-----------
৩০ শে মার্চ রোজ শনিবার,২০২৪। খান ইউনুসের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইদ্রিসের পরিবার রাফা নগরীর আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছিলেন। তিন ছেলে ও দুই মেয়েসহ সাত জনের পরিবার। ছোট মেয়ে খাদিজা সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবাকে খুঁজে। বাবাকে ইহুদি বুঝি তুলে নিয়ে গেল। বুলেট কি বাবাকে চির নিদ্রায় পাঠাল। মাথার ওপর বুঝি বোমা পড়ল। বাবা, বাবা তুমি কোথায়?বয়স ৯ বছর বোধ হয়। ইদ্রিস ততক্ষণে বাসায় ফিরলো। আজকে ত্রাণের ট্রাক আসেনি। রাফা ক্রসিং এ বোম্বিং হচ্ছে। স্ত্রী আয়েশা খাদিজার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। খাবারের বন্দোবস্ত করা গেল না। ছোট্ট এতটু রুমে বোধ হয় মরণযন্ত্রনায় পিষ্ট হলে একটু খাবার পানিও জুটবে না। তিন ছেলে বাবাকে পরিবার দেখবালের দায়িত্ব দিয়ে তারা সার্বভৌমত্বের দায়িত্বে গেছেন। কতগুলো রাত তাদের দেখা হয় না! রাতে গল্পের পসরা হয় না! কি মর্মান্তিক প্রতিদিন মৃত্যুক্ষুধায় অনিশ্চিত যাত্রা!আয়েশা-ইদ্রিস দম্পতি অনিশ্চিত তাদের ছেলেদের জীবন আছে কি প্রশ্নে, পুরো গাজা নগরীই যেন বিভীষিকা।
অভিশপ্ত ইহুদী গ্রাসে মানবিক গাজা ভস্মীভূত। ইদ্রিস এত ভীতু ছিলো। কখোনো কখোনো আতশবাজির শব্দ শুনলেও কেঁপে উঠতেন। আয়েশা অবাক,সে ইদ্রিস প্রবল,প্রচণ্ড,অবিচল, তেজোদৃপ্ত এবং দূর্বার। পুরো সময় পরিবারের মনোবল যোগাচ্ছেন।লাশ দাফন করছেন। বৃদ্ধদের আশ্রয় শিবিরে নিয়ে আসছেন।সমস্ত অভিযোগ নামাজে শেষে করছেন! কান্নায় গড়াগড়ি করছেন। হয়তো বলছেন, খাদিজার খাবার কোথায়? সুমাইয়ার পর্দা করার পরিবেশ কোথায়? আয়েশার চুলোর রুটি কোথায়? আমার তিনটে ছেলে কোথায়? সিজদা করার মসজিদ কোথায়?কোথায় রব, উত্তর দিন? কোথায়! কোথায়!
ততক্ষণ আয়েশা চোখ মুছলেন!হে আমার প্রশান্তি, দায়িত্ববান,আপনি চোখ মুছুন। তিনি ভালোই জানেন।কতদিন খাদিজা বাবার কাছ থেকে প্রিয় খেজুর পায়নি।বাবা একবার আয়েশা,একবার খাদিজা এবং একবার সুমাইয়ার দিকে তাকান।যেন অনিশ্চিত যাত্রা,অগত্যা ভয়, জীবননাশের তীব্র শংকা তাড়া করছে।
প্রায় পাঁচ মাস। আব্দুর রহিম আদরে ছেলে, হেফজ শেষ করছে।নিজেকে দেখতে পেতেন আব্দুর রহিমের অবয়বে। পেশায় সৈনিক।মেঝো ছেলে ইউসুফ ফালিতে থাকতেন। ওখানেই পড়াশোনা করতেন গাজা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই ছেলেই শত্রুসেনার বিরুদ্ধে সমরে গেছেন। দুই ছেলে বাবা-মায়ের অনুমতি নিলেন।দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার বাজি ধরলেন। শেষ বারের মতো আয়েশা-ইদ্রিসের হাতে চুম্বন করলেন।আবেগঘন পরিবেশ।সুমাইয়া কাদতেছে। খাদিজা বলতেছে ভাইয়া তোমরা যেয়ো না।ইহুদী ভালো না।মেরে ফেলবে। এসব যেন আজ স্পর্শ করছে না আব্দুর রহিম,ইউসুফের মন ও শরীর। প্রচন্ড মায়াহীন। বিপ্লবী।
