লন্ডন তথা ব্রিটিশ রাজনীতিতে বাংলাদেশী এমনকি সিলেটিরা প্রবেশ করেন সক্রিয়ভাবে। এদের মধ্যে ফ্রন্টলাইনার বা শুরুর দিকের কাণ্ডারি ছিলেন মনোয়ার হোসেন। তার জন্ম সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার অলঙ্কারি ইউনিয়নের হাজারিগাঁওয়ে। ১৯৫৪ সালে তার বিলেত আগমন। নেতৃত্ব দেন পাকিস্তান ইউনিয়ন গড়ায়।
ষাটের শুরু থেকে তিনি স্থানীয় বার কাউন্সিলে নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৪৭ সালের পর থেকে মূলত তার হাত ধরেই বিলাতের রাজনীতিতে বাংলাদেশের এ অঞ্চলের মানুষের পদচারণা শুরু হয়। দেশভাগের পর বিলাতের রাজনীতির কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যাওয়া প্রথম ব্যক্তি তিনি। ১৯৭২ সালে ব্র্যাডফোর্ড কাউন্সিল ও ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার কাউন্টি কাউন্সিলর নির্বাচিত হন মনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিলাতে গড়ে ওঠা অ্যাকশন কমিটিগুলোকে নেতৃত্ব দেয়ার স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন।
বিলাত বা লন্ডনের সেকালের রাজনীতিতে বাঙালি বা বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ কেবল শুরু হয়েছিল। তখনো ব্যাপক হারে তা হয়নি। হয়েছিল বিশ শতকের সত্তরের দশকে। এটি শুরু হয়েছিল বর্ণবৈষম্যবিরোধী প্রজন্ম ও তাদের চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে। এদের মধ্যে গোলাম মোস্তফা, মোহম্মদ নুরুল হক, ব্যারিস্টার আশিক আলী, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সিরাজুল হক, আব্দুল গফুর প্রমুখ ছিলেন প্রধান। ১৯৮২ সালে নির্বাচনের আগে লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বরোর (অঞ্চল) স্পিটালফিল্ড ওয়ার্ড থেকে লেবার পার্টির মনোনয়ন চেয়ে বিফল হন মোহাম্মদ নুরুল হক। প্রতিবাদে বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে স্থানীয় প্রায় ২০টি বাঙালি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সম্মিলিতভাবে স্পিটারফিল্ড থেকে মোহাম্মদ নুরুল হক ও সৈয়দ নুরুল ইসলামকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাদের এ একতা লন্ডনের রাজনীতির চোখে পড়ে।
লন্ডনের রাজনীতিতে টাওয়ার হ্যামলেটস নামটি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৫ সালে তিনটি বরো নিয়ে এটি তৈরি হয়। এ অঞ্চলে কর্মজীবী মানুষরাই বেশি বসবাস করত। স্পিটালফিল্ড ওয়ার্ডের বৈশিষ্ট্য হলো এখানে ছোট শিল্প, হোলসেল ও খুচরা বাজার ছিল। ১৯৭০ থেকে ১৯৮৫-এর মধ্যে এসব অঞ্চলের উন্নতি হয়। এ স্পিটালফিল্ড অঞ্চলে বাংলাদেশীদের বসতি হয়। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকেই এ অঞ্চলে বাংলাদেশীরা বসবাস শুরু করে। তাদের পরিমাণ বাড়তে থাকে। সেন্ট মেয়ার, সেন্ট ক্যাথরিন ও উইভারের মতো করে এখানেও তারা নিজেদের আবাস তৈরি করে। জন এইডের ‘দ্য পলিটিকস অব কমিউনিটি: দ্য বাংলাদেশী কমিউনিটি ইন ইস্ট লন্ডন’ থেকে জানা যায়, ১৯৮১ সালে টাওয়ার হ্যামলেটসের অধিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
