মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
“অসুস্থ হলে মানুষ চিকিৎসকের কাছে যান। চিকিৎসক ওষুধ লিখেন। এখন সেই ওষুধ যদি ভেজাল কিংবা অনুমোদনহীন হয়, তবে সেটি হয়ে উঠতে পারে নতুন রোগের কারণ।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুমোদনহীন কিংবা ভেজাল ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ।একবার ভেবে দেখুন, সুস্থ হওয়ার আশায় রোগী নিয়ম করে ওষুধ খাচ্ছেন।উল্টো ভিতরে ভিতরে নতুন নতুন রোগের উদ্ভব হচ্ছে।তবে অনুমোদনহীন ও ভেজাল ওষুধ যাদের তদারকি করার কথা, মাঠ পর্যায়ে তাদের জনবল সংকট রয়েছে”{সূত্রঃ দৈ/আজাদী,২৫ মার্চ’২৪}।জানা যায়, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় ১৫ হাজারের বেশি নিবন্ধিত ওষুধের পাশাপাশি অলিতেগলিতে প্রচুর অনিবন্ধিত ওষুধের দোকান রয়েছে।এছাড়া বিভিন্ন বাসাবাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ভেজাল ও অনিবন্ধিত ওষুধ বাজারজাত করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে এসব তদারকি করতে হয়।বিস্ময়, শঙ্কা এবং উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতে, এসব ওষুধ বাজারজাতকরণে সহায়তা করছেন খোদ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।বিভিন্ন অসাধু ওষুধ কারখানার মালিকদের সাথে যোগসাজস করে চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে এসব ওষুধ লিখছেন চিকিৎসকরা।এদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও আছেন।উল্লেখ্য, গত ২০ মার্চ’২৪ নগরের মেহেদীবাগ এলাকার শহীদ মির্জা লেইনে নুর ভিলা নামে একটি আবাসিক ভবনে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অনুমোদনহীন ওষুধ ও প্রসাধনী জব্দ করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।জানা গেছে, ভবনটিতে ভার্চুয়াল হেলথ কেয়ার নামে ঢাকার একটি ওষুধ কারখানার কার্যালয় ও গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।অভিযানে স্নায়ুবিক দুর্বলতা, যৌন সমস্যা, সৌন্দর্যবর্ধন, বন্ধ্যাত্ব সমস্যার ওষুধ ও প্রসাধনী পাওয়া যায়। তবে এসব ওষুধের অনুমোদন ছিল না।এর আগে ১৬ মার্চ’২৪ হাজারী গলিতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নষ্ট ইনসুলিন ও টিটেনাস ভ্যাকসিন জব্দ করা হয়।“ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এসএম সুলতানুল আরেফিন আজাদীকে বলেন, ভেজাল কিংবা অনুমোদনহীন ওষুধের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। তবে এক্ষেত্রে কিছু কিছু চিকিৎসক এসব ওষুধ তাদের ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।এখন বাজারে যদি কোনো একটি ওষুধের চাহিদা না থাকে, তখন তো সেটি আর কেউ কিনবে না।এছাড়া বিদেশি অনুমোদনহীন ত্বকের ক্রিম, তেল, ভিটামিন ও মিনারেল জাতীয় ওষুধ অনেক চিকিৎসক তাদের ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন”{সূত্রঃ দৈ/আজাদী,২৫ মার্চ’২৪}।আমরা কোভিডের মহামারির সময় দেখেছি ওষুধ এবং চিকিৎসা উপকরণ নিয়ে কত ধরণের নকল আর ভেজাল কর্মকাণ্ড।
