✍️সেঁজুতি মুমু
নিত্যদিনের মতো আজও অকারণে ঘন্টার পর ঘন্টা ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ চোখে পরল “Multiple Personality Disorder” নামে একটি মানসিক রোগ।
পরে Google এ সার্চ করে দেখলাম এর মানে হলো, বিচ্ছিন্নকারক পরিচয় রোগ বা বহুব্যক্তিত্ব রোগ। এটি হল একটি মানসিক ব্যাধি যা অন্তত দুটি স্বতন্ত্র এবং তুলনামূলকভাবে স্থায়ী ব্যক্তিত্বের অবস্থা বজায় রাখে। মানুষের মধ্যে একাধিক ব্যক্তিত্ব সক্রিয় থাকে।
যা বুঝলাম তা হলো ধরেন, “সীতা একজন মেয়ে সে খুব সাদা সিধে ভিতু প্রকৃতির কোনোকিছুর প্রতিবাদ তো দূরে থাক সামান্য বকা দিলেই সে কান্না করে। মাঝে মাঝে সীতা নিজের এই ব্যক্তিত্ব ভুলে গিয়ে নিজেকে গীতা ভাবা শুরু করে মানে এমন একজন যে নির্ভয়া নারী, অন্যায়ের সাথে আপোস করে না৷ সবাই সীতার এই রুপ দেখে বিস্মিত হয়। অনেকে তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টাও করে। কিন্তু সীতা নিজে জানেও না কখন সে এরকম করল। সে দ্বিধাদ্বন্দে ভোগে। এই যে একই ব্যক্তির মধ্যে একাধিক ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব এটা একধরনের মানসিক সমস্যা।” এটা পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হলো আমরা সবাই তো কম বেশি একাধিক ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করি তাহলে আমরাও কি “Multiple personality Disorder” এ ভুগছি? সে হিসেবে তো সবাই মানসিক রোগী! কিন্তু না যারা আসলে এই রোগে আক্রান্ত তারা অসহায়। অন্যদিকে আমাদের মতো সুস্থ সবল মানুষের অধিকাংশই নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য একাধিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়।
আমি ব্যঙ্গ করে এটাকে নাম দিয়েছি, “ঐচ্ছিক বহুব্যক্তিত্ব রোগ” বা ” Intentional
Multiple Personality Disorder “.
শুনে হাসি পাচ্ছে তাই তো? চলুন তবে কিছু দৃষ্টান্ত দেখা যাক। আমি আমার জীবন দিয়েই তা দেখাচ্ছি।
আমি যখন বাসায় থাকি তখন সবার সাথে হেসে খেলে বেরাই যেন আমি এক সদাহাস্যজ্বল তরুন প্রান। সারাদিন বাচালের মতো কথা বলতেই থাকি। কিন্তু এই আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যারদের সামনে থাকি বা কোনো সেমিনারে যাই তখন এমন গম্ভীর ভাবে থাকি যেটা দেখে মনে হবে বাসার আমি আর এই আমির মধ্যে বিশাল ফারাক। যেন একই চেহারা কিন্তু বিপরীত স্বভাবের দুই জমজ বোন। আমার এই আচরণ অবশ্য স্বার্থের কারনে অতোটা নয় যতোটা পরিবেশের কারনে। তাহলে আমরা শুধু স্বার্থের কারনেই নয় পরিবেশ, নৈতিকতা ইত্যাদির কারনেও বাধ্য হয়ে ব্যক্তিত্ব বদলাই। অথচ আমরা তা খেয়ালও করি না। একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা চলে। অনেক সময় আমরা বন্ধুদের সামনে যে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটাই, শিক্ষকদের সামনে সেটা করি না। এই যে স্থান,কাল পাত্র ভেদে ব্যক্তিত্ব বদলাচ্ছে এটাকে পুরোপুরি intensionally বলা যাবে না। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মানুষ স্থান,কাল, পাত্রভেদে খুবই পরিকল্পনার সাথে নিজেদের ব্যক্তিত্ব বদলায়। যেমন ধরুন তথাকথিত স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতাগণ। রাজনৈতিক নেতাগণ জনগনের সেবায় সবসময় তৎপর থাকেন। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি তাদের স্বার্থের জন্য যা নয় তা করে এই রাজনীতির নেতা শব্দের পরিভাষাই বদলে দিয়েছেন। এনারা ভোটের প্রচারনার সময় এত ভালোভাবে জনগনের সেবা করে এত সুন্দর ব্যবহার করে যেন তারা মাটির মানুষ। অথচ যেই ভোটে জিতে গেল মানে স্বার্থোদ্বার হলো অমনি তাদের ব্যবহার এমন হয়ে যায় যেন তারা রাজা আর জনগণ তাদের ফাইফরমাশ খাটা প্রজা।
শিক্ষক হলেন জাতি তৈরির কারিগর। একটা উন্নত জাতির পিছনে শিক্ষকের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে তারাও স্বার্থান্বেষী হয়ে যাচ্ছেন। স্কুল কলেজের বেশিরভাগ শিক্ষকদের দেখুন। স্কুলে এত আদর্শবান ব্যক্তিত্ব নিয়ে থাকেন যেন তারা কোনো অন্যায়কে প্রশয় দেন না। প্রায়শই এনারা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের বলেন, “তোমরা গণ্ড মুর্খ, কিচ্ছু করতে পারবা না জীবনে।” আবার এনারাই যখন গৃহ শিক্ষক হন বা কোচিং সেন্টারে পড়ান তখন তাদের ব্যক্তিত্ব একদম ভিন্ন হয়ে যায়। তখন তারাই শিক্ষার্থীদের অভিভাবককে বলেন, ” ওর ব্রেইন খুব ভালো, কিন্তু পড়ে কম। চিন্তা নেই আমার হাতে দিয়েছেন ও এবার থেকে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করবেই! ” এই দেখে বেচারা শিক্ষার্থী না পারে হাসতে না পারে কাঁদতে!
জীবন বাঁচানোর ভুমিকায় ডাক্তারদের স্রষ্টার পরের আসনে বসানো হয় ।অবশ্যই তাদের প্রয়োজন অপরিসীম। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের মধ্যে অনেকেই রোগীর জীবনের চেয়ে টাকাকে বেশি মুল্য দেন। যেমন সরকারি হাসপাতালে দশ টাকার টিকেট কেটে ডাক্তার দেখানোর সময় ডাক্তার যেরকম দায় সারা কাজ করেন ঠিক সেই ডাক্তারই প্রাইভেট ক্লিনিকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোগী দেখার সময় অত্যন্ত যত্ন সহকারে দেখেন। এই যে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন এটা অতি বিস্মিত করে আমায়। কিভাবে পারে মানুষ এত অভিনয় করতে? জানি না তবে আমিও সেই মানুষগুলোর বাইরে নই। যতোই হোক আমরা সৃষ্টির সেরা জীব দুই পাওয়ালা প্রানী!