মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরের চা–শ্রমিক মাকে নিয়ে আবেগঘন পোস্ট দেওয়া সেই সন্তোষ রবি দাস’র মাকে সম্মাননা স্মারক ও উপহার দেওয়া হয়েছে৷ গতকাল ২০ আগষ্ট (শনিবার) সন্ধ্যায় তার নিজ বাড়ীতে নিরাপদ সড়ক চাই কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার পক্ষ থেকে চা শ্রমিক মেধাবী সন্তোষ রবি দাসের মা’কে শ্রেষ্ঠ মায়ের সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।
২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে উপজেলায় মাকে সম্মাননা দেওয়া হবে বলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জানানো হয়। পরে মায়ের নামটা কেটে দেওয়া হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মা আমার চা শ্রমিক। স্টেজে উঠে নাকি কিছু বলতে পারবেন না। তাই নাম কেটে দিয়েছে! সন্তোস রবি দাস তাঁর মা আগে দৈনিক মজুরি পেতেন ৮৫ টাকা। এখন পান ১২০ টাকা। মায়ের এ আয়ে তাঁদের সংসার চালানো কঠিন ছিল। তাঁর মা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ক্ষদ্রঋণ নিয়ে ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জুগিয়েছেন। আর ঋণের কিস্তি পরিশোধে চা বাগানের কাজের পাশাপাশি পাহাড়ি ছড়ায় বালু উত্তোলনের কাজ করেছেন। সংসারে মা-ছেলে আলুসেদ্ধ খেয়ে বহু রাত কাটিয়েছেন।
ভাইরাল হওয়া পোস্টের সূত্র ধরে নিরাপদ সড়ক চাই কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমতিক্রমে সন্তোষ’র মা কমলি রবি দাসকে শ্রেষ্ঠ মায়ের সম্মাননা দিতে কমলগঞ্জ উপজেলা নিরাপদ সড়ক চাই যোগাযোগ করেন। পরে গতকাল ২০ আগষ্ট (শনিবার) সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার জেলার শমসেরনগরে ফাঁড়ি কানিহাটি চা-বাগানের চা–শ্রমিক সন্তোষ রবি দাসের বাড়ীতে যান নিরাপদ সড়ক চাই কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার নেতৃত্ববৃন্দ৷ পরে চা শ্রমিক সন্তোষ রবিদাসের মাকে শ্রেষ্ঠ মায়ের সম্মাননা স্মারক ও উপহার প্রদান করেন নিরাপদ সড়ক চাই কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার আহবায়ক মোঃ আব্দুস সালাম, সদস্য সচিব এ এস এম কাইয়ুম৷ এসময় উপস্থিত ছিলেন আবিদুর রহমান কাওছার, সবুজ আহমেদ, তারেকুল রহমান অনিক, সাংবাদকর্মী রফিকুল ইসলাম জসিম প্রমুখ।
সন্তোষ রবিদাসের মা’কে শ্রেষ্ঠ মায়ের সম্মাননা তুলে দেওয়ার এ সময় নিরাপদ সড়ক চাই কমলগঞ্জের সদস্য সচিব এ এস এম কাইয়ুম সন্তোষের মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমরা আপনার জীবনের গল্প গুলো শুনছি, আপনার ছেলে যখন ৬ মাস বয়স তখন আপনার স্বামী মারা যান। চা বাগানে যে মজুরি পান আমি জানি এই ১২০ টাকা মজুরিতে ছেলেকে ভালোভাবে লেখাপড়া করা সম্ভব না৷ বরং আপনি আপনার ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া সম্পূর্ণ করেছেন এজন্য আপনাকে নিরাপদ সড়ক চাই কমলগঞ্জ সভাপতি সহ অন্যান্য সদস্য এই সম্মাননা দিচ্ছি৷
পোস্ট ভাইরাল হাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী সন্তোষ বলেন, এই মুহূর্তে চা শ্রমিকদের মজুরি যদি না বাড়ে তাহলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে চা শ্রমিকদের অনাহারে থাকতে হবে। আমি পোস্টটি দিয়েছিলাম আমার মা সহ সব চা শ্রমিকের করুণ অবস্থা সবার সামনে তুলে ধরার জন্য। সন্তোষ রবি দাস আরও বলেন, ‘চাকরিটা আমার প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহূর্তে চা শ্রমিকদের মজুরি আন্দোলন হচ্ছে আমি সবাইকে অনুরোধ করব, আমাকে চাকরি দিয়ে চা শ্রমিকদের ন্যায্য আন্দোলনটা যেন ভিন্নখাতে না নেওয়া হয়।’
সন্তোষ’র মা কমলি রবি দাস নিজের মুখ থেকে কষ্টের জীবন কাটানো দিনগুলো গল্প শুনালেন – সন্তোসের জন্মের ছয় মাসের মাথায় বাবাকে হারান। মা চা-বাগানের শ্রমিক। তখন মজুরি পেতেন দৈনিক ১৮ টাকা। ২০০৭ সালে সন্তোষ রবি দাস যখন ক্লাস ফাইভে পড়েন তখন তাঁর মায়ের মজুরি ছিল ৮৮ টাকা। পঞ্চম শ্রেণির পর ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে পাঁচ বছরের জন্য বিনা মূল্যে পড়ালেখার সুযোগ পান। তখন তাঁর মা সামান্য আয়ের একটা অংশ থেকে তাঁকে টিফিন খাওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দিতেন। সন্তোষ রবি দাস ২০১৩ সালে বিএএফ শাহীন কলেজে ভর্তি হন। তখন তাঁর মা ১০২ টাকা করে মজুরি পেতেন। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভর্তির টাকা, ইউনিফর্ম আর বই-খাতা কিনে দেন মা। এইচএসসির পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কোচিংয়ের টাকা জোগাতে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে আবার তাঁর মাকে ঋণ নিতে হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সন্তোষ। এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহায়তা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন সন্তোষ।