এশিয়ার অন্যতম আলোচিত শহর ঢাকা।মুঘল আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অসংখ্য গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আর ঐতিহ্যের চিহ্ন বহন করে আছে এই শহর। বর্তমান বিশ্বের উল্লেখযোগ্য ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে প্রথমদিকে অবস্থান ঢাকার।প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বসবাস এখানে।বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকার বাসযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।অত্যধিক মানুষের চাপ,অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বায়ুদূষণের চরম মাত্রা কিংবা ট্রাফিক জ্যামের কারণে সচেতন মহলের মাঝে প্রশ্ন ওঠছে, কতটা বাসযোগ্য নগরী ঢাকা?
বিশেষজ্ঞরা ঢাকার বাসযোগ্যতা হারানোর বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।তার মধ্যে বায়ুদূষণের ব্যাপারটি সবচেয়ে আলোচিত বলা যায়।সর্বশেষ তথ্যনুযায়ী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরী। লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা টোকিওর মতো আধুনিক শহরে পরিণত হতে না পারলেও ঢাকা যেন বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।কেন এতটা দূষিত ঢাকার বায়ু? এর পিছনে বিশ্লেষকরা বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন।যেমন:যত্রতত্র ময়লা আবর্জনার স্তুপ,কলকারখানাগুলোর বর্জ্য নিষ্কাশনে অব্যবস্থাপনা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং যততত্র বস্তি স্থাপন ইত্যাদি।দূষিত নগরীর পাশাপাশি ঢাকাকে বিশ্বের অন্যতম অপরিচ্ছন্ন নগরী বললেও বোধহয় ভুল হবে না।এর দায় দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।ঢাকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেমন:শাহবাগ, যাত্রাবাড়ি,কাওরান বাজার এমনকি মতিঝিলের মতো কর্পোরেট জায়গায় ময়লা-আবর্জনার স্তুপ জমে থাকতে দেখা যায় প্রতিনিয়ত।যা আশঙ্কাজনকভাবে ঢাকার বায়ুকে বিষাক্ত করে তুলছে । ফলে আধুনিক শহর হিসেবে ঢাকা তার মান তো হারাচ্ছেই,পাশাপাশি দূষণের ফলে নগরবাসীর স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন।কারণ বায়ু দূষণ ক্রমাগত বিশ্বব্যাপী অক্ষমতা এবং মৃত্যুর জন্য শীর্ষ ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে অন্যতম।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, 'বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ'।
ঢাকা সম্পর্কে কেউ চিন্তা করলে সর্বপ্রথম যে দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হলো, অত্যধিক মানুষ।বর্তমানে ঢাকায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষ বসবাস করছে।এই অত্যধিক মানুষের চাপ সহ্য করাটা ঢাকার জন্য খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।জীবিকা ও কর্মসংস্থানের তাগিদে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ মানুষ ঢাকাগামী হচ্ছে। শহরের বড় বড় শপিংমল এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলতে পা রাখার জায়গা পর্যন্ত পাওয়া যায় না মানুষের ভিড়ে। তাই ঢাকাগামী মানুষের স্রোত ঠেকাতে ঢাকাকে ডিসেন্ট্রালাইজ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।রাজধানীতে যেহেতু দেশের অধিকাংশ ব্যবসা, সেবামূলক এবং প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান অবস্থিত তাই কর্মসংস্থানের খোঁজে মানুষ ঢাকাগামী হচ্ছে।যদি ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়, তবে ঢাকাগামী জনস্রোত অনেকটা কমে যাবে বলে আশা করা যায়।অন্যথায়, জনসংখ্যার আধিক্যের ফলে বিশৃঙ্খল এবং অগোছালো শহরে পরিণত হতে পারে ঢাকা।
ঢাকাকে বলা হয় জ্যামের নগরী।ট্রাফিক জ্যাম নিঃসন্দেহে ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা।সকালের নাস্তায় পাঁউরুটিতে জ্যাম-জেলি নাও থাকতে পারে, তবে ট্রাফিক জ্যাম বা যানজট সবার জন্যই বরাদ্দ। যদি তিনি অফিসযাত্রী হয়ে থাকেন।এখানকার জ্যাম এতটাই বেশি যে,যারা প্রতিদিন গণপরিবহনে যাতায়াত করেন তাদের জীবনের বিরাট একটা সময় জ্যামেই নষ্ট হয়।কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ঢাকার যানজট নিয়ে। যাতে বলা হয়, 'শুধু জ্যামের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৭২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে'। এতেই বুঝা যায়,ঢাকাবাসীর জন্য জ্যাম কতটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন যানজটের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। যানবাহনের পরিমাণ যদি আরও বাড়তে থাকে এবং এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা না যায়, তাহলে সামনে হয়তো হেঁটেই গাড়ির আগে গন্তব্যস্থলে পৌঁছা যাবে।মোটকথা যানজটের ফলে ঢাকাবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, সড়কের উন্নয়নে নানা পরিকল্পনার গ্রহণ, ফ্লাইওভার নির্মাণসহ বহুমুখী প্রচেষ্টার পরও জনভোগান্তি রয়ে গেছে আগের মতোই।এমনকি মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল,এবার হয়তো জ্যামের বিরক্তি থেকে মুক্তি মিলবে।কিন্তু তাদের সে আশা আশায় রয়ে গেল।
এমন আরও অনেক সমস্যায় জর্জরিত প্রাণের শহর ঢাকা পরিণত হয়েছে অস্থির এক নগরীতে।কাজেই,এ সমস্যা থেকে উত্তরণ এবং তা সমাধানের পথ খোঁজাটা খুবই জরুরি।অন্যথায়, ঢাকা পৃথিবীর অনেক শহরের মতো অদূর ভবিষ্যতে পরিত্যাক্ত নগরীতে পরিণত হবে।
মোহাম্মদ রায়হান,
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০