চোখে-মুখে প্রতিশোধের ঝাণ্ডা পত পত করে উড়ছে আর উড়ছে।ইয়াকুব বয়স ১৬ ছুঁইছুঁই।পুরো দৃশ্যপট দেখছিলেন।ওরা চললো।বাবা, ওদের থামাও! কেন?এমন বলতে নেই,পূণ্যের কাজে।বাবা আমিও যাবো। না,তুমি ছোট। আমি কাকে নিয়ে বাচবো! আমি কি রাসূলের উম্মত নই? রাসূল কি আমাকে দেখে না?আমি কি সক্ষম নই? আমি কি পবিত্র ভূমিতে জন্মায়নি?আল-আকসা রক্ষার দায়িত্ব কি আমার কাঁধে পড়েনি!আমি যাচ্ছি এবং যাবোই।হাসিমুখে বিদায় দাও। আয়েশা চোখ মুছলেন এবং হাসলেন।ওপরের দিকে আকাশপানে তাকালেন। বললেন তুমি সাক্ষী থেকো। ইদ্রিস ইয়াকুবকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। দু-গালে চুমো খেলেন। অতঃপর কপালে। যাও বাবারা আল্লাহর জিম্মায়।
এসব ভীষণ মনে পড়ছে। চোখের সামনে ইয়াকুবের হাসিটা ভাসছে।সে কি মায়াবী!ইউনেস্কোর অফিসের পাশেই দুটো কোমল তাজা শিশুর লাশ দেখে বাসায় আসছিলেন। একদম ইয়াকুবের মতোই।বাবার মন কত কথাই বলে!চোখ মুছলেন। আয়েশা ভেঙে পড়বে।
আব্দুর রহিম পেশায় সৈনিক।মনে-প্রাণে প্যালেস্টাইন ধারণ করেন।কেনইবা বাসবেন না! হাজারো নবিদের পূণ্যভূমি।হুযাইফার নিকট সদস্যাপদ নিলেন দেশ মাতৃকার জন্য।পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় আব্দুর রহিম ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের দায়িত্ব পেলেন। একই ব্যাটালিয়নে অন্য দুই ভাইয়েরও রিক্রুটমেন্ট হলো। ইয়াকুবকে সবাই ভালোবাসতেন। রাতে বিশ্রামের ফাঁকে সবাই ইয়াকুবের হাসিমাখা মুখ দেখে দুঃখ ভুলতেন। আব্দুর রহিম বদর যুদ্ধের অসম লড়াই আর আল্লাহর সাহায্যে বিজয়ের কথা বলতেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঠান্ডা। নির্জন আর ভয়ংকর সুড়ঙ্গপথ। ইয়াকুবের মনে হতো কত আপন এ যেন সোনায় মোড়ানো বাড়ি।
প্রতিক্ষণে যখন কেউ একজন এসে বলতেন কমান্ডার।আই অ্যাম আনাস;আই কমপ্লিট মাই ডিউটি।থ্রি ইনজুরড এন্ড টুয়েলভ কিলড।মিশন ইজ একচুয়াল সাকসেস।আওয়ার ইয়াছিন রকেট লিচেন শাহাদা এন্ড ফলো কমান্ড, শুট এন্ড শুট।ইয়াকুব স্বপ্ন দেখেন একদিন গাজা মুক্ত হবে।শত্রুসেনা বিতাড়িত হবে।অবরোধ উঠে যাবে।তিনি এসব বিজয় গাথা লিখবেন।
রাত সাড়ে তিনটে পুড়ো এট্যাক প্লান সাজালেন।সাথে ইয়াকুব। স্যার,আব্দুর রহিম।এটা কেমন নগরী। সব ধূসর।কোথাও প্রাণের আবাস নেই সুনশান নিরবতা।কি সুন্দর ইয়াহিয়া সিনওয়ারের গাজা!বাইশ বছর জেল খেটেও স্বাধীনতার স্বাদ পেতে পিছপা হননি।স্যার,দেখছেন কত সুন্দর চাঁদ!নিমিষেই মুখ স্তব্ধ। চারদিকে লাশ। একটা বাড়িও ইহুদীর আক্রশ থেকে রক্ষা পায়নি।এম্বুশ করলেন।অতর্কিত আক্রমণ। তছনছ হয়ে গেল ইহুদী ক্যাম্প।ইয়াছিন রকেট যেন বার বার বলছে ইউসুফকে; প্লিজ ট্রাক এন্ড সুট।বারংবার আক্রমন। অতঃপর নিরাপদে সরে পড়লেন। ইয়াকুব হাসলেন এবং হাসালেন সবাইকে। ইহুদী! ইহুদী!নেতানিয়াহু!উই উইল মিট ইউ এগেইন এন্ড এগেইন। আমরা তোমাদের মতো জাতি নয় যে মুসাকে বলছিলে আপনি আর আপনার আল্লাহ যুদ্ধ করেন।আমরা লড়বো, লড়ে যাবো। শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে।জয় আমাদের।কারন এ জয় মানবতার।এ জয় মিথ্যের ওপর সত্যের।
----------
মোঃআব্দুর রাজ্জাক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০