
---------
সাহারার দক্ষিণ প্রান্তে, নীল নদের দু’কূল জুড়ে গড়ে ওঠা আফ্রিকার অন্যতম বৃহত্তম একটি দেশ সুদান। যা ছিল এক সময়কার আফ্রিকার শস্যভান্ডার(খাদ্যভান্ডার নয়)।স্বাধীনতার পরপরই, ১৯৫৬ থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত, সুদান ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে বড় তুলা উৎপাদক, বিশাল গমের মাঠ, সোর্গাম আর তৈলবীজের গুদাম। জাজিরা প্রকল্পের সেচব্যবস্থা বিশ্বের বৃহত্তম একক সেচ প্রকল্প ছিল। পোর্ট সুদান দিয়ে রপ্তানি হতো লাখ লাখ টন শস্য, যা মিশর, সৌদি আরব, ইউরোপের মত দেশের মুখে খাবার তুলে দিত। খার্তুমের বাজারে মিলতো সোনা, গোলাপজল আর মশলার মতো দামি এবং রাজকীয় উপাদান। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে ১৯৬০-এর দশকে সুদানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭% যা আজকের কেনিয়া বা ইথিওপিয়াকেও হার মানায়। আফ্রিকার দেশ হয়েও সুদান তখন ছিল সমৃদ্ধির প্রতীক, আশার আলো।কিন্তু আজ সেই সুদানই মৃত্যুপুরী। আজকে সেখানে খাদ্যের তীব্র সংকট। নীল নদের পাশে উর্বর ভূমি হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আজ ফসল ফলানো যাচ্ছে না। মানুষ অনাহারে বিনা অপরাধে রক্ত ঝরছে।
বিশ্ব ধীরে ধীরে অসুস্থ পরিবেশে রূপ নিচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী ১কোটি ২০ লাখ মানুষ গৃহহীন, ২কোটির ও বেশীসংখ্যক মানুষ খাদ্যসংকটে ভুগছে। সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে। তবে ঘটনার সূএপাত আরো আগে থেকে, ১৯৮৯ থেকে ২০১৯ সাল পযর্ন্ত ক্ষমতায় ছিলেন প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশির। ২০১৯ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। অনেকটা সময় ধরে ক্ষমতায় থাকায় কারণে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জনবিক্ষোভ তৈরী হয়। এরপর সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী গঠিত হয়।রাজধানী খার্তুম সহ বিভিন্ন প্রান্তে, যুদ্ধ হয় মূলত সামরিক বাহিনী sudanese Armed forces ( SAF) যার নেতৃত্বে আছেন জেনারেল আবেদল ফাত্তাহ আল বুরহান, এবং আধাসামরিক বাহিনী Rapid support force (RSF) যার নেতৃত্বে আছেন মোহাম্মদ হামদান দাগালো। দুটি বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বই মূল কারণ। আর এসএফ গঠিত হয় ২০১৩ সালে, জেনারেল দাগালো আরএসএফকে শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত করেন। সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতা টিকিয়ে থাকার লড়াই ই বর্তমান গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়। আল ফাশির ই ছিলো সেনাবাহিনীর শেষ দুর্গ।আরএস এফ আল ফাশির দখল করে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়, স্যাটেলাইয়ের মাধ্যমে দেখা গিয়েছে আল ফাশিরে রক্তের দাগ, প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গিয়েছে আরএসএফ এর সেনাবাহিনীরা,তবে দারফুরের রাজধানীর আল ফাশিরে নৃশংস গণহত্যা, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ইউনিসেফ শিশু সংস্থা জানিয়েছিলো আরএসএফরা একবছরের বাচ্চাকে পযর্ন্ত নিযার্তনের হাত থেকে রেহাই দেয়নি।
