————–
একবিংশ শতাব্দি যেন আধুনিক প্রযুক্তির সোনালি শতাব্দি। শতাব্দির পর শতাব্দি প্রযুক্তির হ্রাস নয় বরং নতুন নতুন প্রযুক্তির ঝড়ো বাতাস আমাদের দেশ সমাজ ও পরিবারে এসে পৌঁছাচ্ছে। আমাদের জাতীয় জীবনে প্রযুক্তির ক্রমাগত এই উন্নতির ফলে আমাদের দেশে সাহিত্যচর্চায় এক বিরাট প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের মানুষ দিনের পর দিন প্রযুক্তিমুখী চিন্তার এক নতুন ধারার প্রতি ধাবিত হচ্ছে। যা সাহিত্যবিমুখ ও সাহিত্যের প্রতি অনীহাও লক্ষ্যের কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
একসময় কোথাও ভ্রমনকালে যাত্রীদের হাতে সাহিত্যের বই দেখা যেতো এখন বইয়ের বদল স্মর্টফোন নতুবা ল্যাপটপে সময় পারাপার করতে দেখা যায়। যেসব শিশুরা মায়ের পাশে বসে গুনগুন করে ছন্দসুরে ছড়া পড়তো সেই শিশুদের গুনগন সুর বদলে গিয়ে এখন রূপ নিয়েছে ভিডিও গেইমের মিউজিক সুরে। বইমেলাগুলোতেও পাঠকমহলের অভাব লক্ষ্যণীয়। সাহিত্যচর্চার এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিক্ষার্থী যখন লেখালেখি তথা সাহিত্যচর্চা শুরু করে তারাও দেখা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকার কর্তৃক যথাযথ মূল্যায়ন না পেয়ে কালের কোন এক দমকা হাওয়াই ছিকটে যাচ্ছে হতাশার দেশে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক শিক্ষার্থী উঠে আসছে যাদের রবীন্দ্র—নজরুলের উত্তরসূরী বলা যেতে পারে। তারা বাংলা সাহিত্য নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির এই রণক্ষেত্রেও লড়াই করে বাঁচতে চান এবং বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম নেতৃস্থানীয় সাহিত্যে রূপ দিতে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে যাচ্ছেন।
সরকার বিশ্বায়নের এই শতাব্দিতে প্রযুক্তিমুখী চিন্তা বিনির্মাণের ফলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যয়বহুল বিজ্ঞানাগার স্থাপন করে দিচ্ছে যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। ক্রীড়ার জন্যেও দেখা যায় বার্ষিক ক্রীড়াপ্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিযোগী ও ক্রীড়ামোদীদের পরিতৃপ্ত করা হয়। যা অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার। গান-সংগীত মঞ্চনাটক আবৃত্তি তথা সংস্কৃতিচর্চার অপূর্ব সুযোগ সুবিধা সরকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে সেসবে যুক্ত স্ব-স্ব শিক্ষার্থীদের আলাদা সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাহিত্যচর্চার মত এতবড় একটি নান্দনিক শিল্পের জন্য সরকার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যতিক্রম কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলে লক্ষ্য করা দুরূহ। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সৃষ্টিশীল নবীন লেখক-সাহিত্যিকদের সনাক্তকরণপূর্বক উন্নত সাহিত্যচর্চাকেন্দ্র স্থাপন করলে বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে নেতৃত্ব দেয়ার উপযোগী হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানচর্চার এই যুগে সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের বহুমাত্রিক অবহেলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক নবীন লেখকদের দাবি। সাহিত্যিকরা চাইলে দেশে বিরাজমান সংকট ও দুর্দশা রুখে দিতে পারেন তাঁদের লেখনীশিল্পের শানিত খুরাঘাতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কথা বিশ্বাস করতেন বলেই তিনি বলেছিলেন: ‘দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও চিরন্তন সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না সুখ-দুঃখকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য শিল্পী সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের আহ্বান জানাচ্ছি”।
জনগনের হাসি-কান্না সুখ-দুখ ও কৃষ্টিকালচার নিয়ে কথা বলে সেই দেশীয় সাহিত্য। আর এই সুখ-দুখের হাসি-কান্না ও কৃষ্টিকালচারের মাঝেয় মিশে থাকে একটি জাতির অতীতের করুণ ইতিহাস। দেশের মানুষের মাঝে নৈতিকতার প্রদীপ জ্বালাতে হলে শিক্ষার এক বৈপ্লবিক গণজোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। আর সেই শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গের নাম সাহিত্যচর্চা। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেছিলেন ”যিনি যাই বলুন সাহিত্যচর্চা যে শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই”।
বিজ্ঞান মানুষকে নৈতিকতা শেখায় না, বিজ্ঞান মানুষকে কোন বিষয়ের ওপর গভীর পর্যবেক্ষণের সামর্থ্য যোগায় কেবল। নৈতিকতা ও মনুষ্যত্ব শেখানোর শক্তি আছে কেবল সাহিত্যের। যে দেশে সাহিত্যিকদের যত বেশি মূল্যায়ন রয়েছে সেই দেশগুলোর সাহিত্য ততবেশি প্রাঞ্জল ও সমৃদ্ধ। আর সাহিত্যের উন্নতি মানে জাতীয় জীবনে স্বচ্ছতা বহন করার ইতিহাস সুবিস্তৃত। এবং গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, ক্রমান্বয়ে তারাই অন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নেতৃত্বের চূড়ায় আরোহন করছে। নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বকীয়তাকে বিশ্ববাসীর কাছে মডেল হিসেবে উত্থাপন করতে হলে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমেই একমাত্র তা করতে সক্ষম। এজন্যেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথঠাকুর বলতেন, ”অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষায়, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলায় সাহিত্যের কাজ”।
কাজেয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যদি নবীন লেখক-সাহিত্যিকদের জন্য সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র নির্মাণপূর্বক তাদেরকে সনাক্তকরণের সরকার কর্তৃক কোন বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা নাহয় তাহলে বাংলা সাহিত্যের সুন্দর আগামী অসুন্দরে পর্যবসিত হবে।
———-
ফায়াজ শাহেদ
শিক্ষার্থী: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।