ও সামাজিক উপন্যাসের মিশ্র প্রতিচ্ছবি।
একটি সার্থক উপন্যাসে ৬টি বৈশিষ্ট্য থাকে।আকরে তার সবই যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।উপন্যাসটি পড়লে একদিকে পারিবারিক হৃদয়স্পর্শী ঘটনা অন্যদিকে সমাজ ও রাজনীতির কথার জাদু পাঠককে বিমোহিত করে তুলবে বলে আমার ধারণা। আমার বিশ্বাস গ্রন্থটি সব শ্রেণির পাঠক বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম সাদরে গ্রহণ করবে।
——
লেখক:হাসিবুল হাসান শান্ত
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়