পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহে কোরবানির তিনটি পরিভাষা পাওয়া যায়। তা হলো—কোরবান, নুসুক, যাব্হ। জিলহজ মাসের দশম তারিখ মুসলিমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে পশু জবাই করে পরিভাষায় তাকেই কোরবানি বলা হয়। কোরবানির দুটি ঘটনা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।
প্রথমটি আদম (আ.)-এর দুই পুত্রের কোরবানি এবং দ্বিতীয়টি ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি। দুটি ঘটনা থেকে একজন মুমিনের অসংখ্য বিষয় গ্রহণ করার রয়েছে। যেমন—
১. তাকওয়াভিত্তিক জীবন : কোরবানি কবুলের অলঙ্ঘনীয় শর্ত তাকওয়া বা সর্বক্ষেত্রে আল্লাহভীতি। আদম (আ.) দুই পুত্রের ঘটনায় তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না। সে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করবই। অপরজন বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২৭)
২. তাওহিদভিত্তিক জীবন : ইসলামপূর্ব আরবে দেব-দেবির নামে কোরবানি করত।
নবীজি (সা.)-কে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করো এবং কোরবানি করো।’ (সুরা কাউসার, আয়াত : ২)
৩. একনিষ্ঠতা : কোরবানি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের আল্লাহভীতি।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৭)
৪. পূর্ণ আত্মসমর্পণ : ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর ছেলে ইসমাইল (আ.) পূর্ণ আত্মসমর্পণের চিত্রই পবিত্র কোরআন চিত্রিত করেছ।
ইরশাদ হয়েছে, ‘তখন ইবরাহিম বলল, হে বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে আমি তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কী বলো? সে বলল, হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১০৩)
৫. আত্মত্যাগ : আল্লাহ বান্দার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুর কোরবানিতে খুশি হন। তাই ইবরাহিম (আ.) তাঁর প্রিয় সন্তান ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যা ভালোবাসো তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনো পুণ্য লাভ করবে না। তোমরা যা কিছু ব্যয় করো আল্লাহ অবশ্যই সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯২)
৬. আদর্শ পরিবার গঠন : ইবরাহিম (আ.) প্রিয় সন্তানকে কোরবানি করার মতো ত্যাগ স্বীকার করতে এবং সন্তান সে আদেশ সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিতে একটি আদর্শ পরিবার গঠন করতে হয়েছিল। হিব্রু ভাষার ইসমাইল শব্দের অর্থ আল্লাহর আদেশ শোনা ব্যক্তি। তাই কোরবানির জন্য আদর্শ পরিবার গঠন অপরিহার্য।
৭. ভুলের জন্য তওবা করা : আদম (আ.) যে পুত্রের কোরবানি কবুল হয়নি এবং যে ক্ষুব্ধ হয়ে ভাইকে হত্যা করেছিল, সে অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা এ ঘটনায় ভুলের জন্য তওবা করার শিক্ষা দিয়েছেন।
৮. মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে দাওয়াতি কাজ : আদম (আ.)-এর আরেক পুত্র মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও ভাইকে হত্যাকাণ্ডের ফলাফল বলে নসিহত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে হত্যা করতে তুমি হাত তুললেও তোমাকে হত্যা করতে আমি হাত তুলব না; আমি তো জগত্গুলোর প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।
৯. আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য : কোরবান শব্দের মৌলিক অর্থ নৈকট্য। কোরবানি ব্যক্তিকে আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য অর্জন করে দেয়। আল্লাহর ক্রমাগত নৈকট্য অর্জনকারীর জন্য কোরবানি একটি পরীক্ষা।
১০. দুঃখ-আনন্দের ভাগাভাগি : কোরবানির গোশত ধনী-গবির, পরিবার-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবার মধ্যে ভাগাভাগি করা যায়। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তাদের চতুষ্পদ জন্তু হতে যা জীবিকা হিসেবে দান করেছেন তার ওপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার করো এবং দুস্থ, অভাবগ্রস্তদের আহার করাও।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৮)
আল্লাহ তাআলা কোরবানির জন্য মানস গঠন করার তাওফিক দিন। আমিন।
ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা