কাজী আশফিক রাসেল
২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এবার পাশের হার ৬৮ শতাংশ, যেখানে গতবছর ছিল ৮৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমে এসেছে লক্ষণীয় হারে। ফলাফল প্রকাশের পর সামাজিক মাধ্যমে ও চায়ের টেবিলে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের বিপথগামীতার কথা; বিশেষ করে টিকটক আসক্তি, কিশোর গ্যাং কালচার এবং পড়াশোনার প্রতি অনাগ্রহ। অনেকে একচেটিয়াভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। আমি তাদের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই।
হ্যাঁ, শিক্ষার্থীদের অনেকে আজকাল পড়াশোনার বদলে টিকটক, ফ্রি ফায়ার, বা রাস্তায় “ভাই ভাই” কালচারে বেশি অভ্যস্ত। কিন্তু এই অবক্ষয়ের পেছনে দায়ী কারা? কে তাদের এমন পরিবেশে ঠেলে দিয়েছে?
পুরো একটা প্রজন্ম ধ্বংস হয়েছে একটি ভয়ঙ্কর সিস্টেমের হাতে, যা গত ১৭ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় মদদে চলেছে। শিক্ষাকে বানানো হয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ার। পাশের হার বাড়িয়ে জনগণের চোখে “উন্নয়ন উন্নয়ন” খেলা দেখানো হয়েছে। পাশের হার তখন ছিলো ৯০% এর কাছাকাছি, জিপিএ-৫ যেন মৌসুমী ফল, এই সংস্কৃতির জন্ম দেওয়া হয়েছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে।
এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছিল কম পরিশ্রমেও ভালো রেজাল্ট করা যায়। বহু প্রতিষ্ঠানে প্রশ্নফাঁস, নকলের ছড়াছড়ি আর শিক্ষার নামে ব্যবসা চলেছে। শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে পড়ার টেবিলের বদলে মোবাইল স্ক্রিনে অভ্যস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং।
আমি নিজ এলাকার একটি উদাহরণ দিতে পারি একজন কথিত “শিক্ষানুরাগী” রাজনৈতিকভাবে সুবিধা নেওয়ার জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার নামে ব্যবসা শুরু করেন, তার প্রতিষ্ঠানে কিশোর গ্যাং পোষণ করেন। এলাকায় ভয়ভীতি, প্রভাব বিস্তার এবং দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি বোর্ড পরীক্ষায় ১০০% পাশের রেকর্ড গড়েন। অথচ অভ্যন্তরে চলত প্রশ্নফাঁস, নকল সরবরাহ এবং শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি। স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা যখন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং প্রমাণসহ অভিযোগ করে, তখন বোর্ড বাধ্য হয়ে ওই প্রতিষ্ঠানটির পরীক্ষা কেন্দ্র সরিয়ে নেয়। আগামী এইচএসসি পরীক্ষার ফলেই বোঝা যাবে এই প্রতিষ্ঠান আসলে কতটা ভয়ংকর প্রতারণা করে এসেছে এতদিন।
ফলাফল কমেছে মানেই শিক্ষার মান কমেনি বরং এটিই বাস্তব রেজাল্ট। আমরা প্রথমবারের মতো দেখছি গোঁজামিলহীন, প্রতারণাহীন একটি ফলাফল। তবে এই ধাক্কায় শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে পড়বে না, তা বলা যায় না। অভিভাবকদের এই পরিবর্তন বুঝতে হবে। সন্তানকে তুলনা করে বকাবকি করা, গালাগাল দেওয়া বা অপমান করার সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত করে তুলবে।
তাই একচেটিয়াভাবে দোষ না দিয়ে আমাদের উচিত এই প্রজন্মকে সহানুভূতির চোখে দেখা। তারা ‘অপরাধী’ নয়, তারা সিস্টেমের শিকার। অভিভাবকদের উচিত সন্তানকে তুলনা না করা, নেতিবাচক কথাবার্তা না বলা।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন ব্যাপক পরিসরে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা, কাউন্সেলিং, আরেকটা সুযোগ দেওয়ার আশ্বাস। সরকারকেই এটা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু ফল প্রকাশ করে দায় শেষ না। সাহায্যের হাত না বাড়ালে এই ফলাফল থেকে জন্ম নেবে আত্মহত্যা, হতাশা আর স্থায়ী মানসিক ক্ষতি।
সিস্টেম বদলাচ্ছে ভালো কথা। কিন্তু যারা সিস্টেমের পচা ফসল হয়ে বেড়ে উঠেছে, তাদের আগেই ছেঁটে ফেলা নয়; দরকার যত্ন করে সুস্থ করে তোলা।
আমরা যদি এই সময়টাকে মানবিকভাবে না দেখি, তাহলে আজকের ফেল করা ছেলেটা আগামীকাল সমাজের জন্য ভয়ংকর কিছু করে বসতে পারে। তখন আর বলার সুযোগ থাকবে না - “আমরা জানতাম না।”
লেখকঃ হিউম্যান রাইটস এক্টিভিস্ট।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০