মৌলভীবাজারের ছোট একটি গ্রাম হোমেরজান। সে গ্রামেরই মণিপুরি সম্প্রদায়ের মেয়ে তাওরেম সানানু।
ঢাকার বটমলী হোম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে কেটেছে তাঁর স্কুলজীবন। কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই অবসরে যান বাবা। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাওরেমকে গ্রামে ফিরে যেতে হয়। কলেজজীবন শুরু হয় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ গণ মহাবিদ্যালয়ে। সেখানে পড়াশোনার মান খুব একটা ভালো ছিল না। এইচএসসি পরীক্ষার পর ভর্তি কোচিং করার সুযোগও তাঁর হয়নি। একসময় ভেবেছিলেন, পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু নিজ প্রচেষ্টায় মেডিকেল ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দুটিতেই টিকে যান তাওরেম।
স্বর্ণপদকজয়ী তাওরেম সানানু
বেছে নেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগ। যে সময়ে স্থাপত্যে পড়তে বুয়েটে পা রাখেন, তখন তাঁর সম্প্রদায়ের কারও বিষয়টা সম্পর্কে ধারণা ছিল না। অনেকে ভাবত, স্থাপত্য নিশ্চয়ই ছেলেদের পড়ার বিষয়। মেয়েদের জন্য বরং ডাক্তারিটা ঠিক আছে। কিন্তু স্থাপত্য বেছে নিয়ে যে ভুল করেননি তাওরেম, প্রমাণ ‘থিসিস অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার। এ বছর আর্কএশিয়ার এ পুরস্কার জিতে নিয়েছে তাঁর থিসিস প্রকল্প।
আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল এশিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপ আর্কএশিয়া। এশিয়ার ২২টি দেশ নিয়ে গঠিত এ কাউন্সিল। প্রতিবছরই স্থাপত্য–সংক্রান্ত নানা প্রতিযোগিতা ও সেমিনার আয়োজন করে আর্কএশিয়া। আর্কএশিয়ার বার্ষিক সম্মেলনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় পুরস্কার।
এ বছর সম্মেলন হয় মঙ্গোলিয়ায়। স্বর্ণপদকজয়ী হিসেবে সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তাওরেম সানানু। বাংলাদেশ দলের সর্বকনিষ্ঠ এই সদস্য মণিপুরি সম্প্রদায়ের নিজস্ব পোশাক পরে উৎসবে অংশ নেন। তাওরেম বলেন, ‘হোমেরজান থেকে মঙ্গোলিয়া পৌঁছে যাওয়ার পুরো ব্যাপারটাই ছিল আকস্মিক। খবরটা শুনে আমার পরিবার, বন্ধুরা খুব অবাক হয়েছিল। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ এবং বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আমাকে সাহায্য করেছে। একদম শেষ মুহূর্তে ভিসা পেয়ে মঙ্গোলিয়া যাই।’ আর্কএশিয়ার এবারের আসরের সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশি স্থপতি অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ। বাংলাদেশি সভাপতির হাত থেকে বাংলাদেশের একজনই স্বর্ণপদক নিচ্ছেন, এ-ও ছিল একটা অন্য রকম আনন্দের মুহূর্ত।
তাওরেমের সাম্প্রতিক অর্জনের ঝুলিতে আছে আরও একটি পুরস্কার। দ্য গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভর্ন্যান্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল আয়োজিত গ্লোবাল মিডিয়া কম্পিটিশন ২০২২-এ তাঁর নকশা করা পোস্টার জিতে নিয়েছে গ্রাফিকস ডিজাইন ক্যাটাগরির প্রথম পুরস্কার। ‘টোব্যাকো ডাজন্ট ডিকম্পোজ ইটসেলফ, ইট ডিকম্পোজ ইউ (তামাক নিজে পচে না, আপনাকে পচায়)’ শিরোনামে তাওরেমের পোস্টার সারা পৃথিবী থেকে জমা পড়া ৮০০ পোস্টারের মধ্যে প্রথম হয়। পুরস্কার হিসেবে তাওরেম পেয়েছেন দুই হাজার ডলার। তাওরেম বলেন, ‘যারা ধূমপায়ী, তাদের সিগারেটের ফিল্টার কিন্তু আমাদের আশপাশেই পড়ে থাকছে। এ ফিল্টার সহজে মাটির সঙ্গে মিশে না, যা আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি।’
ও হ্যাঁ, তাওরেমের থিসিস প্রকল্পটি নিয়ে এবার বলা যাক। শিরোনাম ছিল—ব্লারিং দ্য লাইন (মুছে ফেল সীমারেখা)। শহরের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের মাঝখানে যে অদৃশ্য সীমারেখা, সেটাই মুছে ফেলতে চেয়েছেন তাওরেম। বস্তিবাসীর জন্য একটি উদ্যোক্তা মডিউল তৈরি করেছেন তিনি। ট্রেনিং সেন্টার, বাচ্চাদের থাকার জায়গা, ওয়ার্কস্টেশন—সব মিলিয়ে বস্তির মানুষের জন্য একটি আবাসের নকশা করেছেন তিনি।
তাওরেম বলেন, ‘শহরের বস্তিগুলোয় দিন দিন মানুষ বাড়ছে। সে তুলনায় বস্তির আর্থসামাজিক পরিবর্তন তেমন দেখা যায় না। ফলে শহরের জন্য বস্তিগুলো একসময় বোঝা হয়ে ওঠে। সেই জায়গা থেকেই আমার এ প্রকল্পের কথা ভেবেছি।’
নিজ সম্প্রদায়ে তাওরেম হয়ে উঠেছেন একজন উদাহরণ। যে এলাকার মানুষ বুয়েটে পড়ার কথা ভাবতে পারত না, স্থাপত্যবিদ্যা বিষয়ে যাদের পরিষ্কার কোনো ধারণাও ছিল না, সেখান থেকে তাদের মেয়ে এখন শুধু এই বিদ্যা নিয়ে পড়ছেই না, বাইরে থেকে পুরস্কারও আনছে। পুরস্কার, সনদ, সম্মেলন—সবকিছু ছাপিয়ে এটিই তাওরেমের বড় অর্জন।