উপ-সম্পাদকীয়ঃ
মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
বাল্যবিবাহ শুধু সামাজিক ব্যাধি নয় অভিশাপও বটে। কেননা নিজেকে জানার বুঝার আগে একজন কিশোরী বাল্যবিবাহের বলি হচ্ছেন। দুঃখজনকভাবে তাঁর স্বাস্থ্য শারীরিক গঠন মন-মানসিকতা বিবাহের জন্য উপযুক্ত হওয়ার আগেই তাঁকে অপুষ্টি শারীরিক ও মানসিক সমস্যা এবং মৃত্যু ঝুঁকির মতো ভয়ংকর ও সর্বনাশা পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আর্থিক-অসঙ্গতি, যৌতুক সামাজিক প্রথা, ধর্মীয় ও সামাজিক চাপ, অঞ্চলভিত্তিক রীতি, অবিবাহিত থাকার শঙ্কা, নিরক্ষরতা, মেয়েদের উপার্জনে অক্ষম ভাবা, পরিবারের বোঝা মনে করা, ইভটিজিং, নারী সন্তানের নিরাপত্তার অভাব, নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি, স্কুল ও মাদ্রাসায় নারী শিশুদের ধর্ষণ খুনের শঙ্কা ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দিশেহারা করে তোলে। অসহায় এবং নিরুপায় হয়ে শারীরিকভাবে উপযুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও অনেক অভিভাবক তাঁদের কিশোরী কন্যাদেরকে বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে কম বয়সে বিয়ের কারণে অনেকের সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে এবং অপুষ্টি নবজাতক এবং কুমারিমতাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা আছে ১৮ বছর৷ এর কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে হলে সেটি হবে ‘বাল্যবিবাহ', যা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ৷ কিন্তু আইনের বিধিনিষেধ কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে এটি বন্ধ হচ্ছে না৷ফলশ্রুতিতে বাল্যবিবাহের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য, নবজাতকের মৃত্যু, শিশু পুষ্টি, কিশোরী মাতার মৃত্যু ঝুঁকি, শিক্ষা, উন্নয়ন, মানবিক ও সামাজিক বিপর্যয় দুষ্টচক্রের মতো আমাদের সমাজব্যবস্থায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সব মিলিয়ে একটি মেয়ের দেহ এবং মন-মানসিকতার ওপর বাল্যবিবাহের নেতিবাচক প্রভাব পড়া খুবই স্বাভাবিক। ভবিষ্যৎ নারী শিক্ষার অগ্রগতি সমৃদ্ধি মেধা মননশীলতা সৃষ্টিশীলতা প্রতিভা বিকাশ এবং প্রসার ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অঙ্কুরেই অনেক আশা স্বপ্ন এবং সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটছে। দেশ জাতি রাষ্ট্র সমাজ পরিবার এদের আর্থ-সামাজিক সেবা মেধা এবং সামাজিক উপযোগীতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাল্যবিবাহের কুফল এবং সামাজিক অবক্ষয়ের কথা জানা সত্ত্বেও চেয়ারম্যান মেম্বাররা ভোটের হিসেব নিকেশের কারণে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে, বাঁধা না দিয়ে চুপ করে থাকে। “করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। বাকিদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে মাউশির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখা দেশের ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০২১ সালের তথ্য সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে দেশে সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ২০ হাজার ২৯৪টি” {সূত্রঃ প্র/ আলো, ১৫ আগষ্ট’২২}। আমাদের দেশে শুধু যে দরিদ্র বা অল্প শিক্ষিত পরিবারে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে তা নয়৷ শহরে অনেক শিক্ষিত পরিবারেও দেখা যায়, বিদেশে পড়ালেখা করে এমন ছেলে পেলে মেয়ের বয়স বিবেচনা না করেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় অভিভাবকেরা। পাশাপাশি দেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন থাকা সত্ত্বেও আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অভিভাবকেরা অনেক সময় কাজিদের মেয়ের বয়স বাড়িয়ে বলেন৷ ফলশ্রুতিতে কনের বয়স প্রকৃতপক্ষে ১৮ বছর না হলেও কাগজে কলমে