আরব আমিরাতে স্বর্ণ পাচার অভিযোগ রয়েছে। আর এস এফের বিরুদ্ধে। এছাড়া দরফুরের অনেক বাসিন্দা মনে করেন আরএসএফ ও সহযোগি মিলিশিয়ারা জাতিগতভাবে মিশ্র জনগোষ্ঠীর অঞ্চলটিকে আরব শাসিত অঞ্চলে পরিণত করার লক্ষ্যে যুদ্ধ চালাচ্ছে। আরো অভিযোগ ওঠছে UA সীমান্ত দিয়ে আরএসএফকে অস্র পাঠাচ্ছে আরব আমিরাত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে আর এসএফ ও অন্যান্য দল মিলে গণহত্যা চালাচ্ছে যা " জাগতিক নির্মুল অভিযান "বলে আখ্যায়িত করা হয়। এটি যেন যুদ্ধ নয় জাতিগত ঘৃণা। দরফুরের জগওয়া, ফুর, বেরোতি তিন অনারব জাতিগোষ্ঠীকে টার্গেট করে গণহত্যা চালাচ্ছে।প্রথমে সংখ্যা সীমিত ছিলো কিন্তু এখন রাজধানী খরতুম সহ অন্যান্য এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। খরতুম ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে, শান্তির প্রতীক হিসেবে খ্যাত এবং স্বাধীনতা বিপ্লবের আলো জ্বেলেছিলো সেখানে আল ফাশির আজ সেখানে প্রকট আকার ধারণ করেছে হত্যাযজ্ঞ ও দুর্ভিক্ষ। উর্বর জমি দখলে নিতে ব্যস্ত।
বতর্মান সুদানে RSF যা করেছে তা ইসরাইল দ্বারা সংগঠিত গাজার গণহত্যাকে হার মানায়। গত ২দিনে সুদানে আল ফাশিরে ২০০০ বেশী মুসলিমকে হত্যা করেছে, RSF মিলিশিয়ারা। UN নিরাপত্তা উপসচিব জানিয়েছে, EI FASHER একটি হসপিটালে গতকাল ৪৬০ জন রোগী ও সঙ্গী নিহত হয়েছে। যোগাযোগ বিছিন্ন থাকায় সঠিক তথ্য কাউন্ট করতে পারিনি। যখন যুদ্ধবাজরা তেল, স্বর্ণ খনি, উর্বর জমি দখলে ব্যাস্ত তখন সাধারণ সুদানির মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মিসর, আরব আমিরাত সব দেশ কোনো না কোনো ভাবে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে, ফলে সুদানের আজ এই অবস্থা। হসপিটাল ভেঙ্গে পড়েছে, খাদ্যসংকট, পুরুষদের গ্রেপ্তার ও হত্যা, নারীদের ধর্ষণ,
ফসলের মাঠের গান পাউডারের গন্ধে মৃত কৃষক, মৃত মায়ের পাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা দুধের শিশু, দুধের শিশুকেও নির্বিচারে হত্যার দৃশ্যই যেন সুদানের বর্তমানে নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যেন ইতিহাসক্ষ্যাত গণহত্যার দৃশ্য কেও হার মানায়।
এ যুদ্ধ স্বার্থের যুদ্ধ, যা গরিব মানুষদের নিঃশেষ করে পৈশাচিক আনন্দে মেতে ওঠে। দখলদারিত্ব, ক্ষমতালোভ, স্বর্ণ খনিজ সম্পদের বিনিময়ে দিতে হচ্ছে তাজা প্রাণ।
মানবতার নামে আমাদের নীরবতা সুদানীয়দের নিত্য বইয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জাতিসংঘ তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে, ইউরোপ উদ্রেগ প্রকাশ করছে। আমেরিকা বলেছে তদন্ত চলবে, তবে কেউ কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। যে যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত।যার ফলাফল আল ফাশিরে
তীব্র আগুনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।পাশাপাশি মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে একটি জাতি এবং আমাদের মানবতা। এই হত্যাযজ্ঞ যদি থামানোর না যায় তাহলে একটা জাতি পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যাবে যার জন্য দায়ী থাকবো আপনি আমি এবং আমরা সবাই পরোক্ষভাবে আমরাই খুনী। সুদানের পতন শুধু একটি দেশের নয়, এটি মানবতার বিবেকের পরীক্ষা। যে শস্যভাণ্ডার আফ্রিকাকে খাইয়েছে, সেই দেশকে আজ বিশ্ব খাওয়াচ্ছে কান্না। কিন্তু কান্না শেষ হবে যখন হাত বাড়াবে বিশ্ব যখন অস্ত্রের বদলে আসবে ওষুধ, গোলার বদলে শস্য, যুদ্ধের বদলে শান্তি।সকল অন্যায় অবিচার হানাহানি বন্ধ হোক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক মানবতার জয় গান রচিত হোক বিশ্বজুড়ে।
লেখক :
সাদিয়া আফরিন
শিক্ষার্থী , ইডেন মহিলা কলেজ
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০