সত্যিকার অর্থে খাদ্যে ভেজালের দৌরাত্ম থেমে নেই।খাদ্যে ভেজাল, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য দ্রব্য তৈরি করা কোনো নতুন বিষয় নয়।“সংযমের মাস রমজানে হোটেল-রেস্তোরাঁর সামনে শোভা পাচ্ছে চাকচিক্যময় ইফাতারির।এসব ইফতারি শতভাগ নিরাপদ নয়।বিভিন্ন ক্ষতিকর উ্পাদান মেশানোর কারণে প্রায় ক্ষেত্রে অনিরাপদ হয়ে উঠছে এসব ইফতারি পণ্য”{সূত্র” দৈ/পূর্বদেশ, ২৩ মার্চ’}।বিশুদ্ধ এবং পুষ্টিকর খাদ্য মানুষের জীবন ধারণের অন্যতম মৌলিক অধিকার।বিশুদ্ধ খাদ্য যেন এখন সোনার হরিণ।হোটেল রেস্তোরাঁর চোখ ঝলসানো সাজ-সজ্জা,আলোর ঝলকানির কোথাও কোনো কমতি নেই।কিন্ত অন্দরমহল তথা রান্নাঘরের পরিবেশ নোংরা, অস্বাস্থ্যকর।অনেকক্ষেত্রে এক ঘরেই রান্না বান্নার ব্যবস্থার পাশাপাশি শৌচাগার অবস্থিত থাকে।ফ্লোর ভেজা, ইঁদুর ও তেলাপোকার রাজত্ব।খাদ্য সংরক্ষণ বা ডিপ ফ্রিজে পচা বাসি খাবারের পাশাপাশি রান্না করা এবং কাঁচা মাছ-মাংশ তরিতরকারি, পিপারমেন্ট, সোডা ও বেকিং পাউডারসহ বিভিন্ন ধরণের উপকরণ একসঙ্গে বা পাশপাশি রাখা হয়।অথচ কেবলমাত্র ৫ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে এবং ৬০ডিগ্রি সেলসিয়াসেরবেশি তাপমাত্রাইয় খাদ্য নিরাপদ থাকে যা হোটেল রেস্তোরাঁয় সেভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না।ট্যালো, ফ্যাটি এসিড ও ইমউসাইল্টিং, টেক্সটাইল রঙ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বা কেমিক্যাল, ক্ষতিকর কীটনাশক, ফরমালিন, মনোসোডিয়াম, ইথোফেন, চক পাউডার, ইউরিয়া, মার্জারিন, পশুর চর্বি, খনিজ তেল, ন্যাপথলিন, ডিডিটি, সাইক্লোমেট, কাঠের গুঁড়ো, ইটের গুঁড়ো, পোড়া মুবিলসহ বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে খাদ্যে ভেজাল করা হয়।খাবারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং চাকচক্যময় করে তুলতে গিয়ে বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড ও সোডিয়াম সাইক্লামেট।খাদ্যে কৃত্রিম রং রাসায়নিক ব্যবহার করে বিষাক্ত এবং অনিরাপদ করে তোলা হচ্ছে খাদ্যকে।খাদ্যে ভেজাল মানবদেহের জন্য একটি নীরব ঘাতক যা ধীরে ধীরে সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তুলছে।ভেজাল খাদ্যদ্রব্য মানুষের কিডনি, হৃৎপিন্ড, অস্থিমজ্জা নষ্ট হচ্ছে।পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার,লিভার সিরোসিস,হাঁপানি ইত্যাদি অনেক বেড়ে যাচ্ছে।মানুষ হারাচ্ছে দৃষ্টি ও শ্রবণ শক্তি।নোংরা পরিবেশে তৈরি এবং ভেজাল খাদ্য একটি জাতিকে ক্রমশ পঙ্গুত্ব এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।বর্তমানে মাছ, মাংস, সবজি, তরকারি, ফলমূল, হোটেল রেস্তোরাঁর খাদ্য এমনকি শিশুখাদ্য ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল মেশাতে কার্পণ্য করছে না অসাধু ব্যবসায়ীরা।নকল ওষূধ এবং ভেজাল খাদ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিরট হুমকি।জনসচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারি এবং তদারকি জোরদারের পাশাপাশি সারাদেশে ভেজাল বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখা এবং মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র জরিমানা করে এসব অসাধু দুষ্টু চক্রকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।সব জড়িতদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।মনে প্রশ্ন জাগে, নকল ওষুধ আর ভেজাল খাদ্য খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকবে কিভাবে?
শুভেচ্ছান্তে,
মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
দেওয়ানবাজার চট্টগ্রাম।