বাড়িয়ে লেখা হয়। প্রকৃতপক্ষে বাল্য বিবাহে মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের ওপর প্রভাব পড়লেও মেয়েরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দারিদ্রতা এবং নিম্ন আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে। পাশাপাশি বেশিরভাগ বাল্যবিবাহে ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক হলেও মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে। স্বাভাবিক কারণে মেয়েরাই বাল্যবিবাহের শিকার বেশী হচ্ছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালা, “২০১৮ অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের ক্ষেত্রে ধর্ষণ, অপহরণ, জোরপূর্বক বিয়ে বা শারীরিক সম্পর্কের ঘটনা ঘটলে ধর্ষক বা অপহরণকারীর সঙ্গে বিয়েও দেওয়া যাবে না”। অথচ আমাদেরে সমাজে লোকচক্ষুর ভয়ে অহরহ এই আইনের লঙ্ঘন ঘটতে দেখা যায়। অতীব পরিতাপের বিষয়, প্রচলিত আইনের প্রতি পরিবারগুলোর অশ্রদ্ধা অবহেলা উদাসীনতা অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচনার দাবী রাখে।
ইউনিসেফের শিশু ও নারী বিষয়ক প্রতিবেদনে অনুসারে বাংলাদেশের ৬৪% নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে৷অথচ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে ছেলেদের বিবাহের বয়স নুন্যতম ২১ বছর ও মেয়েদের বয়স ১৮ বছর হওয়া বাধ্যতামূলক৷ এক তথ্য থেকে জানা যায়,“অপরিপক্ক মেয়েরা মা হতে গিয়ে প্রতি ২০ মিনিটে একজন গর্ভবতি মা মারা যাচ্ছেন৷অন্যদিকে প্রতি ঘন্টায় মারা যাচ্ছে একজন নবজাতক৷নবজাতক বেঁচে থাকলেও অনেক সময় তাকে নানা শারীরিক ও মানষিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়”৷নারীর অগ্রগতি শিক্ষার হার বৃদ্ধি অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু অপুষ্টি রোধ করার জন্য বাল্যবিবাহ বন্ধ করা খুবই জরুরি। দুঃখের বিষয়, বাল্যবিবাহ বন্ধে বিরাট বাঁধা হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন, নারীর নিরাপত্তাহীনতা। নারীর প্রতি সামাজিক অবিচার অন্যায় বন্ধ করা, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান প্রদর্শন, অভিভাবকদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পাশাপাশি আইনের সঠিক কঠোর নির্মোহ প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্ষক ও খুনীদের বিচারের আওতায় আনতে সরকারকে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রিন্টিং এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার প্রচারণা শক্তিশালী করার মাধ্যমে জনমত গঠন করার পাশাপাশি গ্রাম পর্যায়ে উঠান বৈঠক ও মা সমাবেশ এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে বলে সমাজ বিজ্ঞানীদের অভিমত। প্রয়োজনে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষনিক বিবাহ বন্ধসহ মামলা রজ্জু করার জন্য সরকারের প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যতীত বিবাহ নিবন্ধন করতে না পারে সে বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা, প্রতিটি গ্রামে এবং ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা, নবম ও দশম শ্রেনীর পাঠ্য বইতে বাল্যবিবাহের কুফল এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন সম্পর্কিত বিষয়সমূহ অর্ন্তভুক্ত করার মাধ্যমে সুফল পাওয়া যেতে পারে বলে সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত। পাশাপাশি এনজিও বা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টতা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান বা ভুমিকা রাখতে পারে। দেশের শান্তি শৃঙ্খলা শান্তি প্রগতি অগ্রগতি আর্থ–সামাজিক এবং জীবন মানের উন্নয়নের জন্য বাল্যবিবাহ বন্ধে সংশ্লিষ্টমহলের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আইন প্রণয়ন করা সময়ের দাবী।
ধন্যবাদান্তে,
মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০