———–
” আপা, আমার মেয়ে তো গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। আপনার ছেলের কি খবর? ও কি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে?”
” না আপা, আমার ছেলেটা অল্পের জন্য গোল্ডেন এ প্লাস পায়নি। ও সাধারণ ( সিলভার) এ প্লাস পেয়েছে ।
কিন্তু পাশের বাসার ভাবীর মেয়ে নাকি সাধারণ (সিলভার) এ প্লাসও পায় নাই!”
বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হলেই সারাদেশে হইচই শুরু হয়। তবে কে পাশ করেছে আর কে ফেল করেছে সেটা দেখার বিষয় নয়, কে এ প্লাস পেয়েছে আর কে পায়নি,সেই হিসাবই বেশি চলমান থাকে। উত্তীর্ণের দাড়িপাল্লার একক যেন ‘এ প্লাস’ ! কে ‘এ প্লাস’ পেয়েছে, কে পায়নি, এটাই যেন মূখ্য বিষয়।
আজ (৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) প্রকাশিত হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট। তথ্যানুসারে এবছর মোট জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। যে শিক্ষার্থী ৪.৯০ বা তার উপরে পেয়েছে তিনিও অসন্তুষ্ট, অল্পের জন্য এ প্লাস পায়নি তাই! ৪.৭০ বা ৪.৮০ এর উপরে পেয়েও হিসাবের কলমের কালি শেষ করে ‘এ প্লাস এর বাটখাড়া’ দিয়ে, কত নম্বরের জন্য এ প্লাস ছুটে গেলো! এ প্লাস পাওয়া স্টুডেন্ট এবং তাদের অভিভাবকদের হাসি কখনো কখনো ” গালফুলা হাসি” আবার কখনো কখনো ” মুখবাঁকা হাসি”, কে বা কার ছেলে মেয়ে এ প্লাস পায়নি! অল্পের জন্য এ প্লাস না পাওয়া স্টুডেন্ট কাঁদে দরজা বন্ধ করে, কেউ বসে থাকে মন খারাপ করে। ওদিকে অভিভাবক তো আছে ফুলেফেঁপে, ” তোর পড়াশোনা বন্ধ, ঘর ছাড়বি আইজকাই! পাশের বাসার অমুকে এ প্লাস পাইলো,তুই ক্যান না পাইলি?”
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার দৌড়ে ধ্বংস হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার্থীরা সত্যিকারের “জ্ঞান ও দক্ষতা” অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে, শিক্ষা তাদেরকে “গেলানো ” হচ্ছে, আর এর প্রবণতা শহরাঞ্চলে ও উচ্চবিত্তদের মধ্যেই বেশি।
এ প্লাস পেলেও শেষ কথা নয়। পরখ করে দেখা হয় সে এ প্লাস স্বর্ণের (গোল্ডেন এ প্লাস) নাকি রৌপ্যের (সাধারণ এ প্লাস) !
এবছর এইচএসসিতে এ প্লাসের সংখ্যার চেয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনসংখ্যা কয়েকগুণ কম। অথচ এ প্লাসের নিচেও ভালো রেজাল্টধারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কয়েক লাখ! এ প্লাস বা এই রেজাল্টের পরবর্তী ধাপ কি তা কি জানা আছে?
একজন জিপিএ ৪.০০ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলো, আরেকজন জিপিএ ৫.০০ পেয়েও কোথাও চান্স পেলো না, তবে কে জিতলো? আজ এ প্লাস পাওয়ার পর আপনাকে যারা প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছে, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলে তারপর আপনার সম্মুখে বা পিছনে ঐসকল মানুষগুলো কি আপনার প্রশংসা করবে? আজ এ প্লাস পাননি বলে যারা সমালোচনা করতেছে, মুখ বাঁকিয়ে হাসতেছে , যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবেন তখন কি তাদের এই হাসি থাকবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোঃ জাকারিয়া যিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের বাঁধনের সাধারণ সম্পাদক,তিনি এইচএসসিতে ৩.৭৫ পেয়েছিল, এখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার সাথের অনেক বন্ধুরা জিপিএ ৫.০০ পেয়েও বিভিন্ন কলেজে বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এখন মানুষ কাকে মেধাবী বলে?
এখন যারা জাকারিয়াকে মেধাবী বলে তারা কি এইচএসসির রেজাল্টের পর জাকারিয়াকে নিয়ে সমালোচনা করেনি? “বাঁকা হাসি” হাসেনি ?
কিন্তু দিনশেষে বিজয়ের হাসি জাকারিয়ার মুখেই।
কোনটি গোল্ডেন রেজাল্ট সেটা গভীর জ্ঞান দিয়ে বুঝতে হবে। যে রেজাল্ট স্থায়ী গর্বের সেটাই হতে পারে গোল্ডেন রেজাল্ট বা সোনালী ফলাফল। যিনি ৩.২৫ বা ৩.৭৫ পেয়েও ভবিষ্যতে সেই রেজাল্ট নিয়ে গর্ব করতে পারে, সেই রেজাল্ট গর্বের সাথে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারে, যে রেজাল্ট মানুষ দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরে, সেই রেজাল্টই হলো সত্যিকারের “গোল্ডেন রেজাল্ট” , হোক সেটা ” গোল্ডেন এ প্লাস” অথবা হোক সেটা ” গোল্ডেন ৩.২৫”! আর সর্বোচ্চ রেজাল্ট করেও যদি পরবর্তী সময়ে সে রেজাল্ট গর্বের সাথে বলা না যায়,তবে সেটা কখনোই গোল্ডেন রেজাল্ট হতে পারে না। আজকের জিপিএ ফাইভ বা তথাকথিত গোল্ডেন এ প্লাস বা এ প্লাস প্রাপ্ত শিক্ষার্থী যদি পরবর্তী ধাপে বিজয়ী হতে না পারে তবে ছয় মাস পরেই এই রেজাল্ট ঢেকে যাবে অন্ধকারে, কখনো গর্বের সাথে বলতে পারবে না যে আমি “গোল্ডেন এ প্লাসের স্টুডেন্ট” ছিলাম!
সুতরাং, সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি রেজাল্টের মধ্যে কে গোল্ডেন রেজাল্ট পেয়েছে আর কে গোল্ডেন রেজাল্ট পায়নি সেটা নির্ভর করবে আসন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধে জয়ের উপর, নির্ভর করবে পরবর্তী অর্জনের উপর। যে যেই রেজাল্টই পেয়েছে, সবার উচিত পরবর্তী ধাপের জন্য তৈরি হওয়া। সবার উচিত নিজের প্রাপ্ত রেজাল্টকে ” গোল্ডেন রেজাল্টে” পরিণত করা।
মোঃ কাওসার আহমেদ
শিক্ষার্থী-ইংরেজি বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়