---------
আক্ষরিক অর্থে মা শব্দটি অত্যন্ত ছোট মনে হলেও এর ভাবার্থ অনেক। সাগর, উপসাগর কিংবা মহাসাগরের চেয়েও যোজন যোজন বেশি মা শব্দের বিশালতা। মা শব্দটি শুধু শব্দতেই সীমাবদ্ধ নয়, সন্তানের কাছে আবেগ অনুভূতির সংমিশ্রণ। মা এবং সন্তানের অস্তিত্ব একে-অপরের পরিপূরক। মা বিহীন সন্তান পৃথিবীতে মূল্যহীন, মাকে ছাড়া সন্তান কখনো রঙিন পৃথিবীতে পদার্পণ করা সম্ভব নয়।
মা শব্দটি সহস্র কোটি ঋণের জালে বাঁধা। সন্তান মায়ের কাছে মহাসাগরের জলরাশির সমান ঋণী কিন্তু সন্তানের পক্ষে এক সুইচ পরিমাণ ঋণ শোধ করা বড্ড কঠিন। সন্তানকে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখানোর জন্য মা দীর্ঘ দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেন।যার প্রতিটি মুহূর্তের কষ্টের জরিপ করলে হয়ে যাবে সুবিন্যস্ত কোনো মহাকাব্য।
প্রতিটি সন্তানের কাছে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ হলো তার মা। কারণ মানুষ সামাজিক জীব। সে সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠে। আর সামাজিকীকরণের প্রথম এবং প্রধান ধাপ হলো পরিবার। পরিবারের সবচেয়ে কাছের এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলো মা। যিনি সন্তানকে আচার-আচরণ, আদব- কায়দা জব্দ করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। সন্তানকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেন। মাকে একজন শিক্ষকও বলা চলে। কারণ, সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষার কাজটা তিনি খুব সুচারুভাবে সম্পন্ন করেন।
মায়ের তুলনা মা কেবল নিজে। মা সন্তানের পাশে থাকলে কখনো সন্তানের অভাববোধ হয় না, বরং পরিপূর্ণ মনে হয়। আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, ‘যার মা আছে, সে কখনোই গরীব নয়’।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন বলেছেন, ‘আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা হলেন আমার মা। মায়ের কাছে আমি চিরঋণী। আমার জীবনের সমস্ত অর্জন তারই কাছ থেকে পাওয়া নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা আর শারীরিক শিক্ষার ফল।’
জোয়ান হেরিস বলেন, ‘সন্তানেরা ধারালো চাকুর মতো। তারা না চাইলেও মায়েদের কষ্ট দেয়। আর মায়েরা তাদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত সন্তানদের সাথে লেগে থাকে।’‘আমার বসার ঘরের দেয়ালে আমার মায়ের ছবি টাঙানো আছে, কারণ তিনিই আমার কাছে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। ’ এলেন ডে জেনেরিস। ‘কোনো একটা বিষয় মায়েদের দুইবার ভাবতে হয়-একবার তার সন্তানের জন্য আরেকবার নিজের জন্য।’ সোফিয়া লরেন।
মায়ের এত কষ্ট, এত ভালবাসা ধূলিসাৎ করে কখনো কখনো দেখা যায় মাকে বৃদ্ধাশ্রম নামক নরকে। সেখানে বসেও অকৃতজ্ঞ ছেলের জন্য দুফোঁটা জল ফেলে মঙ্গল কামনা করেন। একজন সন্তান কতটা অকৃতজ্ঞ আর অসুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হলে মাকে উপহার দেয় বৃদ্ধাশ্রম। সন্তানের কাছে মায়েদের কখনো বড় কোনো চাওয়া থাকে না, বরং তারা চায় সন্তান হাসি মুখে বেঁচে থাকুক নশ্বর পৃথিবীতে।
ইতিহাস বলছে, ১৯০৭ সালের ১২ মে প্রথমবার আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরে ‘মাদার্স ডে’ বা মা দিবস পালিত হয়। এই দিনটি পালনে রয়েছে এক ইতিহাস। ভার্জিনিয়ায় অ্যান নামে এক শান্তিবাদী সমাজকর্মী ছিলেন। তিনি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। তিনি ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতেন। নারীদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করতেন। অ্যান ছিলেন খুবই ধর্মপ্রাণ।
অ্যানের একটি মেয়ে ছিল, যার নাম আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস। একদিন ছোট মেয়ের সামনেই অ্যান হাত জোড় করে বলেছিলেন, ‘আমি প্রার্থনা করি, একদিন কেউ না কেউ, কোনো মায়ের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুক। কারণ, তারা প্রতিদিন মনুষ্যত্বের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। এটি তাদের অধিকার।’
মায়ের সেই প্রার্থনা হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায় অ্যানার। অ্যানের মৃত্যুর দিনটিকে সারাবিশ্বের প্রতিটি মায়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন তিনি। তারপর থেকে মায়েদের প্রতি সম্মানে পালিত হয়ে আসছে মা দিবস। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা দিবস’ ঘোষণা করেন।
বৃদ্ধাশ্রম নয় বরং মমতাময়ী মায়ের একমাত্র স্থান হোক সন্তানের হৃদয়ে। মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসায় ভরপুর হয়ে যাক পৃথিবী। তবেই কোনো নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন হবে না মাকে ভালোবাসতে, সন্তানের কাছে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে ওঠবে মা দিবস। পৃথিবীর বুক থেকে যেদিন দুমরে মুচড়ে ভেঙে ফেলা হবে বৃদ্ধাশ্রম, যেদিন পৃথিবীতে বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে আটক থাকবে না কোরো মা, সেদিন মা দিবস সার্থক হবে।
লেখক: জুবায়েদ মোস্তফা
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০