--------
- কাজী আশফিক রাসেল
সম্প্রতি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন রাস্তায় একটি কুকুরের মুখে নবজাতক শিশুর লাশের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে কুকুর হাসপাতালের ডাস্টবিন থেকে শিশুটির মরদেহ কুড়িয়ে এনেছে। গা শিউরে ওঠার মতো অত্যন্ত জঘন্য ও নিষ্ঠুরতম এই ঘটনাটির নিন্দা জানিয়ে নেটিজেনদের অনেকেই শিশুটির মা-বাবার অবৈধ সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত করে শিশুটি 'পাপের ফসল' কিনা সেবিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই শিশুটি যদি পাপের ফসলও হয়ে থাকে তাহলে তাঁর বেচে থাকার অধিকার কেনো খর্ব হবে? যারা নবজাতক শিশুটিকে কুকুরের ভোজন বানিয়েছে অবশ্যই তারা কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট।
কিন্তু আমাদের যে সমাজ একটি নিষ্পাপ শিশুর নিথর মরদেহকে শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়েই পাপের ফসল বলে ভ্রু কুঁচকাতে পারে, সে-সমাজ বিনা বাঁধায় শিশুটিকে স্বাভাবিকভাবে বাচতে দিতো এর নিশ্চয়তা কি?
আজ যারা শিশুটির মরদেহ কুকুরের মুখে দেখে মায়াকান্না করছে, শিশুটি বেচে থাকলে হয়তো তারাই তাঁর বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিতো। 'জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো' - এসব নীতিবাক্যকে আমাদের ঘুণে ধরা সমাজ, মরে যাওয়া মনুষ্যত্ববোধ কাজীর গরুর মতো বানিয়েছে। যার অস্তিত্ব কেতাবে আছে, কিন্তু গোয়ালে নেই।
একটি জারজ শিশুর জন্মপরিচয় নিয়ে এই সমাজ যতটা নির্মমতা দেখায় ও ঘৃণা ছড়ায়, ততটা নির্মমতা ও ঘৃণাবোধ নিয়ে যদি অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারতো তাহলে বোধহয় এই সমাজের অভিধানে অপরাধ নামক কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া যেতো না।
আমাদের সমাজে গভীর গভীরতর অসুখ। এইতো ক'দিন আগে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির প্রতিবাদে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী নুরুল হুদা তাঁর ছাত্রজীবনের অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দেওয়া প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অসংখ্য নজির আছে, তবে অনিয়মের প্রতিবাদে এমন পদক প্রত্যাখ্যান বিরল। এমন সাহসী প্রতিবাদ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। শুধু আমাদের দেশই না সারা বিশ্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ স্তরের বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচনা হয় অথচ আমাদের দেশে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদেও যদি বিতর্কিত উপায়ে নিয়োগের সুযোগ থাকে তাহলে এর চেয়ে বড় সর্বনাশ আর কি হতে পারে!
যারা যোগ্য তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই যে দিনের পর দিন অযোগ্য লোকজন শিক্ষক হচ্ছেন তার ফল কিন্তু আমরা পাচ্ছি। অনৈতিকভাবে নিয়োগকৃত শিক্ষকের কর্মকাণ্ড কখনোই শিক্ষকসুলভ হয় না।
একজন অযোগ্য লোক শিক্ষক হওয়া মানে তার সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে বঞ্চিত করা।
যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বলা হয় জাতির বিবেক, সেই শিক্ষক যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তাহলে জাতির নৈতিকতা তখন আস্তাকুঁড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ফসল অবৈধ শিশুকে জারজ আখ্যা দিয়ে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করা যতটা না অকল্যাণকর, অবৈধ পন্থায় নিয়োগপ্রাপ্ত পেশাজীবী বা কোনো পদে সমাসীন ব্যক্তিকে জারজ আখ্যা দিয়ে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করা সমাজের জন্য ততটাই কল্যাণকর।
মাছের পচন যেমন মস্তক থেকে শুরু হয়, তেমনি যাবতীয় অসুখের জীবাণু এই সমাজের কথিত বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা-চেতনায় সুন্দরভাবে স্থান করে নিয়েছে।
তারা একদিকে নৈতিকতা- মূল্যবোধের সবক দিবে আবার অন্যদিকে নিজের আখের গোছাতে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জবরদখল, কালোবাজারি, লুটপাট, ধর্ষণ, অনিয়ম, ভোটাধিকার হরণ, বিচারের নামে প্রহসন, বিভাজন, বৈষম্য, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ হাজারো অপকর্মের সাথে জড়িতদের নির্লজ্জ তোষামোদি করবে।
সমাজের অধঃপতন চূড়ান্তভাবে ঠেকাতে চাইলে শুধু জনসাধারণকেই সচেতন হলে চলবে না, যারা কপটতার চাদর গায়ে মেখে নৈতিকতার বিমর্ষ বিলাপ করে তাদেরও পরিশুদ্ধ হওয়া জরুরি।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০