পরিসংখ্যান বা শুমারি অনুসারে বাংলাদেশীদের সংখ্যা ১৪ হাজার থেকে ১৮ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করে। স্পিটালফিল্ডের অধিবাসীদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৯ শতাংশ বাংলাদেশী। এদের মধ্যে আবার সর্বাধিক বাংলাদেশীর দেশীয় আবাস সিলেট বিভাগে। এমনকি সিলেটিদের মধ্যেও সেখানকার নির্দিষ্ট গ্রাম বা অঞ্চলের মানুষের আধিক্য লক্ষণীয়। এদের মধ্যে প্রথম জেনারেশনের মানুষেরা তুলনামূলক কম শিক্ষিত। এরা বেশির ভাগই মুসলিম ও সুন্নি মতাবলম্বী। বাংলাদেশীরা বিভিন্ন কাউন্সিল ব্লকের অধীনে ছিলেন। এসব ব্লক ও ব্লকের মানুষেরা নানা কারণে অসুবিধা বা প্রতিকূলতার মধ্যে থাকার কারণে তাদের মধ্যে দাবিদাওয়া আদায়ের প্রবণতা তৈরি হয়। রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার এ এক কারণ। ফারুক আহমেদ তার ‘বিলাতে বাঙালি অভিবাসন’ বইয়ে এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।
১৯৮২ সালে পাঁচজন বাঙালির মধ্যে নুরুল হক সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। অন্যদিকে সেন্ট ক্যাথরিন ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হন ব্যারিস্টার আশিক আলী। এর মধ্য দিয়ে লেবার পার্টির চিন্তাধারার পরিবর্তন আসে বা আসতে বাধ্য হয়। ১৯৮৩ সালে স্টেপনি থেকে কমন্স সভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ব্রজেন্দ্রনাথ চৌধুরি। ১৯৮৫ সালের উপনির্বাচনে স্টেপনি থেকে হেলাল উদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তখন তিনি ২৩ বছরের তরুণ। ১৯৯৫ সালে টাওয়ার হ্যামলেটস বরোর প্রথম বাঙালি মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন লেবার পার্টির গোলাম মর্তুজা। এর আগে ১৯৯০ সালে স্থানীয় কাউন্সিলন নির্বাচনে দুজন বাঙালি নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে পলা মঞ্জিলা উদ্দিন এবং লুইসাম বরো থেকে ডাক্তার মাহমুদা কবির।
পূর্ব লন্ডনের রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের যাত্রা কেবল শুরু হয়েছিল। কমন্স সভার জন্য পলা মঞ্জিলা লেবার পার্টির মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হন। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ২২ জুলাই দলটির মনোনয়ন পেয়ে অনির্বাচিত লর্ড সভার ‘ব্যারোনেস’ হয়েছিলেন। দুই কক্ষবিশিষ্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম বাঙালি নারী সদস্য তিনি। এরপর পূর্ব লন্ডনের রাজনীতিতে বাঙালি ও মুসলিম নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ে। ২০১০ সালের ৬ মের নির্বাচনে বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রধান তিনটি দলের প্রার্থীসহ মোট সাতজন প্রার্থী ছিলেন বাঙালি। এদের মধ্যে রুশনারা আলী প্রথম বাঙালি-ব্রিটিশ এমপি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এখানেই শেষ নয়, তিনি লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভায় আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।
এছাড়াও যেসব বাঙালি-ব্রিটিশ ব্রিটেনের পার্লামেন্টের এমপি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে আরো আছেন আফসানা বেগম, রুপা হক, টিউলিপ সিদ্দিক, ফয়ছল চৌধুরী প্রমুখ। এদের প্রত্যেকেই লেবার পার্টির এমপি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত হয়েছেন। যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে বিভিন্ন শহরের মেয়র হিসেবেও বাঙালিরা দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত লুত্ফর রহমান টাওয়ার হ্যামলেটস, নাদিয়া শাহ ও নাসিম আলি ক্যালডনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।