রফিকুল ইসলাম জসিম
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী কুরমা চা বাগানে চা শ্রমিকদের হাতে গড়ে উঠেছে একটি অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান— কুরমা চা বাগান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অতি সামান্য মজুরির বিনিময়ে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করা শ্রমিকরা নিজেরাই গড়ে তুলেছেন এ বিদ্যালয়, যা আজ শতাধিক শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ার আশ্রয়স্থল।
২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর বিদ্যালয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও চা সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা। আগে আশপাশে মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয় না থাকায় দরিদ্র পরিবারগুলো সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারত না।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবিদুর রহমান বলেন, এই এলাকার চা শ্রমিকদের সন্তানরা যাতে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত না হয়, সে লক্ষ্যেই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ মনির উদ্দিন স্যারের উদ্যোগ এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় আজ বিদ্যালয়টি দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে এখানে ৭ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ১৫৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো— এলাকার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা নিঃস্বার্থভাবে, কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই এখানে পাঠদান করছেন।
বিদ্যালয়ে চাকমা, দেববর্মা, সাঁওতাল, তেলি, হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টান পরিবার থেকে আসা ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে। তারা আসে কুরমা, কুরনজি, বাঘাছড়া, কলাবন, তৈলুংছড়া, সুষমা নগরসহ আশেপাশের চা বাগান থেকে। এই বৈচিত্র্যময় শিক্ষার্থী সমাজ বিদ্যালয়টিকে একটি মিলনমেলায় পরিণত করেছে।
সহকারী শিক্ষিকা লিপি আক্তার বলেন, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে শিক্ষার্থীদের ৫ কিলোমিটার দূরে ইসলামপুর পদ্মা মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ে যেতে হতো। দরিদ্র চা শ্রমিক পরিবারগুলোর পক্ষে প্রতিদিন ৩০-৪০ টাকা ভাড়া দেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন কুরমা চা বাগানেই বিদ্যালয় হওয়ায় শিশুরা সহজেই হেঁটে এসে পড়াশোনা করতে পারছে।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ মনির উদ্দিন বলেন,
আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। একসময় একটি উচ্চ বিদ্যালয় করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলাম। পরে এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান, চা বাগান সভাপতি, কুরনজি ও বাঘাছড়া চা বাগানের প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় উদ্যোগ সফল হয়।
শ্রমিকরা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তা অবিস্মরণীয়— কেউ ১০ টাকা, কেউ ২০ টাকা, কেউবা ৫০০০ টাকা দিয়েছেন। কেউ ইট, দরজা, জানালা, টিন দিয়ে সাহায্য করেছেন। শ্রমিকদের এই ঐক্য ও ত্যাগ ছাড়া বিদ্যালয় গড়ে তোলা সম্ভব হতো না। আজ আমি গর্বিত যে নিজেদের শক্তিতেই আমরা সন্তানদের জন্য একটি বিদ্যালয় গড়ে তুলতে পেরেছি। তবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যালয় এখনও সরকারি অনুমোদন পায়নি। ভবন, বেঞ্চ, পাঠাগার, কম্পিউটার ল্যাবের মতো মৌলিক সুবিধা নেই। এগুলোই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ কার্যক্রম শুরু হয় ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে। শুরুতেই সরকার বিনামূল্যে বই সরবরাহ করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য সাইকেল বিতরণের উদ্যোগ নেন। প্রথমে ৬ জন, পরে আরও ১২-১৪ জন, আর ২০২৪ সালে প্রায় ১৫ জন শিক্ষার্থী সাইকেল পেয়েছে। স্থানীয়রা আশা করছেন এই সহায়তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
এক শিক্ষার্থীর মা বলেন, স্কুলটা কাছে হওয়ায় আমরা অনেক সুবিধা পেয়েছি। আগে মেয়েকে দূরে পাঠাতে ভাড়া, টিফিন—অনেক খরচ হতো। কই থেকে দিতাম? এখন বাড়ির কাছেই স্কুল, মেয়েটা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে। আমার ইচ্ছে আছে মেয়েকে এসএসসি পর্যন্ত পড়ানোর।
বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানায়, আমাদের স্যাররা খুব ভালোভাবে পড়ান। কখনো শাসন করেন, আবার অনেক সময় মায়া-আদরও করেন। স্কুলে এলে মনে হয় আমরা যেন নিজের বাড়িতেই আছি।
বিদ্যালয়টি বর্তমানে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। অনুমোদন না থাকায় অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠাগার, কম্পিউটার ল্যাব গড়ে ওঠেনি। তবুও শ্রমিকদের অবদান ও তরুণ শিক্ষকদের নিঃস্বার্থ সেবা শিক্ষার্থীদের জন্য এক আশীর্বাদ।
স্থানীয়রা আশা করছেন— দানশীল ব্যক্তি ও সরকারের সহযোগিতায় শিগগিরই বিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপ নেবে।
কুরমা চা বাগান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি একটি আন্দোলনের নাম। এটি প্রমাণ করেছে— দরিদ্র চা শ্রমিকেরাও যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। আজ শতাধিক শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ে উঠছে তাদের সেই স্বপ্ন ও ত্যাগের ফসল থেকে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০